প্রবাসের সংবাদ

রোহিঙ্গাদের সোনার হরিণ মালয়েশিয়া !

রোহিঙ্গাদের-সোনার-হরিণ-মালয়েশিয়া
সংগৃহীত

রোহিঙ্গাদের সোনার হরিণ মালয়েশিয়া !

পাচারকারীদের টার্গেট নারী ও শিশু

মোহাম্মদ ওমর ফারুক ।। দিনে দিনে রোহিঙ্গা পাচারের হার বাড়ছে। ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, খুনোখুনি, অভাব অনটনসহ নানান কারনে তারা নিজেরাও বের হতে চায় ক্যাম্প থেকে। চায় একটি সুন্দর জীবন। কিন্তু ক্যাম্প থেকে দালালদের প্ররোচনায় নিরুদ্দেশভাবে সাগর পথ পাড়ি দিতে গিয়ে সম্মুখীন হয় অনিশ্চিত জীবনের। কেউ কেউ নৌকা ডুবে মারা যায় সাগরেই, কেউ দালালদের অত্যাচারে। আবার এসব রোহিঙ্গাদের কেউ লক্ষ্য স্থানে পৌঁছালেও সেখানে গিয়েও পড়তে হয় হাজারো বিপদে। আবার সেই বিপদ পার হয়ে গেলেও তারা নিজেরাই বাংলাদেশী পরিচয়ে জড়িয়ে পড়ে অপরাধে। সেই অপরাধের দায়ভার নিতে হয় বাংলাদেশকে।

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গা পাচারে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে। সাথে আছে স্থানীয় দালাল চক্র। যারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দালাল চক্রের সঙ্গে মিলে নারী ও শিশুদেরকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে। এই কাজে ভালো পারদর্শীতা দেখাতে পারে রোহিঙ্গা দালালরা। যাদের কাজ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফুঁসলিয়ে স্থানীয় দালালদের হাতে তুলে দেয়া। এর পর সোজা সাগর পথে নিরুদ্দেশ যাত্রা।

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে,প্রায় প্রতি মাসে বঙ্গোপসাগরের কোন না কোন পয়েন্ট দিয়ে মাছ ধরার নৌকা, বোট বোঝাই  করে  লোক পাঠানো হচ্ছে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্য। যদিও মাস তিনেক আগে এই যাত্র হতো প্রতিদিন। এ পথকে সহজ  ভেবে  রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নানা  কৌশলে রোহিঙ্গাদের সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দিচ্ছে চক্রটি। টেকনাফ ও উখিয়াল ৩৪ ক্যাম্পের প্রতিটি ক্যাম্পে ওই চক্রের সদস্যরা ছদ্মবেশে আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানা গেছে। সরেজমিনে উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারাও বিষয়টি স্বীকার করছে।

তবে তাদের বিরুদ্ধে ভয়ে কথা বলতে পারছেন না তারা। এসব  রোহিঙ্গাদের মধ্যে এসব মানবপাচারকারী সদস্যরা ক্যাম্পের স্থানীয় কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।

জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছে, যা ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে সমুদ্র পাড়ি দেয়া মানুষের তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ২০১৫ সালে সমুদ্রযাত্রীদের বেশিরভাগই ছিল পুরুষ। কিন্তু ২০১৮ সালের সমুদ্রযাত্রীদের শতকরা ৫৯ ভাগই নারী ও শিশু। গত বছরের চিত্র আরো ভয়াবহ। জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম বিভিন্ন সময় কাজ করতে গিয়ে ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রায় ৬৩৩ জন ভোক্তভোগীন সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাদের নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের হিসেব অনুযায়ী গত তিন বছরে ৪৫% অর্থাৎ ৩৪৮ জন রোহিঙ্গা  ভোক্তভোগী ছিলেন।

টার্গেট মালয়েশিয়া:
বাংলাদেশের পর রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ অবস্থান করছে মালয়েশিয়া। সেখানেই টার্গেট করে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর চেষ্টা করে দালালরা। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের। বিভিন্নসময় সাগরপথে পাড়ি দিতে গিয়ে উদ্ধার হওয়া বেশীরভাগ ব্যক্তিরাই বলছেন,তাদের অনেক স্বজন রয়েছে মালয়েশিয়াতে। আর এসব স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই তারা বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে বের হচ্ছিলেন। তাদের আশ্রয়দাতা বেশীরভাগই মালয়েশিয়ায় বসবাসরত রোহিঙ্গা স্বজনরা। তারা সেখানে আশ্রয়ের আশায় ও ভালো থাকার লোভে পাড়ি জমায়। কিন্তু এই চিত্র ভিন্ন সেখানে। অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়াতে গিয়েও তারা নানান নির্যাতনের শিকার হন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,মেয়ের বিয়ে দিতে এবং বাংলাদেশের ক্যাম্পের চেয়ে আরও ভাল থাকার জন্য তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেন তারা। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে,মানব পাচারকারী চক্রগুলো রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারীদের। কারণ সে দেশে থাকা রোহিঙ্গা পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য তাদের নিয়ে যায় মালয়েশিয়ায় থাকা স্বজনরা। তবে উখিয়া রোহিঙ্গা একটি ক্যাম্পের প্রধানমাঝি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,রোহিঙ্গা নারীদের মালয়শিয়া বিয়ে হলেও,ওখানে যাওয়া বড় একটি অংশ অন্যান্য দেশে যেতে চায়। বিশেষ করে অস্ট্রিলিয়া,জার্মানসহ ইউরোপের দেশগুলোতে।ওই মাঝি বলেন,কোথাও আমাদের কেউ নেই। কিন্তু আমাদের এখানে(ক্যাম্পে) কিছু দালাল আছে। যারা স্থানীয় দালালদের সঙ্গে মিশে রোহিঙ্গা নারীদের রাজি করানোর চেষ্টা করে। তাদেরকে নানান প্রলোভনও দেখানো হয়। যেহেতু আমরা এখানে খুব কষ্টে থাকি,সবাই চায় একটু ভালো জায়গা থাকতে। ফলে রোহিঙ্গারা সহজে রাজি হয়ে যায়। জানা গেছে,পাচারকারীরাও অতি সহজে রোহিঙ্গাদের পাচারে রাজি করাতে পারে বলে তাদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারলে ফেরত দেয়ার ঝুঁকিও থাকে না। পাচারকারীদের লাভও হয় অনেক বেশি। এদিকে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া গেলেও কিছু ওখানে থেকে যায়। বাকিরা আবার অবৈধ পথে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করে। সেখানে তারা বাংলাদেশী বলে পরিচয় দেয়।

 দেখানো হয় বিয়ের প্রলোভন :
টেকনাফ এবং উখিয়ায় ৩০টির বেশি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে আছেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা। যারা মিয়ানমারে নানা অত্যাচার, নির্যাতন  ও গণহত্যায় শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু এসব পালিয়ে আসার রোহিঙ্গাদের মধ্যে অবিবাহিত নারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। যারা ক্যাম্পের অভ্যন্তরেও নিজেদের মধ্যে ধর্ষণ , হত্যাসহ অনেক অপরাধে ভোক্তভোগী। উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের সাহিদা বেগম নামে এক নারী এই প্রতিবেদক’কে বলেন,আমাদের মেয়েদের নিয়ে খুব যন্ত্রনায় আছি। আমার চারটি মেয়ে। কিন্তু এখানে বেড়ার ঘর। বাঁশ বেত দিয়ে বানানো। ছিদ্র ও ফাঁকা। এসব ছিদ্র ও ফাঁকা ঘরে বখাটেরা নানান সময় উৎপাত করে। ঘরে মেয়েদের রাখা খুব কঠিন। তাছাড়া আমাদের যেসব খাবার দাবার দেয়া হয়,সেগুলো খেয়ে বেঁচে থাকাও কঠিন। খুব খারাপ জীবযাপন করছি। উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে জানা গেছে , সাহিদার মতো অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী তার পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়ে বিপাকে আছেন। শরণার্থী শিবিরে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতা ভোগেন নারীরা। প্লাস্টিক ও বাঁশের তৈরি ঘরে তাদের গোপনীয়তাও রক্ষা হয় না ঠিকঠাক মতো। তারা চেষ্টা করেন অল্প বয়সে বিয়ে দিতে, না হয় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে। ফলে গত দুই বছর ধরে, নারীদের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। দালালরাও তাদেরকেই টার্গেট করছে। টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নূরুল আলম বলেন , এই চক্রের সঙ্গে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা চক্র জড়িত । বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদিগ্ন। এবং থানা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিং নিয়মিত আলোচনা হয়। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গাদের অনেকের আতœীয় স্বজন মালয়েশিয়ায় থাকেন এটা ঠিক, তারাই টেকনাফ এবং উখিয়ায় বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা তাদের স্বজনদের সমুদ্রপথে অবৈধভাবে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আমরা তো সবসময় পাহাড়া দিয়ে রাখতে পারি না। প্রতিনিয়তই এই ধরনার ঘটনা ঘটে। এসব লোকজন বিদেশ গিয়ে বাংলাদেশী পরিচয় দেয়। যা খুব দু:খজনক। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বলছেন,বিভিন্ন সময় উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা এবং আটক দালালদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরো অনেক তথ্য পেয়েছেন। তারা বলছেন ,পাহাড়, নদী ও সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে এসব নারী ও শিশুদের মালয়েশিয়ায় পৌঁছিয়ে দিচ্ছে মানবপাচারকারী চক্রগুলো। উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক  চৌধুরী বলেন , এই ঘটনা অনেক পুরনো। দিনে দিনে এই হার  বাড়ছেই। এসব বন্ধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী থেকে শুরু সবাই কাজ করছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সচেতনতা ছাড়া উপায় নেই। রোহিঙ্গা দেশের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশী পরিচয়ে নানান অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। পরে এর দায়ভার পরে আমাদের উপরে। কয়েকজন রোহিঙ্গা অভিযোগ করেছেন,রোহিঙ্গা নারীদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে গিয়ে সেখানে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে জোর করে বিয়ে  দেয়া হয়। তাদেরকে প্রলোভন দেখানো হয়। ফলে ক্যাম্প থেকে নারী পাচারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই।

যেকারনে মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা নারীর চাহিদা:
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়া এক লাখের উপরে রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এই তথ্যের বাইরেও আরো তথ্য বলছে, প্রায় দুইলাখেরও বেশী রোহিঙ্গা বসবাস করছে দেশটিতে। কিন্তু সেখানে রোহিঙ্গা নারীর সংখ্যা খুবই কম। ফলে মালয়েশিয়ায় বসবাসরত পুরুষ রোহিঙ্গারা বিয়ে করতে পারছে না বলে জানিয়েছে উখিয়া ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝি। তাছাড়া সেখানকার স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করতেও পারছে না তারা। ফলে সেখানে রোহিঙ্গা নারীর সংকট তৈরী হয়েছে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে দালাল চক্রের সদস্যরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে নারীদেরকে প্রলোভন দেখাচ্ছে। আর এই প্রলোভনে পড়ে তারা মালয়েশিয়ায় যেতে চায়। তবে অভিযোগ রয়েছে, এসব নারীরা বিয়ের পর সেখানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। তাদের কোনো কাজেও যেতে দেয়া হয় না। লেদা ক্যম্পের মাঝি নুর  মোহাম্মদ জানান, মালয়েশিয়ায় অনেক বাল্যবিয়ে হওয়া এমন অল্প বয়সী রোহিঙ্গা নারীদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। গৃহবন্দী হয়ে দাসত্বের মতো তাদের জীবন যাপন করতে হয় তাদের। তিনি বলেন,এক রোহিঙ্গা মেয়ে আমাকে বলে, এমন অল্পবয়সে সে বিয়ে করতে চায়নি। কিন্তু তার  কোনো উপায় ছিল না। কুতুপালং রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ জালাল আহমদ বলেন, বিষয়টি অস্বিকার করার মতো না। এই ধরনের ঘটনা অহরহর হচ্ছে। বিভিন্ন সময় অনেক ক্যাম্পে নারীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। যারা পাচারের শিকার হয়। বিশেষ করে তাদেরকে সেখানে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। যেখানে বিয়ে করার জন্য নারী সংকট রয়েছে। তবে সেখানে গিয়েও যে তারা শান্তিতে থাকে বিষয়টি এমন নয়। ওখানে গিয়েও অত্যাচারে শিকার হতে হয় তাদেরকে। এদিকে আরো খোঁজখবর নিয়ে জানাগেছে, মালয়েশিয়া শুধু নারীরাই যায় ব্যাপারটি এমন নয়। তাদের সঙ্গে যাচ্ছে পুরুষরাও। অনেকসময় নারী ও পুরষদের দুই পক্ষেরই টার্গেট মালয়েশিয়া হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়া।

পাচারের নানা কৌশল:
একসময় স্থানীয় বাংলাদেশীদের নিয়ে টার্গেট থাকলেও পাচারকারী সদস্যরা এখন টার্গেট করছে রোহিঙ্গাদের। এখন স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীন দালাল চক্রের সদস্যদের মূল টার্গেট থাকে ক্যাম্পগুলোতে। বছর খানেক আগেও নারী পুরুষ উভয় টার্গেট থাকলেও, পাচারকারী চক্রের সদস্যরা  সাম্প্রতিক সময়ে নারীদেরকেই টার্গেট করে রাখে। বিশেষ করে এসব নারীদের বিয়ের কথা বলে মালেয়শিয়ায় পাঠানোই মূল টার্গেট তাদের। পাচারকারীচক্রগুলো নতুন কৌশল এটি। এসব রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে মাসতিনেক ধরে বোঝানো হয়। তাদের পরিবারে মাসে দুই তিনবার যাওয়া হয়। প্রতিবার গিয়ে বুঝানো বা প্রলোভনের কাজটি করে রোহিঙ্গা চক্রটি। তাদের কাজই হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ম্যানেজ করা। নানান প্রলোভন দেখানো। পরে ম্যানেজ হলে এর পর দিনক্ষণ ঠিক করে, ছোট ছোট দলে ভাগ করে লোকজনকে আলাদাভাবে এনে এক জায়গায় জড়ো করা করা হয়। এর পর ছোট ছোট নৌকায় করে গভীর সাগরে পাঠানো হয়। সেখানে থেকে নিয়ে তুলে দেয়া হয় বড় জাহাজে। এই পুরো পক্রিয়াটি দালাল চক্রের কাছে প্রজেক্ট হিসেবে পরিচিত।

কুতুপালং ২ নম্বর ক্যাম্পের হেড মাঝি সিরাজুল মোস্তফা এই প্রতিবেদকে বলেন ,পাচারকারীরা খুব চালাক প্রকৃতির হয়। তারা নানান সময় নানান পন্থা অবলম্বন করে। প্রথমে তারা সাম্পান আকারের  ছোট  নৌকায় তুলে তীর থেকে লোকজনকে সাগরে নিয়ে মাছ ধরার ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা  ট্রলারে তুলে  দেয়। এসব  নৌকা সাধারণত সাগরে জাল দিয়ে মাছ ধরতে যায়। সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ অতিক্রম করে আকিয়াব উপকূলের কাছাকাছি থাকে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াগামী বড় জাহাজগুলো। মালয়েশিয়াগামী লোকজনকে পাচারকারীরা মাছ ধরার  নৌকা  থেকে বড় জাহাজে তুলে দেয়। আরো কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝির সঙ্গে কথা বলেও একই দৃশ্য ও ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। জানা যায়,আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর চোখে ফাঁকি দিতে সব ধরনের কাজই করে তারা। টেকনাফের স্থানীয়রা বলছেন,তাদের ইউনিয়নের গ্রামগুলো নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের তীরে। এই সুযোগ নিয়ে এবং অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্যে এই গ্রামগুলোর বিভিন্ন পয়েন্ট ব্যবহারের মাত্রা এখন বেড়েছে। জানাগেছে, আগে  তারা এক জায়গায় লোকজন জড়ো করতো। এখন তা করে না। এখন পাচারকারীরা দৃশ্যের পিছনে থাকে। মালয়েশিয়া থেকে রোহিঙ্গাদের স্বজনরাই সরাসরি টেলিফোনে এখানে পরিবারের সদস্যের সাথে যোগাযোগ করে তাদের গভীর রাতে কোন একটি জায়গায় থাকতে বলে। সেখানে তারা গেলে তখন দালালরা তাদের ছোট নৌকায় করে নাফ নদীর মাঝে নিয়ে বড় নৌকা উঠায়। এরপর মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছেন, নাফ নদী থেকে বঙ্গোপসাগরে ঢুকে ছেঁড়া দ্বীপ হয়ে পাচারের চেষ্টা করা হয় রোহিঙ্গাদের। এসব রোহিঙ্গাদের টেকনাফ থেকে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যেত। এখনও সেই রুট ব্যবহারের চেষ্টা করে। অনেক সময় সরাসরি মালয়েশিয়া নিয়ে যায়।

কি বলছেন পাচারে শিকার রোহিঙ্গারা:
গত বছরে ১১ ফ্রেবুয়ারীতে বঙ্গোপসাগর দিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রাকালে সেন্টমার্টিনের কাছে ট্রলারডুবিতে উদ্ধার রোহিঙ্গা নারীদের একজন আসমা বেগম। তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুশিডং জেলা থেকে ২০১৭ সালের দিকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। আসমা বলেন,আমার কয়েকজন ফোনে বিয়ে করেছি। মালয়েশিয়ায় আমাদের স্বামী রয়েছে। যার কারনে আমরা যাচ্ছিলাম। আমাদের সঙ্গে নজিবা নামে একজনের মোবাইল ফোনে বিয়ে হয়। কিন্তু সে ডুবে মারা যায়। সেও স্বামীর কাছে যাচ্ছিলো। জানাগেছে আগেও আসমা দুইবার অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছে বলে জানিয়েছে টেকনাফের  লেদা নতুন শিবিরের মাঝি আবু বক্কর। তিনি বলেন,অনেক বছর ধরেই বিদেশে থাকা  রোহিঙ্গা পাত্রের সঙ্গে মোবাইল  ফোনে বিয়ে হচ্ছে ক্যাম্পের নারীদের। বিয়ের পর স্বামীরা তাদের নেয়ার  চেষ্টা করে। সেদিনের ঘটনায় উদ্ধার আরেকজন রোহিঙ্গা নারীর নাম রজুমা আক্তার (১৯)। উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা সে। ২০১৯ সালে ৩ এপ্রিল টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়া উপকূল দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতিকালে বিজিবির হাতে আটক হয়েছিল রজুমা। তখন সে নিজেকে তাহামিনা  বেগম বলে পরিচয়  দেয়। সেসময় তার সঙ্গে আরও ২৬ জন যাত্রী ছিল। কিন্তু পরের বছর  সে আবার ধরা পরে। তার একই অবস্থা। আসমা বলেন, আমাদের ওখানে স্বামী আছে। সেখানে আমাদের যেতে হবে। ক্যাম্পে বন্দি জীবন আর ভালো লাগে না। টেকনাফ এবং উখিয়ায় দু’টি বড় ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে কথা এই প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন,অনেক রোহিঙ্গা পুরুষ মালয়েশিয়ায় আছেন,তারা বিয়ে করার জন্য আতœীয়স্বজন বা পছন্দের মেয়েকে খরচ দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এভাবে অনেক নারী মালয়েশিয়া গিয়ে সেখানে বিয়ের পর সংসার করছে। এধরণের খবর তারা জানেন। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একজন রোহিঙ্গা বলেন,এই দেশে আসার কাজকর্ম নেই। ঘরে আমি ছাড়া সবাই নারী সদস্য। তিন বোন বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু টাকার অভাবে তাদের বিয়ে দিতে পারছি না। আমাদের বিয়েতে খরচ অনেক। স্বর্ন দিতে হয় অনেক। তাদের কথা চিন্তা করে উন্নত জীবনের আশায় সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে গত বছরের জানুয়ারীতে টেকনাফ রাজারছড়া উপকূল থেকে রওনা হয়েছিলাম। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসতে হয়েছে। আমার সঙ্গে এক বড় বোনও ছিল। মালয়েশিয়া অবস্থানকারী এক মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ফলে তাকে নিয়ে সেখানে পাড়ি  দেয়ার  চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু হয়নি। উখিয় তুরকি পাহাড় ক্যাম্পের সাজেদা খাতুন নামে একজন রোহিঙ্গা নারী বলেন, এখান থেকে নারীরা অনেকে টাকার লোভে যায় আবার অনেকে বিয়ে করতে যায়। কেউ হয়তো আগের পছন্দ ছিলো কিন্তু ওর বর ওই দেশে চলে গেছে, আবার কেউ হয়তো বিয়ে করে গেছে। ফলে তারা মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী। পুরুষরাও যায় অনেকে। কেউ আবার অতিলোভে দালালের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়ার যাওয়ার চেষ্টা করে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ,আত্নীয় স্বজন যারা মালয়েশিয়া থাকেন,তারাই দালালদের সাথে যোগাযোগ এবং লেনদেনের সমস্যাগুলো মিটিয়ে থাকেন। তাদের রুট সম্পর্কে কোনো ধারণা দেয়া হয় না। কুলছুমা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারী জানান, এক মানবপাচারকারীর মাধ্যমে তিনি মালয়েশিয়ায় যেতে গিয়ে টেকনাফ ২ বিজিবির হাতে আটক হয়েছেন। দুই রাত পাহাড়, নদীর পাশাপাশি থেকেও সাগর পাড়ি দিতে পারেনি তিনি। ২৩ বছর বয়সি এ তরুণী জানান, সম্পূর্ন অচেনা এক রোহিঙ্গাকে বিয়ে করতেই তাকে মালয়েশিয়া বিয়ে দিচ্ছেন তার বাবা মা। তাদের ভাষ্যমতে জানা যায়, অনেক নারী শরণার্থী ক্যাম্প থেকে বের হয়ে হেঁটে ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়। কয়েকবার গাড়ি পরিবর্তন করে শেষমেশ মালয়েশিয়ায় ঢুকে। ৫-৬জনের সঙ্গে ছিল একজন পাচারকারী। কুলছুমা আরো বলেন,আমি শুনেছি পাচারকারীরা অনেক মেয়েদের ধর্ষণ করেছে। তাই আমি খুব ভীত ছিলাম কি করে মালয়েশিয়া পাড়ি  দেব। গত বছররের ১৩ নভেম্বর সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় আটক যাত্রীরা হামিদ নামে একজন পাচারে শিকার নারী বলেন,দালালরা আমাদেরকে এসে বুঝিয়েছে। আমার বাবা মাকে বুঝিয়েছে। বুঝিয়ে বুঝিয়ে পরিবারের সবাইকে রাজি করিয়েছে আমাদেরকে দেয়ার জন্য। আমিও রাজি ছিলাম। পরে তো যা হবার হলোই। তবে ওই নারী দালালের নাম বলতে  রাজি হননি। উদ্ধার হওয়া আরেক রোহিঙ্গা নারী সানজিদা বেগম বলেন, মালয়েশিয়ায় আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। দুই পরিবার মিলে আমাকে স্বামীর কাছে পাঠানোর জন্য ট্রলারে তুলে দিয়েছেন। আমাকে বলা হয়েছিল জাহাজে করে নেয়া হবে, কিন্তু যাওয়ার সময় গিয়ে দেখি ঝুঁকিপূর্ণ কাঠের ট্রলারে করে পাঠানো হচ্ছে।

পাচারে ব্যবহার হচ্ছে যেসব পয়েন্ট :
রোহিঙ্গাদের বিদেশ পাচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় টেকনাফ ও উখিয়ার বেশ কয়েকটি পয়েন্ট। যেসব পয়েন্টে নানান সময় মানব পাচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। দালাল ও রোহিঙ্গাদের ভাষ্যে ,এই পয়েন্টগুলোকে মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট বলা হয়। পয়েন্টগুলো পুরনো হলো কৌশল বদলে সেগুলোকে আবার নানানভাবে ব্যবহার করা হয়।

এসব পয়েন্টের মধ্যে টেকনাফের শামলাপুর,শীলখালি,রাজারছড়া,জাহাজপুরা,সবারাং,শাহপরীরদ্বীপ,কাটাবনিয়া,মিঠাপানিরছড়া,জালিয়াপালং,ইনানী,হিমছড়ি,রেজুখাল,কুতুবদিয়াড়া,খুরুশকুল,চৌফলদন্ডি,মহেশখালী।সীতাকুন্ড ও মাঝিরঘাট এলাকা হয়ে ট্রলারে মানবপাচার হয়ে থাকে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয়সহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা। তারা সবাই  টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা।

নিয়ন্ত্রন করছেন যারা:
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গা পাচারের ক্ষেত্রে টেকনাফ ও উখিয়ার বেশ কয়েকটি চক্র সরাসরি জড়িত। নানান সময় তাদের বিরুদ্ধে দুই থানায় মামলা হলেও সময় বোঝে তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। আবার সময় বোঝে গা ঢাকা দেয়। গত দুই বছর এই পর্যন্ত রোহিঙ্গা পাচারে ১৫৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এর বাইরেও রয়েছে অনেকে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে,যারা এই চক্রটি নিয়ন্ত্রন করে তাদের বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন  টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়ার শরীফ হোছন, মো. সেলিম ওরফে লম্বা সেলিম, মো.শুক্কুর ওরফে শুক্কুর মাঝি, মাঝের পাড়ার আবুল কালাম ওরফে কালাম, ডাংগরপাড়ার ফিরোজ আহমদ,সেন্ট মার্টিনের বাজার পাড়ার আব্দুর রহমান,পশ্চিমপাড়ার ফয়াজ উল্লাহ ওরফে ফয়াজু, বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকার মৌলভি আশরাফ আলী, মো. ইউনুছ মেম্বার, আয়াত উল্লাহ, আজিজুল ইসলাম পুতু, মনখালী এলাকার মো. রফিক,শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের  মৌলভি রহিম উল্লাহ, শীলখালী এলাকার মফিদুল্লাহ, নোয়াখালী এলাকার আব্দুল্লাহ। টেকনাফ উপজেলা  চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, বাংলাদেশ  থেকে সাগরপথে মানব পাচার কমে এসেছিল। কিন্তু বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যে যেভাবে পারছে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে। উখিয়া উপজেলা  চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন,রোহিঙ্গাদের কারণে মানব পাচারের বদনাম  থেকে বাংলাদেশ  বের হতে পারছে না। এর জন্য স্থানীয় ও রোহিঙ্গা চক্রের সদস্যরা সরাসরি জড়িত।
অনুসন্ধান বলছে, এসব নামের বাইরেও আরো অনেক চক্র আছে। যাদের বিষয়ে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

রোহিঙ্গা দিয়ে রোহিঙ্গা পাচার:
টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালী মধ্যমপাড়ার লাইলা  বেগম। একজন রোহিঙ্গা নারী। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ওই নারী প্রতিটি ক্যাম্পে ঘুরে সংগ্রহ করেন মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক নারীদের। লাইলা বিয়ে করেছেন ওই  গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল করিম খোকাকে। খোকা এলাকার আবদুল আলী সিন্ডিকেট নামে পরিচিত একটি মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য। এরকম আরো অসংখ্য সিন্ডিকেট রয়েছে ক্যাম্পগুলোতে।যারা নিয়মিত মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক নারীদের যোগার করে। এবং তাদের সঙ্গে দামদর করে। টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের বসবাসরত বেশ কয়েকজর রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে রোহিঙ্গারা নিজেরাই রোহিঙ্গা পাচারে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। যারা সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারে সক্রিয়ভাবে জড়িত রোহিঙ্গা দালাল চক্র। এবং নিজেদের গোত্রের বলে তাদের সহজে বিশ্বাসও করছে ভোক্তভোগীরা। তাদের সঙ্গে এই অপকর্মে স্থানীয়  অংশীদার হচ্ছে স্থানীয় চক্রটিও। এরই মধ্যে সমুদ্র  মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে  গ্রেপ্তার হয়েছে  বেশ কয়েকজন  রোহিঙ্গা দালাল। তাদের  দেয়া তথ্যে উখিয়া- টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে মানব পাচারকারী চক্রের অনেক সদস্যের নাম বেরিয়ে আসে। তাদের মধ্যে রয়েছেন- হাফেজ ছলিম, আতাত উদ্দিন,মোহাম্মদ আলম, আবদুর করিম, হাফেজ  মোহাম্মদ আইয়ুব,মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মোহাম্মদ কবির, আমির হোসেন, মোহাম্মদ ফয়েজ, নূর  হোসেন,মোহাম্মদ রশিদ, হাসিম উল্লাহ, মোহাম্মদ শাহ ও  মোহাম্মদ হামিদ। তারা সবাই উখিয়া- টেকনাফের  রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা। এছাড়াও আরো বেশ কয়েকপি চক্র সক্রিয় ওই ক্যাম্পগুলোতে। যারা নিয়মিত রোহিঙ্গা নারী সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। তাদের ব্যপারে আইনশ্খৃলাবাজিনীর সদস্যরা নিয়মিত রোহিঙ্গা বাসায় মাইকিং করলেও থেমে নেই এই চক্রটি।

সাগর পথে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা:
উত্তাল সাগরের বুক চিড়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়াটা রোহিঙ্গাদের কাছে যেন এক স্বপ্নের যাত্রা। গত বছরের এপ্রিলে করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যে উপকূলে আসা ৩৯৬ জন  রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা মালয়শিয়া যাওয়ার আশায় দুই মাস ধরে সাগরে ভাসছিলো।  উদ্ধার হওয়ারা দুই মাস আগে ৪৮২  রোহিঙ্গা মানব পাচারকারীদের প্ররোচনায় উন্নত জীবন ও বিয়ের আশায় মালয়েশিয়া রওনা হয়েছিল। কিন্তু মালয়েশিয়ার  নৌবাহিনী তাদের  সেখানে ভিড়তে না দেয়ায় তারা আবার  টেকনাফ উপকূলে ফিরে আসে। উদ্ধার  রোহিঙ্গারা সবাই উখিয়া ও  টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরের বাসিন্দা। তারা বলছেন,প্রথমে মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী, এরপর থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের নৌবাহিনীর বাঁধার মুখে তারা বাংলাদেশের উপকূলে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় একই ঘটনায় সাগরে অভুক্ত থেকে ৩২ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়ে ছিলো। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে, ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে  শুধু মাত্র এক বছরে সাগরে ডুবে দুই শতের বেশী  রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। অনেকে নিখোঁজ হয়েছে। ২০২০ সালেই এমন নির্মম পরিণতি ঘটে এসব রোহিঙ্গার ভাগ্যে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) বলছে, বাংলাদেশের আশ্রয়শিবির থেকে যারা মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বিপজ্জনক ভ্রমণ করেছে তাদের বেশিরভাগ ছিল শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্ক। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,সাগর পথে পারি দেয়া এসব রোহিঙ্গাকে মেরে সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে থাকতে পারে দালালরা। আবার অনেকে অভুক্ত হয়েও মারা যেতে পারে বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্টরা। সাগরে এসব  নৌকা বা জাহাজে  শিশুসহ অনেক  রোহিঙ্গা গাদাগাদি করে বসানো হয়। অনেক সময় তাদের ওপর চলে নির্যাতন। এই নির্যাতনেও অনেকে মারা যায়।

 রোহিঙ্গা পাচার নিয়ে বেড়েছে মামলা ও আসামী:
টেকনাফ ও উখিয়া থানায় গত তিন বছরে রোহিঙ্গা পাচার ঘটনায় ৫৩ টি মামলায় ১৪৯ জনকে আসামী করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে মামলার সংখ্যা শূণ্যের কোটায় থাকলেও পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের এই মামলার ৮ জনকে আসামী করে ২টি মামলা দায়ের হয়। ঠিক এর এক বছর পরে এই মামলা বেড়ে যায় তিনগুন। মামলা হয় ২৩ টি, আসামী করা হয় ১০৬জনকে। এর পরের বছর মানবপাচার বাড়লেও মামলার আগষ্ট মাস পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ছিলো ৩টি। আসামী ছিলো ২৩ জন।

কি বলছেন সংশ্লিষ্টরা:
কক্সবাজারের ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (পুলিশ সুপার)  হেমায়েতুল ইসলাম বলেন, আগে অনেক পাচার হতো। বিষয়টি কমে এসেছে। আমি এখানে যোগাদানের পর উল্লেখযোগ্যহারে পাচার দেখিনি। এই এলাকাটিই অপরাধপ্রবণ এলাকা। পাচার হতেই পারে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এই হার অনেক কমেছে।

উখিয়া থানার ওসি আহমেদ মঞ্জুর মোরশেদ বলেন, গত পাঁচ ছয় মাসে কোনো মানপাচারের খবর পাইনি আমরা। আমরাও চেষ্টা করছি এই ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে। তবে এই বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। কারন মানবপাচারকারী ঘাপটি মেরে বসে থাকে ।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন ,এই এলাকায় মানপাচার চক্রটি সবসময়ই সক্রিয়। তবে আমরা তা রুখে দিয়েছি। কিন্তু ওরা সুযোগের অভাবে বসে থাকে।  বিশেষ করে রোহিঙ্গারা নানান অপরাধে জড়িয়ে যায়। তারা এই কাজটি করে বেশি। কিন্তু সকল আইনশৃ্খৃলাবাহিনী বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে আমরাও করছি। এই ধরন খবর পেলে বা সন্দেহ হলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

এদিকে কক্সবাজার  জেলার পুলিশ সুপার (এসপি)  মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান  বলেন, এখানে নিয়মিত মামলা রজু হয়। আমরা কমিউনিটি ও বিট পুলিশিং করে থাকি। কারা এসব পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে আমরা আইনের আওয়তায় নিয়ে আসি। শুধু তাই নয় কেউ যদি জামিনে বের হয়ে আসে তার পরেও আমরা তাদের নজরদারি করে থাকি। তবে এই ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন  কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামসুদ্দৌজা নয়নের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে  নিয়মিত কথা বলি, মিটিং করি কিভাবে  সেটা কমানো যায়। তাছাড়া তাদেরকে নিয়ে জনসেচতনতামূলক অনেক কাজ করে থাকি। রোহিঙ্গাদের ভাষায় মাইকিং করা হয়, যাতে তারা কোনোভাবেই ফাঁদে না পড়ে। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতা তো আছেই।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি রিসার্চ মুভমেন্ট ইউনিট (রামরু’র)প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনীম সিদ্দিকী বলছিলেন,অনিশ্চয়তা থেকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়া প্রবণতা বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এই সংকটটা আমরা সেভাবে একটা লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারছিনা। তখন রোহিঙ্গা ভাল কিছুর আশায় মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছে।
কক্সবাজার -৪ (টেকনাফ ও উখিয়া) আসনের সংসদ সদস্য শাহিনা আক্তার বলেন, মানপাচার একসময় হতো। এখন আর তেমন একটা হয় না। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কঠোর হস্তে তা দমন করেছে। স্থানীয় ও রোহিঙ্গা চক্রদের নজরদারির মধ্যে রেখেছে। -সূত্র মানবজমিন


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন