আমার সরস্বতী পুজো ||| সিদ্ধার্থ সিংহ
বসন্ত পঞ্চমীর সকাল মানেই প্রথম ভালবাসার কথা মুখ ফুটে বলার দিন। তখনও ভোরবেলায় ওঠার অভ্যাস তৈরি হয়নি। তবু মা জোর করে উঠিয়ে দিয়েছে। বাড়িতে আজ ছোট ভাইয়ের হাতেখড়ি। স্লেট-পেনসিলে প্রথম অ আ ক খ লিখবে সে। ঠাকুরমশাই বা বাবা তার হাত ধরে কোনও রকমে লেখাবে।
আমরা যারা ছোট তারা সক্কালবেলায় কাঁচা হলুদ বাটা আর সরষের তেলের লেই বানিয়ে হাতে পায়ে মুখে মেখে ঝপাঝপ করে স্নান করে নিয়েছি। না, ঠান্ডা জলে নয়। তখনকার দিনে দুর্গার মূর্তি জলে ফেলামাত্র সেই জল যেই গায়ে লাগত, সেই যে শীতকালের সূচনা হত, সরস্বতী পুজোতেও তার রেশ বেশ ভাল ভাবেই থাকত। ফলে নো ঠান্ডা জল।
স্নান করেই, নিজেদের বাড়িতে যদি ঠাকুরমশাই আসতে দেরি করত, তা হলে পাড়ার যে কোনও বাড়িতে গিয়ে অঞ্জলি দিয়ে আসতাম। কারণ, অঞ্জলি না দিলে যে কিচ্ছু খাওয়া যাবে না। খাওয়া যাবে না, যাকে দেখলেই জিভে জল আসত, লোভ সামলাতে পারতাম না, সেই পাকা পাকা টোপা কুলও।
কিন্তু বাড়ির লোক আমাদের যত ছোটই মনে করুক না কেন, আমরা কিন্তু অত ছোট ছিলাম না। সেটা বেশ টের পেতাম সরস্বতী পুজো এলেই। বুঝতাম, এই সরস্বতী পুজোতেই আমাদের আর একটু রঙিন হওয়ার দিন। মুখ ফুটে ভালবাসার কথা বলার দিন।
কিশোরীরা যেমন এ দিন প্রথম শাড়ি পরত। বেশির ভাগ মেয়েই পসত বাসন্তী-রঙা। আমরা কিশোররাও পরতাম সাদা চোস্তা আর হলুদ, সবুজ, আকাশি পাঞ্জাবি। নিবিষ্ট মনে অঞ্জলি দেওয়ার সময় আড়চোখে মাঝে মাঝেই দেখে নিতাম শাড়ি পরা কোনও কিশোরীকে।
মনে আছে, সুনীলদা মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, ক্লাস ইলেভেনের ছেলেরা মিলে সে বার স্কুলের সরস্বতী পুজো করছিলেন। দায়িত্ব পেয়েই সে কী উন্মাদনা। তখনও কার্ড ছেপে আসেনি। তবু তার আগেই কেউ কেউ কাঠখড় পুড়িয়ে কী ভাবে যেন মেয়েদের স্কুলে নিমন্ত্রণ করার দলে ঠিক ভিড়ে গেল। দেখা গেল, শেষপর্যন্ত গুটিকয়েক স্মার্ট ছেলে আশপাশের মেয়েদের স্কুলে নিমন্ত্রণ করার গুরু দায়িত্বটি কার্ড পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেরে ফেলেছে এবং সেটা করেছে অবশ্যই বাদবাকি ছেলেদের দৃষ্টি এড়িয়ে। পরে অবশ্য এই নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি কম হয়নি। তবে সেই রাগ কেউ খুব বেশি দিন পুষেও রাখেনি।
সেই প্রথম পুজোর অজুহাত দেখিয়ে তিনি বাড়ির বাইরে রাত কাটানোর ছাড়পত্র পেয়েছিলেন বাড়ি থেকে। পর দিন পুজো। তাই সমস্ত আয়োজন করে মধ্যরাতে যখন সবাই ঘুমে ঢলে পড়েছেন, তখন নাকি সুনীলদা সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সরস্বতীকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। চুমু খেয়েছিলেন। আদর করেছিলেন। সেই প্রথম দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছিলেন তিনি। মাটির প্রতিমাকে জড়িয়ে ধরে নারীকে জড়িয়ে ধরার সুখানুভুতি পেয়েছিলেন।
তখন সরস্বতী পুজোর কয়েক দিন আগে থেকেই স্কুলের পড়াশোনা শিকেয় উঠে যেত। শুরু হত তোড়জোর। ক্লাস নাইনে তো কথায় নেই। দায়িত্ব ছিল সব চেয়ে বেশি। পুজোর আগের দিন দল বেঁধে ঠাকুর আনতে যাওয়ার আনন্দই ছিল আলাদা।
পুজোর দিন ভোর হতে না হতেই ঘুম থেকে উঠে পরা। কোনও রকমে অঞ্জলি দিয়েই সোজা নিজের স্কুলে। তার পর পাশের স্কুলগুলোতে টো টো কোম্পানি। বিশেষ করে মেয়েদের স্কুলে। সেখানে গিয়ে এ মেয়ে সে মেয়ের সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা। সে চেষ্টা যে সব সময় বিফলে যেত, তাও নয়। তবে যত আলাপই হোক না কেন, ওটা কিন্তু ওই— ওই দিন পর্যন্তই। একশোটা আলাপ হলে তার মধ্যে দুটোও তার পর দিন অবধি গড়াত কি না যথেষ্ট সন্দেহ।
এ কালের সেলফির হিড়িক একেবারে আকাশ পাতাল বদলে দিয়েছে যাবতীয় জীবন যাপন। বদলে দিয়েছে সরস্বতী পুজোর সকালে আনন্দের ধরণও। সে দিন যাঁরা ছিল ক্লাস নাইন, আজ তাঁরাই গিন্নিবান্নি। আজ তাঁদের কন্যারাই নতুন শাড়ি পরে তাঁগের ছোটবেলার মতোই পুজো মণ্ডপে হাজির।
এখন আর সরস্বতী পুজো শুধু স্কুলের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। পাড়ায় পাড়ায় সকাল থেকে শুরু হয়ে যায় বাগদেবীর আরাধনা। মণ্ডপের সামনে প্রথম আলাপ হওয়া কলেজ ছাত্রের সঙ্গে সেলফিতে এক ফ্রেমে বন্দি হওয়ার অফুরান সুযোগ। স্কুলে একবার যেতেই হয়। সব বন্ধুরাই দল বেঁধে স্কুলে আড্ডা দিতে আসে। মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি হতে থাকে রাশি রাশি মুখ। প্রথম আলাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন নম্বর দেওয়া-নেওয়ার শুরু হয়ে যায়। তার পর হোয়্যাটস আপ, ফোন, ভিডিও কল। ফলে তাদের সরস্বতী পুজোর দিনের আলাপ আমাদের মতো এখন আর পুজোর দিনেই শেষ হয়ে যায় না। সেই আলাপ অনেকটা গড়িয়ে যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গভীর সম্পর্কও গড়ে ওঠে। লেক, পুকুরপাড়, ভাঙা মন্দিরের চত্বর, সিনেমা হল, শপিম মল, সি সি ডি-তে পৌঁছে যায় তারা।
বাঙালির কাছে এখন তো প্রেমের দিন আর একটা নয়। পর পর দুটো। ইদানিং গোটা পৃথিবী জুড়ে সব চেয়ে জনপ্রিয় প্রেমের দিন হল— ১৪ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ ভ্যালেন্টাইন’স ডে। আর দ্বিতীয় দিনটা হল, আমাদের সেই আদি এবং অন্ত— সরস্বতী পুজো। এ বছর যেটা হচ্ছে ২৯ জানুয়ারি। মানে ১৪ মাঘ। আমাদের সময় শুধু সরস্বতী পুজোটাই ছিল। এখনকার ছেলেমেয়েরা পেয়েছে একই বছরে, মাত্র কয়েক দিনের আগে-পরে দু’-দুটো দিন। সত্যি বলছি, শুধুমাত্র এই কারণেই ওদের ভাগ্যকে আমি ভীষণ ভীষণ ভীষণ হিংসে করি।
তবে প্রেমের দিন উদ্যাপন নিয়ে কলকাতার লোকজন কিন্তু স্পষ্টতই তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম দলের উন্মাদনা সরস্বতী পুজো ঘিরে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শুক্লা সান্যাল বা প্রেসিডেন্সির ছাত্র সুমন ভট্টাচার্য জানালেন, ভ্যালেন্টাইন’স ডে নিয়ে কোনও দিনই তাঁদের খুব উৎসাহ ছিল না। বরং সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকতেন সরস্বতী পুজোর জন্য। প্রথম প্রেমও এসেছিল এই দিনটির সূত্রেই। এখনও প্রতি বছর সরস্বতী পুজোর দিন স্কুলে যান।
সুমনের মতে, যারা মফস্সলে বড় হয়েছে, তাদের কাছে সরস্বতী পুজোর মাহাত্ম্যই আলাদা। সে দিনই তো প্রিয় নারীকে প্রথম বাসন্তীরঙা শাড়ি পরতে দেখা। সে গেখারকোনও তুলনাই হয় না। সেই তুলনায় ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র জৌলুস তো আমাদের কাছে একেবারেই ম্লান। তাঁর কথায়, আমাদের
ভ্যালেন্টাইন’স ডে নেই। আছে বসন্তপঞ্চমী।
অন্য দলটির কাছে আবার ভ্যালেন্টাইন’স ডে বড্ড স্পেশ্যাল। স্কটিশ চার্চ কলেজের অদিতি, তানিয়া এবং যাদবপুরের কৃতী, রম্ভা, সত্যজিৎ ও হৃত্বিক সেই স্কুল থেকেই বন্ধু। তাঁরা জানালেন, ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র জন্য বছরের শুরু থেকেই তাঁদের প্ল্যানিং শুরু হয়ে যায়। ভালবাসার মানুষটাকে তার পছন্দের জিনিস উপহার দিয়ে তাকে চমকে দেওয়ার জন্য তো এই দিনটাই একেবারে— আদর্শ দিন। এই দিনে প্রিয় মানুষটার সঙ্গে সময় কাটাতে আমরা বেশি পছন্দ করি।বলেছেন তাঁরা।
খড়্গপুর আই আই টি-র গবেষক সুব্রত চট্টোপাধ্যায় বা সদ্য চাকরি করতে ঢোকা শোভনা মুখোপাধ্যায় আবার সরস্বতী পুজো বনাম ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র এই বরাবরের লড়াইয়ের মধ্যে ঢুকতে চান না। তাঁরা এই দুটো দিনই সমান ভাবে উপভোগ করেন। সুব্রতর দাবি, এই হানাহানি, মারামারির আর কোনও রকমে টিকে থাকার এই পৃথিবীতে যদি পর পর দুটো দিন প্রেমের জন্য বরাদ্দ হয়, তা হলে মন্দ কী? তিনি আরও বলেছেন, যে সব উদারহৃদয় মানুষের প্রেমিক বা প্রেমিকার সংখ্যা একের বেশি, তাঁদের পক্ষে তো দুটো দিন হলে আরও আরও ভাল, তাই না?
তবে সরস্বতী পুজো হোক বা ভ্যালেন্টাইন’স ডে— প্রেমের দিন উদ্যাপনের ধরন কিন্তু এখন অনেকটাই পালটে গিয়েছে। সবাই তা মানছেনও। অনেকের মতে, প্রেমের প্রকাশটাই পালটে গিয়েছে। তাই এ দু’টি দিনে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। সুব্রত বলেছেন, নিভৃত জায়গা দিন দিন কমেছে, তাই গোপনীয়তার আড়াল ছেড়ে প্রেমও আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসেছে। কলকাতা শহরে এখন অনায়াসে প্রিয় মানুষটির হাত ধরা যায়। শ্রুতি, অনন্যারা জানাচ্ছেন, এখন পার্ক বা গঙ্গার ঘাটের বদলে কলকাতার তরুণ প্রজন্ম কিন্তু শপিং মল বা সি সি ডি-তেই ‘ডেট’ করতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে।
এখনকার ছেলে-মেয়েদের এই সহজ মেলামেশা নিয়ে আশাবাদী সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ফ্রি-মিক্সিং ভাল জিনিস। তাতে জড়তা কাটে। তবে কোথাও একটু দূরত্ব থাকাও ভাল। সরস্বতী পুজো আর ভ্যালেন্টাইন’স ডে-কে এক করে দেখতে নারাজ শীর্ষেন্দুবাবু। তিনি বলছেন, ‘প্রেমের দিন’ কথাটাকে আমরা অনেক বেশি সরল করে ফেলেছি। নিছক নর-নারীর প্রেম হিসেবে না দেখে মহৎ কোনও প্রেমের কথা ভাবলে সকলেরই মঙ্গল। তিনি আরও বলেন, সরস্বতী তো প্রেমের দেবী নন। তা ছাড়া পুজোর মধ্যে একটা সংযমের ধারণা লুকিয়ে আছে। এর সঙ্গে অন্য কিছুকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়।
পালটে যাওয়া প্রেমকে স্বাগত জানাচ্ছেন নাট্যকার ব্রাত্য বসুও। তাঁর মতে, এতে প্রেমের পরিসর বাড়ছে। তবে কোনও বিশেষ দিনকে প্রেমের দিন বলতে তাঁর আপত্তি আছে।। তাঁর কথায়, জীবনে প্রেম থাকলেই হল। সেটা যে বিশেষ কোনও দিনেই পালন করতে হবে, তার কোনও মানে নেই।
কেউ কেউ দাবি করেছেন, আমাদের সময় তো সারাটা বছর ধরেই প্রেম উদ্যাপিত হত। তবে সরস্বতী পুজোর দিনটা ছিল ভীষণ অন্য রকম। ওই দিন প্রচুর হাতচিঠি আদান-প্রদান হত।
কেউ বলেছেন, প্রথম শাড়ি পরা চেনা বান্ধবী এই দিনটাতেই প্রথম বার যেন অচেনা নারী হয়ে উঠত। সরস্বতী পুজো তাই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আমার জীবনে।
শুধু তিনি নন, অনেকেই তাই মনে করেন, সরস্বতী পুজো মানেই বাঙালির ভ্যালেনটাইন ডে।
লেখকঃ গল্পকার, কবি। পশ্চিমবঙ্গ