মুক্তিযুদ্ধ

যুদ্ধের স্মৃতি কথা | সুশীল কুমার পোদ্দার

যুদ্ধের স্মৃতি কথা

যুদ্ধের স্মৃতি কথা | সুশীল কুমার পোদ্দার

১৯৭১। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টু তে উত্তীর্ণ হয়েছি। জীবনের জটিলতা বুঝি না। তবে এটা বুঝি জীবন আর আগের ছন্দে চলছে না। বাবা, দোকান থেকে ফিরে এসে আর আগের মতো আমাদের কাছে ডাকেন না। জিজ্ঞেস করেন না আমাদের পড়ালেখা কেমন চলছে, স্কুল কেমন চলছে। মার সাথে নিভৃতে কি যেন বিষয় নিয়ে উদ্বেগের সাথে কথা বলে যান। একদিন বিকেলে আমাদের বাসায় ক’জন মিস্ত্রী আসে। ওরা আমাদের পিয়ারা তলায় মাটি গর্ত করে বিরাট আকারের এক সুরঙ্গ তৈরি করে। উপর থেকে টিন দিয়ে ঘাস দিয়ে ঢেকে দেয়। পরে বুঝতে পেরেছি ওটা বাঙ্কার। সম্ভাব্য বোমা বর্ষণের হাত থেকে বাঁচার একটা নিরাপদ আশ্রয়। আমাদের তো আনন্দের সীমা নেই। ভাই বোন মিলে অন্য এক খেলায় মেতে উঠি। স্কুলে যাই। ক্লাসে অনেকেই নেই, অনেক বন্ধু নেই। ওদের অভাবে মনটা শূন্যতায় ভরে যায়।

একদিন অনেকের মতো আমাদেরও শহর ছাড়ার সময় আসে। শহর থেকে অনতিদূরে গারোদহ নামে এক গ্রামে, এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাড়ি। যাবার আগের রাত্রে মা-বাবা ঘরের এখানে সেখানে গর্ত করে মূল্যবান তৈজস পত্র গুলো সমাধিস্থ করলেন।আমাদের সাথে সাথী হোল আমাদের গাভী ধবলী। আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় আমাদের পরম সমাদরে গ্রহণ করলেন। বিশাল বড় জমিদার বাড়ি। বাড়ির সামনে সিংহদ্বার। বাড়ির কর্তার গায়ে এখনও সেই প্রাচীন আভিজাত্য। যতদূর চোখ যায় তার জমি। মানুষ তাকে অত্যন্ত সন্মান করেন। উনি গ্রামের মানুষদের বিনামূল্যে হৈমিওপাথী চিকিৎসা দেন। খুব অল্প সময়ে আমরা এক পরিবারের মতো হোয়ে যাই। কেউ আর পড়ালেখার কথা বলেনা। আমি নতুন সম্পর্কের দুভাইয়ের সাথে টোটো করে ঘুরে বেড়াই সবুজ প্রকৃতির মাঝে।

একদিন বাবা শহর থেকে খালি হাতে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ফিরে এলেন। শহরে নাকি হঠাত করে মিলিটারি এসেছে। অসংখ্য বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, অকাতরে করেছে মানুষ হত্যা। বাবার চেহারাতে উদ্বিগ্নতা। উনি চান না আমরা এখানে থাকি। যে কোন সময় মিলিটারি নাকি চলে আসতে পারে। যে কোন সময় পালাতে হতে পারে।মা অনেক গুলো পুটুলি বাঁধলেন – যেন মিলিটারি এলেই আমরা ওগুলো নিয়ে পালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু ধবলীর কি হবে? বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন ধবলীকে বিক্রি করে দিতে হবে। মা চোখের জল ফেললেন। আমরা ধবলীর জন্য আম কাঁঠালের পাতা নিয়ে আসলাম। খৈল, ভুষি, সবুজ ঘাস দিয়ে ওকে কদিন যাবত খুব সমাদর করা হোল। মা খাবার পর শাড়ী দিয়ে পরম যত্নে ওর মুখ মুছে দেয় নিজের সন্তানের মতো। ধবলী মার ঘাড়ে মাথা রাখে। ওর চোখ জল ভেজা। ও কি বুঝতে পেরেছে ওর অগস্থ যাত্রার কথা? বাবা চোখ ভরা জল নিয়ে ওকে নিয়ে চললেন হাট পাঙ্গাসীর হাটে। মা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে কেঁদে চলেছেন। আমরা বাবার পিছু পিছু, ধবলীর পিছু পিছু অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম। অপরাহ্ণে বাবা হাট থেকে ফিরে এলেন। খুব একটা ভালো দাম পেয়েছেন। কিন্তু বাবার মুখের দিকে তাকান যায়না। একটা গভীর বেদনা ক্ষত তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেদিন আমাদের ঘরে
উনুনে আগুন জ্বললো না। ধবলীর শূন্যতা পুরো সংসার কে বিষণ্ণতায় ডুবিয়ে দিলো।

মার মুখে হাসি ফোটানর জন্য অনেক চেষ্টা করে যাই। কিন্ত কিছুতেই কিছু হয় না। ধবলী চলে গেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক হোল। একদিন দুপুর বেলায় একজন দৌড়ে এসে খবর দিলো ধবলী ফিরে এসেছে। আমরা সবাই ত্রস্ত হোয়ে বেড় হোয়ে আসলেম। হ্যাঁ সত্যি ধবলী ফিরে এসেছে। ও বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হাম্বা হাম্বা ডেকে চলেছে। বাবা-মা ওকে জড়িয়ে ধরলেন। শ্বশুরবাড়ীর অত্যাচার সইতে না পেরে পালিয়ে আসা মেয়ের মতো ওকে অনেক বুঝালেন। ধবলী বাবার কাঁধে মাথাটা রেখে চোখ বুজে রয়েছে। ওর গভীর কালো চোখের চারপাশ আদ্র হোয়ে আছে অনেক দিনের চোখের জলে।

 

সুশীল কুমার পোদ্দার ,  ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 

সিএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন