Uncategorized দেশের সংবাদ ফিচার্ড

দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদনে, সরেজমিন: শাল্লায় যা ঘটেছিল

দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদনে, সরেজমিন: শাল্লায় যা ঘটেছিল

দ্বোহা চৌধুরী, শাল্লা থেকে ফিরে/২৩ মার্চ ।মেয়ের বিয়ের জন্য সোনাদানা-টাকাপয়সা সব ভাইঙা নিছে। দুই মেয়ের কামাইয়ে সম্পদ করছিলাম, আমার স্বামী কাজ করতে পারে না। এখন কী কইরা যে বাচাইমু এরারে।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের ৫৫ বছরের ঝর্ণা রাণী দাশ।

মহামারি শুরু হওয়ার পর গত এপ্রিলে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করা দুই মেয়েকে নিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। এক মেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।

এর মধ্যেই গত ১৭ এপ্রিল ফেসবুকে একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের সমর্থক স্থানীয়রা হামলা-ভাংচুর ও লুটপাট চালায় হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটিতে। হামলার শিকার ঝর্ণা রাণী দাশ এখন ভীত-শঙ্কিত।

ধরে আসা গলায় তিনি বলেন, ‘একটুর জন্য পলাইয়া জানে বাঁচছি। মেয়েরারে মামার বাড়িত পাঠাই দিছি, সাহস করতে পারতেছি না আনার। তারারও আসার সাহস নেই। ভয় রইছে, কোনসময় যে আরেকবার…।’

শুধু ঝর্ণা নয়, একইভাবে সর্বস্ব হারিয়েছেন গ্রামের মোট ৯০টি পরিবার। হামলায় ভেঙেছে তাদের ঘর-আসবাব, হারিয়েছেন মূল্যবান সম্পদ-টাকাপয়সা। এখন একটাই চাওয়া—নিরাপদে থাকা।

কনক রানী দাশ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এখন নিরাপদ আছি, কিন্তু ঠাকুর জানে এরপরে… নিরাপদ তো থাকতে চাই।’

এ ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় মূল আসামি নাচনি গ্রামের বাসিন্দা ও সরমঙ্গল ইউনিয়নের মেম্বার শহীদুল ইসলাম স্বাধীনসহ ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রামের নিরাপত্তায় দুটি পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন শাল্লা থানার ওসি নাজমুল হক।

শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামটি পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলার এক প্রান্তে। গত ১৫ মার্চ দিরাইতে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরী এবং যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক।

পরদিন ১৬ মার্চ নোয়াগাঁওয়ের যুবক ঝুমন দাশ আপন মামুনুল হককে সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিলে নোয়াগাঁওয়ের পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলার কাশীপুর, নাচনি, চন্ডীপুর, সন্তোষপুর গ্রামের হেফাজতে ইসলাম সমর্থকদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়।

সেই রাতেই গ্রামগুলোর মসজিদ-মক্তব থেকে মাইকিং করে স্থানীয় ধারাইন বাজারে সমবেত হয় কয়েক হাজার মানুষ।

নাচনি গ্রামের মনফুল বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘রাতে এশার সময় মাদ্রাসায়-মসজিদে মাইকিং করা হইছে—‘“আমরা ইসলামে বাধ্য, ইসলামরে ধ্বংস করিলাইছে, আমরা মিছিল দিমু।” পরে মিছিল দিলো।’

তিনি বলেন, ‘সকাল ৭টার দিকে আবার দেখি মানুষ জড়ো হইছে, এরা মিছিল দিয়া আমরার মসজিদে মাইকিং করছে, এরপর এলাকার ছেলে-বাচ্চা-পুরুষ যারা ছিল সবাই গেছে। মাদ্রাসায়ও মাইকিং হইছে যে মিছিল নিয়ে শাল্লা যাবো। পরে শুনি নোয়াগাঁওয়ে হামলা দিছে।’

হামলার আগের জমায়েত পূর্বঘোষিত

১৭ মার্চ সকালে নোয়াগাঁওয়ের পাশের ধারাইন বাজারে জড়ো হওয়া কয়েক হাজার মানুষের একটি অংশ গ্রামের বিপরীত দিক দিয়ে গিয়ে হামলা চালায় বলে পুলিশ-প্রশাসন ও গ্রামবাসীরা জানান।

কিন্তু সকালের এই সমাবেশ পূর্বনির্ধারিত ছিল বলে স্থানীয় ব্যক্তি ও প্রশাসনের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছে দ্য ডেইলি স্টার।

নোয়াগাঁওয়ের প্রবীণ বাসিন্দা হরিপদ দাস বলেন, ‘রাতেই হামলা হতো। কিন্তু জমায়েতকে তখন থামাইছি আমরা। তারা বলছিল সকালে আসবে, পরে সকালে এই অবস্থা। সবাই বলছিল বাঁচতে চাইলে ঝুমনকে ধরে থানায় দিতে। লোক লাগিয়ে তাকে ধরে থানায় দিয়েছি আমরা। তারপরও হামলা হয়েছে।’

শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-মুক্তাদির হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আগের রাতভর সংক্ষুব্ধদের বোঝানো হয়েছে এবং উপজেলা চেয়ারম্যান তাদের বোঝাতে সক্ষম হন। তারা তখন উনাকে বলে যে পরদিন তারা মিছিল নিয়ে উপজেলা সদরে যাবে। এটাই কথা ছিল। তবে হামলাটি পরিকল্পিত না, বরং অতর্কিত।’

আশ্বস্ত ছিলেন সবাই

ঝুমন দাশের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা হতে পারে বলে গ্রামের মানুষরা আশঙ্কা করছিলেন আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই। সন্ধ্যায় স্থানীয় বাজারে জমায়েত থেকে ঝুমন দাশকে আটক করলে হামলা হবে না বলে গ্রামের মানুষকে জানান স্থানীয় মেম্বার বিশ্বরূপ দাশসহ অন্যরা।

সে রাত ৯টার দিকে ঝুমনকে শাঁসখাই বাজার থেকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন তারই গ্রামের মানুষেরা। তারপর এলাকাবাসীতে আশ্বস্ত করেন শাল্লা উপজেলা চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ।

ঝুমনের স্ত্রী সুইটি চন্দ্র দাশ বলেন, ‘রাতে মাইকিংয়ের পর সবাই বলছিল যে উপজেলা চেয়ারম্যান যেহেতু আসছেন, আর কোনো সমস্যা নেই। তারপরেও হামলা হবে আমরা ভাবতে পারিনি।’

একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা জগত চন্দ্র দাশ বলেন, ‘চেয়ারম্যান বলছে কিছু হবে না, তো পুলিশ পাঠাইলো না? সকালে আসছে পুলিশ। হামলা হইছে। দোষ করছে একজন, তারে ধরে দিছি, তাইলে কেন আক্রমণ? থানা-প্রশাসনরে জানাইছি, তারা কী করল?’

আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাশ বলেন, ‘ঝুমনকে আটকাইলাম, চেয়ারম্যানরে [ইউনিয়ন] জানাইলাম, ওসিরে জানাইলাম, তারা গ্রেপ্তার করে নিলো। উপজেলা চেয়ারম্যানরে জানাইলাম, তিনি এসে বললেন আপনারা বাড়িঘরে থাকেন, সমস্যা নাই।’

এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, রাতে ১১টা-সাড়ে ১১টার দিকে খবর পাই, তৎক্ষণাৎ আমি পার্শ্ববর্তী কাশীপুর গ্রামে এসে মানুষজনকে শান্ত করি। তারা আশ্বস্ত করে যে যেহেতু ঝুমন যেহেতু আটক, আর কিছু হবে না। তারপর আমরা চলে যাই। সকালে ৯টার সময় শুনি লোকজন আবার জড়ো হয়েছে।’

সামলাতে পারেনি প্রশাসন-পুলিশ

শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও বিচ্ছিন্ন একটি গ্রাম। আশপাশের সবগুলো গ্রামই অনেকটা দূরে এবং দিরাই উপজেলার নাচনি গ্রামসহ সবকটি গ্রামের সংযোগের মধ্যেই রয়েছে ধারাইন নদী এবং সেই নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে ধারাইন বাজার।

হামলার আগের রাতে শাল্লা উপজেলা চেয়ারম্যান, হাবিবপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল ও মেম্বার বিশ্বরূপ দাশ এবং দিরাইয়ের সরমঙ্গল ইউনিয়নের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন বলে স্থানীয়রা জানান।

কিন্তু পরদিন [১৭ মার্চ] জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে পুলিশ-প্রশাসনের সবাই ব্যস্ত থাকার মধ্যেই কাশীপুর-নাচনিসহ কয়েকটি গ্রামের মসজিদে-মক্তবে মাইকিং করে ধারাইন বাজারে জড়ো হয় কয়েক হাজার মানুষ।

গ্রামের বাসিন্দা লিটন চন্দ্র দাশ বলেন, সকালে আশেপাশের কয়েকটা গ্রামের মসজিদে মাইকিং হচ্ছিল একত্রিত হওয়ার জন্য। আমরা ভেবেছি তারা মিছিল করে থানার দিকে যাবে, কিন্তু আমাদের গ্রামে আসবে তা কল্পনাও করিনি। মাইকিংয়ের পর পাঁচ-ছয় হাজার মানুষ ধারাইন বাজারে জড়ো হয়, তারপর তারা আমাদের গ্রামের দিকেই এগোতে থাকে। তখন আমাদের গ্রামের মানুষ প্রায় সবাই পালিয়ে যায়।’

শাল্লা থানার ওসি নাজমুল হক বলেন, ‘আগের রাতে এলাকাবাসীর আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়েছিলাম আমরা। তারপরও রাতের বেলা এলাকায় পুলিশের টহল ছিল। সকালে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেওয়ার সময় ধারাইন বাজারে জমায়েত হয়েছে শুনে দ্রুত আমরা ঘটনাস্থলে আসি। কিন্তু দুর্গম এলাকা হওয়ায় আমাদের আসতে প্রায় ৪০ মিনিট লেগে যায়।’

তিনি বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর সহযোগিতায় মূল জমায়েতকে নদী পার হয়ে গ্রামে ঢোকা থেকে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হই। কিন্তু তখন গ্রামের অন্য পাশ থেকে কয়েকশ লোক হামলা চালায়। তারা আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে না থাকায় বুঝতে পারিনি।’

শাল্লার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-মুক্তাদির হোসেন বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, জনপ্রতিনিধিদের যখন মানুষ কথা দেন, তখন আমরা আশ্বস্ত হই। তাই উপজেলা চেয়ারম্যান আমাদের আশ্বস্ত করলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকি।’

হামলাটি অপরিকল্পিত এবং অতর্কিত হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সকালবেলা ধারাইন বাজারের জমায়েত হয়েছে এবং তারা শাল্লা সদরে আসবে শুনে বঙ্গবন্ধু জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান থেকে আমি, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ পুলিশ নিজেরাই এলাকায় চলে আসি তাদের সদরে যাওয়া থামাতে।’

তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান যখন পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছেন, তখন গ্রামের অন্য পাশ দিয়ে কিছু লোক ঢুকে হামলা চালিয়ে সেদিক দিয়েই পালিয়ে যায়। বিষয়টি জানতে পেরে আমি দ্রুত নদী পার হয়ে গ্রামে ঢুকি। তারপর আবার ধারাইন বাজারে ফিরে সেখানকার জমায়েতকে শান্ত করে ফিরিয়ে দেই।’

হামলায় আহত ঝুমনের স্ত্রী

নোয়াগাঁওয়ে হামলার সময় কেউ আহত হয়েছেন বলে প্রশাসনিকভাবে কোনো তথ্য না থাকলেও ঝুমন দাশ আপনের স্ত্রী সুইটি চন্দ্র দাশ আহত হয়েছেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘হামলার সময় তারা ভাংচুর করে করে যাওয়ার সময় আমি ছয় মাসের সন্তান নিয়ে খাটের নিচে লুকিয়েছি, ছোট ননদকেও লুকিয়ে রেখেছিলাম। তখন তারা আমাকে দেখে ফেলে খাটের নিচ থেকে বের হওয়ার জন্য হুমকি দেয়। আমি বের হলে একজন লাঠি দিয়ে আমার মাথায় বাড়ি দেয়ার চেষ্টা করলে হাতে আঘাত লাগে। পরে আমার গলায় ছুরি ধরে সোনাদানা, টাকা-দলিল সব নিয়ে যায়।’

সুইটি বলেন, ‘তারা বারবার বলছিল – ‘মালাউনের বাচ্চারা তোরারে আইজকা শেষ কইরা যাইতাম।’ আরেকজন বলে— ‘“মালাউনরারে, তোরারে আইজকা সুযোগে পাইছি।” আমার ছোট বাচ্চাটারে আমার মনে হইছিলো আমি শেষবারের মতো বিদায় দিয়ে দিছি।’

মুক্তিযোদ্ধারা নির্যাতিত-অপমানিত

নোয়াগাঁও গ্রামে হামলার সময় ওই গ্রামের ছয় জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সবার বাড়িতে হামলা হয় এবং সেসময় বাড়িতে অবস্থান করা মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন-অপমান করে হামলাকারীরা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাশ বলেন, কয়েক শ মানুষ নদী পাড় হয়ে গ্রামের দিতে আসছে দেখে বাড়ির সবাইকে পালাতে বলে আমি মুজিবকোট গায়ে দিয়ে বাড়িতেই থাকি। আমি মুক্তিযোদ্ধা জেনেও তারা শাবল দিয়ে দরজা ভেঙে ঢুকে, আমার গলায় ছুরি ধরে চাবি নিয়ে ট্রাঙ্ক খুলে সব নিয়ে যায়। তারা আমাকেও মারতে উদ্যত হয়।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা জগত চন্দ্র দাশ বলেন, ‘এখন আর শান্তি দিয়ে কী হবে? আমাদেরকে তো অশান্তি দিয়েই গেছে, অপমান করেছে। এর চেয়ে মরণ ভালো।’

প্রথম হামলা হয় ধারাইন বাজারের মন্দিরে

নোয়াগাঁওয়ে হামলার আগে স্থানীয় ধারাইন বাজারে হেফাজতে ইসলাম সমর্থকরা প্রথম হামলা চালায় বাজারের একপ্রান্তে অবস্থিত কালী মন্দিরে।

ধারাইন বাজারের স্থানীয় অধীর চক্রবর্তী বলেন, ‘সকালে গ্রামে হামলার আগে ধারাইন বাজারে সমবেত মানুষ প্রথম হামলা চালায় বাজারের পার্শ্ববর্তী কালী মন্দিরে। তারা স্লোগান দিয়ে কালী প্রতিমা ভাংচুর করে।’

তিনি বলেন, ‘অন্য কোনো কারণে নয়, মূলত হিন্দুদের উপর হামলার উদ্দেশ্যেই তারা সমবেত হয়েছিল এবং গ্রামে হামলার আগে বাজারের মন্দিরে হামলাই তা প্রমাণ করে।’

হামলা হয় সাতটি মন্দিরে, চুরি হয় কষ্টিপাথরের মূর্তি

কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট হয়নি, বরং গ্রামের চন্ডিমণ্ডপসহ সাতটি মন্দিরেও হামলা ও লুটপাট করে হামলাকারীরা।

এ সময় তারা গ্রামের বিষ্ণু মন্দির থেকে প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন কষ্টিপাথরের একটি বিষ্ণু মূর্তি লুট করে নিয়ে যায় বলে জানান গ্রামের পুরোহিত অসীম চক্রবর্তী।

তিনি বলেন, ‘এই মূর্তিটি ১৪ পুরুষ ধরে আমাদের পরিবারে আছে এবং এই মন্দিরেই থাকত। হামলার সময় প্রাণ বাঁচাতে আমি আমার ছেলেসহ ঘরের ভিতরে ঢুকে যাই। ঘরে হামলা হলে পিছনের দরজা দিয়ে পালাই। ফিরে এসে দেখি মন্দির তছনছ করা এবং কষ্টিপাথরের মূর্তি নেই।’

হামলা জলমহালের কারণে নয়

নোয়াগাঁওয়ে হামলার পর হামলাকারী হিসেবে পার্শ্ববর্তী নাচনি গ্রামের বাসিন্দা ও সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শহীদুল ইসলাম স্বাধীন ও তার সহযোগী পক্কন মিয়ার নাম আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের পাশের কুচাখাই বিল নিয়ে তাদের ও নোয়াগাঁওয়ের বাসিন্দাদের দ্বন্দ্বের কথা আলোচনায় আসে।

জানা যায়, ওই বিলের ইজারাদার স্বাধীন গত জানুয়ারির দিকে বিলে বাঁধ দিয়ে পানি সেঁচে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিলে উপজেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেন গ্রামের বাসিন্দা হরিপদ দাশ।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ জানুয়ারি অভিযান চালিয়ে পানি সেঁচের যন্ত্র জব্দ করে বাঁধ কেটে দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে স্বাধীন ও তার সহযোগীরা গ্রামে ব্যক্তিস্বার্থে হামলা চালিয়েছেন বলেও জানান স্থানীয়দের অনেকেই।

তবে দ্বন্দ্বের বিষয়টি অস্বীকার করেন স্বাধীনের ভাতিজি লিমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘অনেক বছর ধরেই বিলটি আমাদের ইজারায়, কখনো লাভ হয় কখনো লোকসান, অভিযোগের কারণ নানা সমস্যা সবসময়ই থাকে। তাই এই ঘটনায় নোয়াগাঁওয়ের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়নি।’

হরিপদ দাশও বলেন, জলমহাল মূল কারণ নয়, বরং হেফাজত সমর্থকদের সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যই মূল কারণ।

‘আমার অভিযোগের পর স্বাধীন আমার বাড়িতে আসে এবং বলে—কাকা এ কী করলেন! আমি বলছি, তুমি যখন আসছো, তো শেষ, মাছ ধরো নিশ্চিন্তে। তারপর আর কোনো সমস্যা হয়নি। প্রশাসনের অভিযানের সময় আমি ছিলাম না।’

তিনি বলেন, ‘স্বাধীন যদি ক্ষোভ থেকে হামলা করত, তাহলে আমার ঘরে সে নিজে ঢুকত। কিন্তু সে ঢুকেনি। যারা ঢুকেছে তাদের আমি চিনি না।’

অভিযুক্ত স্বাধীন যুবলীগ না হেফাজত সমর্থক?

নোয়াগাঁওয়ে হামলার ঘটনার পরদিন হাবিবপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন এবং পুলিশ বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করে। এর মধ্যে বিবেকানন্দ মজুমদারের মামলায় শহীদুল ইসলাম স্বাধীনকে প্রধান আসামি করে ৫০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং পুলিশের মামলায় আসামি ১৫০০ অজ্ঞাত ব্যক্তি।

প্রধান অভিযুক্ত সরমঙ্গল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান স্বাধীনকে মামলার পরদিন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। পরে মঙ্গলবার তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত।

স্বাধীন যুবলীগ নেতা এবং ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি হিসেবে প্রাথমিকভাবে জানা গেলেও তা অস্বীকার করেছে সংগঠনটি।

স্বাধীনের চাচা আজমত আলী (৬০) ও ভাতিজি লিমা আক্তার দ্য ডেইলি স্টারকে জানান যে স্বাধীন যুবলীগ নেতা এবং ইউনিয়ন সভাপতি। হেফাজতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই এবং গত ১৫ মার্চে দিরাই উপজেলায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশেও যাননি।

সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগের আহবায়ক খায়রুল হুদা চপল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২০০৭ সালের পর থেকে দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় যুবলীগের কোন কমিটি নেই এবং স্বাধীন যুবলীগের কোনো নেতা নয়। এর আগের কোনো কমিটিতেও সে ছিল না।

স্বাধীন হেফাজতে ইসলামেরও কেউ নয় বলে দাবি করেছেন দিরাই উপজেলার হেফাজত নেতৃবৃন্দ। এমনকি সেদিন গ্রামের পাশে ধারাইন বাজারে সমাবেশের সঙ্গেও তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছে এই সংগঠনটি।

হেফাজতে ইসলামের দিরাই উপজেলা শাখার সহ-সভাপতি মাওলানা নুর উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘স্বাধীন হেফাজতের সঙ্গে জড়িত না, তাকে আমাদের কেউই চিনে না। সেদিন নোয়াগাঁওয়ে হামলার আগে যে কেউ সমাবেশ করবে, সে বিষয়েও আমরা অবগত ছিলাম না। হেফাজতে ইসলামের নামে বহিরাগত কেউ অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সেদিন নোয়াগাঁওয়ে এই ন্যাক্কারজন হামলা চালিয়েছে।’


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন