মুক্তিযুদ্ধ

রাজাকারের বিতর্কিত তালিকা! ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধারা চান জড়িতদের শাস্তি বিচার বিভাগীয় তদন্ত চায় নির্মূল কমিটি

ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধারা

ভুলে ভরা রাজাকারের তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধারা। তারা বলেছেন, ভুলে ভরা রাজাকারের তালিকা স্থগিত করার পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। কিন্তু বিতর্কিত তালিকা তৈরি করে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। এ ছাড়া একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু গতকাল বৃহস্পতিবার নিজের চেম্বারে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, যারা এ বিতর্কিত তালিকা তৈরির জন্য দায়ী,

তাদের খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। বিতর্কিত এই তালিকা স্থগিতে যথাযথ ভূমিকার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। এ সময় উপস্থিত প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় হচ্ছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারসহ আপামর জনগণের পবিত্র আমানত। কিন্তু রাজাকারের তালিকা তৈরিতে যথাযথ পদ্ধতি ও পন্থা অবলম্বনে ব্যর্থ হয়েছে এ মন্ত্রণালয়।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্তির ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি সঠিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রাজাকারসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের সংশোধিত তালিকা প্রকাশেররও দাবি জানানো হয়েছে।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, বিভাগীয় তদন্ত হবে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু আমরা কোনো প্রশাসনিক তদন্ত চাই না; বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে তার সুপারিশের ভিত্তিতে দায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে এ তদন্ত কমিশন হতে হবে।

তিনি বলেন, তালিকায় অজ্ঞানতাবশত কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতাবিরোধীর নাম বাদ পড়তে পারে। কিন্তু রাজাকারের তালিকায় কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ পরিবারের কারও নাম যুক্ত হওয়া শুধু ভুল নয়; গুরুতর অপরাধ। এটা শুধু নির্দিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার অপমান নয়; ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক গোটা জাতির অপমান, যা বিজয়ের মাসেই ঘটেছে।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার বাইরে থাকলে সিভিল সোসাইটিকে কাছে টানেন, আর ক্ষমতায় গেলে আমলানির্ভর হয়ে পড়েন। এই আমলানির্ভরতার কারণেই রাজাকার তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তির ঘটনা ঘটেছে।

স্বাধীনতার পর থেকে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত কয়েকটি বই তুলে ধরে মুনতাসীর মামুন বলেন, বিভিন্ন গ্রন্থে কয়েক হাজার রাজাকারের নাম রয়েছে। তার পরও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ত্রুটিপূর্ণ একটি তালিকা কীভাবে প্রকাশ করল, সেটা রহস্যজনক। এ অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার না হলে এ রকম ঘটনার পূনরাবৃত্তি হবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করে মুনতাসীর মামুন বলেন, এই মন্ত্রণালয়েই এর আগে সোনার ক্রেস্ট কেলেঙ্কারি, সনদ জালিয়াতিসহ নানা ধরনের অপকর্ম হয়েছে। তার একটিরও বিচার হয়নি। আর এবারের কেলেঙ্কারি তো সব ছাড়িয়ে গেছে।

শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, প্রশাসনের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ স্বাধীনতাবিরোধী, জামায়াত-শিবির চক্র সক্রিয়। এদের চিহ্নিত করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে তাদের মন ভেঙে দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে তিনি সংশ্নিষ্টদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও দাবি জানানন।

গোলাম আরিফ টিপুর মেয়ে ডানা নাজলী বলেন, রাজাকারের তালিকার মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের ব্যাপক অবহেলা ও সমন্বয়হীনতা ছিল। প্রশাসনের ভেতরে অপশক্তি সক্রিয় ছিল এবং আছে। এ অপশক্তিকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতা লতিফ মির্জার মেয়ে সেলিনা মির্জা মুক্তি বলেন, আমার বাবা ছিলেন ওই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক, আওয়ামী লীগের জেলার শীর্ষ নেতা, দুইবারের সংসদ সদস্য। তার নেতৃত্বে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। এমন একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম কী করে রাজাকারের তালিকায় যায়! যারা এ ধরনের ‘পাপ কাজ’ করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।

মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের মেয়ে জুলফিয়া বেগম বুলু বলেন, রাজাকারের তালিকা প্রকাশের পর বাবার নাম ওই তালিকায় দেখে আমরা কেউ ঘুমাতে পারছি না। মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। বঙ্গবন্ধু আমাদের বাড়ি যেতেন। আমার বাবাকে মন্ত্রীসহ বড় বড় পদে বসানোর প্রস্তাব দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। এ রকম একজন নির্লোভ মানুষকে রাজাকারের তালিকায় যারা নাম লিখিয়েছে, আমরা তাদের বিচার চাই।

বরিশাল ব্যুরো জানায়, স্থগিত হওয়া রাজাকারের তালিকা বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) বরিশাল জেলা। তারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হকের পদত্যাগ দাবি করেছেন। গতকাল দুপুরে দলটির বরিশাল কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় উভয়ে স্বীকার করেছে- কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করে রাজাকারের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যারা এ ধরনের দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাসদের জেলা সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবার হওয়া সত্ত্বেও তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তপন চক্রবর্তী ও ঠাকুরমা শহীদজায়া উষা রানী চক্রবর্তীকে রাজাকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

মনীষা চক্রবর্তী বলেন, বিতর্কিত তালিকাটি বাতিল না করে স্থগিত করা মুক্তিযোদ্ধাদের আরও একবার হেয় প্রতিপন্ন করা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উচিত এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া। রাজাকারের তালিকা প্রস্তুতে বরাদ্দকৃত ৬০ কোটি টাকা কোথায়, কীভাবে খরচ করা হয়েছে, তার শ্বেতপত্রও প্রকাশের দাবি জানান তিনি।

একই দাবিতে গতকাল বিকেলে নগরীর অশ্বিনী কুমার হলের সামনে মানববন্ধন করেছে বরিশালের ২৭টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের জোট সাংস্কৃতিক সমন্বয় পরিষদ। পরিষদের সভাপতি কাজল ঘোষের সভাপতিত্বে এতে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।looking-for-a-job

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

14 + six =