চীনের উহানে রোগীর চাপ সামলাতে স্টেডিয়ামকে হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে – সিএনএন
করোনাভাইরাস- চীনে বিভীষিকার দিন কাটাচ্ছে মানুষরা ।। বাঁচার আকুতিতে ভারি হয়ে উঠেছে উহানের লাশ পোড়া বাতাস। করোনাভাইরাস কভিড-১৯ মৃত্যুর ফরমান নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেখানকার অলিগলি। ভাইরাস সংক্রমণ রোধে মৃতদের পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে লাশ পোড়া বাতাস ছড়িয়ে যাচ্ছে চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে আরও দূরে। প্রায় দেড় মাস অবরুদ্ধ থাকা এক মৃত্যুপুরী যেন উহান। সেখানে আটকা পড়েছেন বহু বিদেশিও। খাদ্য সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এই মৃত্যু উপত্যকায় বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন বাসিন্দারা। তাদের মতো অবস্থা চীনের আরও ২৮টি প্রদেশের বিভিন্ন শহরবাসীর। শুধু বুধবারই যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছেন ও আক্রান্ত হয়েছেন, তাতে দিনটিকে চীনের জন্য এক বিভীষিকাময় দিনই বলা যায়। এখানেই ভয়াবহতার শেষ নয়, শুরুই বলতে হয়। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির (প্যানডেমিক) আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীজুড়ে। গতকাল জাপানে এক নারীর মৃত্যুতে সেই আশঙ্কা আরও বেড়েছে। চীন ও অন্যান্য স্থানে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে পাঠানো এক চিঠিতে আক্রান্তদের দুর্দশা লাঘবে যে কোনো ধরনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এ বি এম সরওয়ার-ই-আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে কূটনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে যুক্ত দেশগুলো চরম আতঙ্কে ভুগছে। এখনও কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক তৈরি না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশ থেকে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় সামাজিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ক্রমেই মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এ উদ্বেগ এখন বিশ্বের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সংক্রমণ প্রতিরোধে বাংলাদেশসহ দেশে দেশে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তার পরও সংক্রমণের নতুন নতুন তথ্য আসছে।
চীনের হুবেই প্রদেশে শুধু বুধবার মারা গেছেন ২৪২ জন এবং অন্যান্য প্রদেশে ১২ জন। এদিন দেশটিতে সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৬৭ জনে। এক দিনে দেশটিতে নতুন করে ১৪ হাজার ৮৪০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে মোট আক্রান্তের সর্বশেষ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজারে। হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান ও এর আশপাশের শহরে বুধবার মারা যাওয়া ২৪২ জনের ১৩৫ জনকেই স্বাস্থ্য পরীক্ষার নতুন সংজ্ঞার আওতায় ধরা হয়েছে। প্রদেশটির নতুন আক্রান্ত ১৪ হাজার ৮৪০ জনের মধ্যে ১৩ হাজার ৩৩২ জনকে নতুন সংজ্ঞার অধীনে সংক্রমিত বলা হচ্ছে। তবে হুবেই ছাড়া চীনের অন্যান্য অঞ্চলে টানা ৯ দিন আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কিছুটা কমেছে। ওই সব অঞ্চলে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৩১২ জন। সব মিলে চীনে আক্রান্তের মোট সংখ্যা ১৫ হাজার ১৫২। চীনের বাইরে ২৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া কভিড-১৯ রোগে এখন পর্যন্ত তিনজন মারা গেছেন।
হংকং, ফিলিপাইনের পর সর্বশেষ গতকাল জাপানে অশীতিপর এক নারী মারা গেছেন। এটি চীনের বাইরে তৃতীয় দেশে কোনো মৃত্যুর ঘটনা। এ নিয়ে চীনসহ বিশ্বজুড়ে মোট মৃতের সংখ্যা এক হাজার ৩৭০। বিভিন্ন দেশে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় চারশ’। জাপানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কাতসুনোবো কাতো বৃহস্পতিবার জানান, করোনাভাইরাসে সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এই নারীর মৃত্যু জাপানে প্রাণহানির প্রথম ঘটনা। কানাগাওয়া প্রিফেকচারের বাসিন্দা ওই নারী ২২ জানুয়ারি উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর ১ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় জাপান অন্যতম। দেশটিতে ইতোমধ্যে ২৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। কভিড-১৯ আতঙ্কে জাপানের নৌবন্দরে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৭০০ আরোহীর একটি প্রমোদতরী। সেখানে গতকাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ যাত্রী আক্রান্ত হয়েছেন। মানবেতর সময় কাটাচ্ছেন জাহাজটির যাত্রী ও ক্রুরা।
চীনে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পদ্ধতি বদলানোয় দেশটিতে এক দিনেই কভিড-১৯ রোগে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা হুট করে বেড়ে গেছে। করোনাভাইরাস- চীনে বিভীষিকার দিন গতকাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য দিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। হুবেই প্রদেশে এখন কারও শরীরে করোনাভাইরাসের উপসর্গ যেমন- জ্বর, সর্দি, শুস্ক কাশি দেখা দিলেই তাকে সংক্রমিত হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এ ছাড়া সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে কারও ফুসফুসের সংক্রমণ ধরা পড়লেও তাকে সংক্রমিত হিসেবে ধরা হচ্ছে। এর আগে নিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ-আরএনএ) পরীক্ষা করে ভাইরাসের উপস্থিতি পেলেই তাকে সংক্রমিত বলা হচ্ছিল। একই সঙ্গে আক্রান্তের উপসর্গ প্রকাশের সময় নিয়েও ফলে আগে যে প্রক্রিয়ায় তথ্য দেওয়া হতো, প্রকৃত চিত্র তার চেয়েও খারাপ বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিবিসির চীন প্রতিনিধি স্টিফেন ম্যাকডোনেল আক্রান্ত ও মৃতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে এক বিশ্নেষণে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, চীনের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পদ্ধতিতেই গলদ আছে।
ভাইরাস মোকাবিলায় ঘরে-বাইরে প্রচণ্ড সমালোচনার মধ্যে পড়া চীন সরকার নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। ভাইরাসের মহামারি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত হুবেই প্রদেশে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির দুই শীর্ষ নেতাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগে ওই প্রদেশের তিন শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও দলীয় নেতাকে সরিয়ে দিয়েছিল প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সরকার। তবে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হচ্ছেন স্বয়ং জিনপিন। উহানের এক চিকিৎসক করোনাভাইরাস নিয়ে প্রথম দিকে সতর্ক করতে গিয়ে পুলিশি বাধার মুখে পড়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চীনের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের জোরালো দাবি ওঠে। জিনপিং করোনাভাইরাসকে ‘শয়তান’-এর সঙ্গে তুলনা করে এর বিরুদ্ধে জয় হবে বলে বারবার আশার কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় আতঙ্ক নিয়েই চীনের কিছু অঞ্চলে কাজে ফেরা শুরু করেছে মানুষ। তবে গতকালও দেশটির রাজধানী বেইজিংয়ের সড়কগুলো ফাঁকা দেখা যায়।
বিভিন্ন দেশে চীন থেকে ফেরা মানুষের কাছ থেকে অন্য মানুষে কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার খবর আসতে থাকায় গত ৩০ জানুয়ারি এ ভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তবে এখনও একে বৈশ্বিক মহামারি (প্যানডেমিক) ঘোষণা করেনি সংস্থাটি। চীনে হুট করে আক্রান্ত-মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার ডব্লিউএইচও-এর জরুরি স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রধান মিশেল রায়ান বলেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষার পদ্ধতি বদলানোয় সংখ্যা হঠাৎ বেশি দেখালেও সাবির্ক প্রাদুর্ভাবকে এটি খুব বেশি প্রভাবিত করবে না। করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে চীনের প্রতিবেশী ১৪টি দেশ রয়েছে সবার ওপরে। এর মধ্যে চীনের সঙ্গে আকাশ, নৌ ও সড়কে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়াসহ কয়েকটি দেশ। চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর গভীর সম্পর্ক থাকায় এসব দেশে জীবনযাত্রায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সিঙ্গাপুরে এ পর্যন্ত ৫০ জন সংক্রমিত হয়েছে। এর ফলে সেখানকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। বিভিন্ন অফিসে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে চীনারা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। দেশটিতে বিভিন্ন স্থানে তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে।
এদিকে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকং তাদের সঙ্গে চীনের মূলখণ্ডের সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। সেখানে এরই মধ্যে ৫১ জন আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন একজন। থাইল্যান্ডে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। দেশটিতে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে ৩২ জন। দেশটির রাজধানী ব্যাংকক ও বিনোদন শহর পাতায়া পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ায় অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। করোনাভাইরাস আতঙ্কে পাঁচটি দেশের বন্দরে ভিড়তে না পারা যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রমোদতরী দুই হাজার ৩০০ আরোহী নিয়ে গতকাল কম্বোডিয়ার একটি বন্দরে ভিড়েছে। দেশটিতে এ পর্যন্ত একজন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
আক্রান্ত অন্যান্য দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি, রাশিয়া, স্পেন, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, বেলজিয়াম, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম। চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ম্যাকাওয়ের ১০ ব্যক্তি কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। বুধবার সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ভাইরাসে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে দরিদ্র দেশগুলো। কারণ, তাদের রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা কম। আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই মহামারি চীনের মধ্যেই প্রতিরোধ করা না গেলে বিশ্বের ৬০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
কভিড-১৯ আতঙ্কে বার্সেলোনায় ২৪-২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ‘মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস’ নামে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল মেলা গতকাল স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে এর আয়োজক সংগঠন জিএসএমএ। এ করোনাভাইরাস- চীনে বিভীষিকার দিন থাকায় ঘটনায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কয়েকশ’ কোটি ডলার ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটসহ বড় বড় শেয়ারবাজার হুটহাট ওঠা-নামা করছে। বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে ওয়াল স্ট্রিটে সূচক নিম্নমুখী ছিল। বিনোদন ও সংগীত জগতেও এর প্রভাব পড়েছে। ব্রিটিশ র্যাপার স্টর্মজি (মাইকেল ওমারি) বিশ্ব সফরের এশিয়া অংশে কর্মসূচি স্থগিত করেছেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় মার্চ ও এপ্রিলে পারফর্ম করবেন। তার মতো পশ্চিমের আরও অনেক তারকা শিল্পী তাদের অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন।
করোনাভাইরাসকে এতদিন নভেল বা নতুন করোনাভাইরাস বা সংক্ষেপে ২০১৯-এনসিওভি বলা হচ্ছিল। এ ভাইরা যে রোগ সৃষ্টি করছে, তার নতুন নাম দেওয়া হয়েছে কভিড-১৯। তবে এ রোগের এখনও কোনো প্রতিষেধক তৈরি হয়নি। বাদুড় সন্দেহের তালিকায় থাকলেও এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি রোগটির উৎস সম্পর্কে, তবে করোনাভাইরাস- চীনে বিভীষিকার দিন কখনো কেউ দেখেনি । সূত্র :বিবিসি, এএফপি, সিএনএন।