(প্রথম পর্ব)
[ব্যক্তিগত ব্যাখ্যাঃ এ ধরণের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লেখার কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা আমার নেই। তাই লেখাটির কোনো কোনো অংশে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের সংযুক্তি ঘটানো হয়েছে মনে হতে পারে – কারো কারো কাছে। আমি অবশ্য তা সচেতনভাবেই করেছি। আমি চেয়েছি ভ্রমণ অভিজ্ঞতার সাথে ভ্রমণের উদ্দেশ্যটিরও উল্লেখ থাকুক। ভাঙ্গা শরীর-স্বাস্থ্য নিয়েও ভ্রমণটিকে কেন আমি আবশ্যক মনে করেছিলাম তার উল্লেখ রাখাটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।]
গত দুই দশকে যতোবার দেশে ফিরে গিয়েছি, প্রতিবারই টিকেট কিনেছি একজনের কাছ থেকে – ধরুন “অনুপম ট্র্যাভেলস” থেকে। এর মালিকের কল্পিত নাম মোমিন সাহেব। তিনি আমার একজন বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি। ভ্রমণ রুট নির্ধারন করা এবং এয়ারলাইন্স পছন্দ করার বিষয়টি আমি তাঁর উপরেই ছেড়ে দেই। টিকেটের মূল্য নিয়েও আমি কথা তুলি না। তিনি ইনভয়েসে যা লিখে দেন, আমি তা-ই দিয়ে দেই। আমার সব সময় বিশ্বাস থাকে যে তিনি আমাকে বেস্ট ডিলটিই (Best Deal) দিচ্ছেন। ‘বিশ্বাসে পাবি রে তারে, তর্কে বহুদূর’!
আগে কোনোভাবে শরীরকে টেনে নিয়ে কিছুটা চলতে ফিরতে পারলেও গত ৪ বছর ধরে আমি সত্যিই একজন পঙ্গু মানুষ। দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েও শেষ করা যাবে না কতোটা বিকলতা আমাকে পেয়ে বসেছে। দুই পা তো অনেক আগে থেকেই অবশ; এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বাম হাঁটুর ব্যাথা। মরণের ভার চরণে সয় না! পায়ে ভর দিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সামান্য ওজনের কোনো জিনিসও আমি বেশিক্ষণ উপরে তুলে ধরতে রাখতে পারি না। এমন নাজুক শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো সঙ্গী ছাড়া আর কেউ মন্ট্রিয়ল-ঢাকা আসা-যাওয়া করতে সাহস করবেন না বারে বারে। মোমিন সাহেবের প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস! তিনি আমার শরীরের অবস্থাটি ভালো করেই জানেন। নিশ্চয়ই তিনি আমাকে সবচেয়ে সুবিধার ফ্লাইটিই দেবেন! বরাবরই তিনি আমার জন্য ভ্রমণকালে হুইল চেয়ার সুবিধা চেয়ে থাকেন এবং টিকেটে তার উল্লেখও থাকে।
আর ও খবরঃ অটোয়ায় ১৭ মার্চকে বঙ্গবন্ধু দিবস ঘোষণা
গত কয়েক বছর আমাকে ঘন ঘন দেশে যেতে হয়েছে। দেশকে প্রতি মুহুর্তে মিস করি – সে এক মহাসত্য – তাছাড়া কয়েকটি নির্দিষ্ট কাজও ছিলো যা দ্রুত সম্পাদন করা আমি কর্তব্য মনে করেছি। শরীরের যা অবস্থা! পরে যদি আর সুযোগ না পাই! এই আসা যাওয়ার সময় প্রতিবারই শরীরের উপর নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে আর মনে হয়েছে আমি এরপর আর আসতে পারবো না কানাডা থেকে। তাই যে কাজগুলির কথা ভেবেছিলাম সেগুলি দ্রুত করার ব্যাপারে আমি এক প্রকার মরিয়া হয়ে উঠি। কারণ, এগুলি এমন কাজ যা অন্যের উপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে হয় না। যারা এসব কাজে অংশ নেন তাঁদেরকে হতে হয় প্রকৃত দেশপ্রেমিক। সপ্রণোদিত হয়ে কাজ করার দায়িত্ববোধে সজাগ থাকতে হয়। আত্মপ্রচারের লোভকে সংযত রাখতে হয়। নিজে করতে পারলাম না বলে অন্যের কীর্তি দেখে হিংসায় কাতর হলে চলে না। তবে এসব মানুষের প্রচণ্ড খড়া চলছে এখন আমাদের সমাজে। এই খড়া প্রায় প্রতিটি পরিবারেই; নিশ্চয়ই আমার স্বজনদের মাঝেও।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি যে ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে তা কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন? ক্রমেই আমরা আবেগহারা হয়ে যাচ্ছি দেশপ্রেম ও মুক্তিযদ্ধের বিষয়ে। নতুনদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি যেন ‘ইতিহাসের কোনো এক সময়কার একটি বড়ো ঘটনা’ মাত্র। আমরা ছুটে চলেছি আত্মপ্রতিষ্ঠার এক আবেগহীন নগ্নপথের যাত্রী হয়ে। কী আশ্চর্য রকমের স্ববিরোধিতা আমাদের মাঝে!
বিগত এক দশকের শাসনকালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে প্রচুর কথা বলা – মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য নানাবিধ স্থাপনা নির্মান – মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক লাইব্রেরী এবং জাদুঘরসমুহের শ্রীবর্ধন এবং মুক্তিযুদ্ধের নামে হাজার হাজার সমিতি ও প্রতিষ্ঠানের মহামারি সত্ত্বেও দেশবাসীর হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধেকালের সেই অবিস্মরণীয় আবেগের সতস্ফুর্ততা তেমন আর অনুভূত হয় না। দেশপ্রেমের এমন একটি ভোঁতা পরিবেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসংরক্ষণ ও দেশপ্রেমের আবেগকে পুনরায় জাগিয়ে তোলা সহজ কাজ নয়। অনেকেই হয়তো ভালো কাজটি হোক তা চান; কিন্তু ব্যক্তিজীবনের সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠে ভালো কাজে নেতৃত্ব দেয়ার সামর্থ রাখেন না। তবে কেউ উদ্যোগ নিলে সহযোগিতা করতে পিছপা হন না। তাই কাজটি করার উদ্যোগ আমাকেই নিতে হয়েছিলো। —— চলবে …।
লেখকঃ সভাপতি ভিএজি,বি, মন্ট্রিয়ল, কানাডা
