হারিয়ে গেছে চিরচেনা বাবুই পাখি!
হায়াতুজ্জামান মিরাজ, আমতলী (বরগুনা)।। কালের বিবর্তনে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার চিরচেনা বাবুই পাখির বাসা। বরগুনার আমতলী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা মিলছে না চিরচেনা সেই বাবুই পাখির বাসা। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য নানা কর্মসূচি নিয়ে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসলেও সকলের অগোচরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে বাবুই পাখি। দিন দিন তাল ও খেজুর গাছ কমে যাওয়া, ঘূর্ণিঝড় সিডর, আয়লা, ফনি, বুলবুল এবং সর্বশেষ আম্ফানের আঘাতের কারণে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে বাবুই পাখি ও তার শৈল্পিক বাসা।
বাবুই পাখির বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই ছিল না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক জোগাত এবং আত্মনির্ভশীল হতে উৎসাহ দিত। কিন্তু কালের বিবর্তনে ও পরিবেশে বিপর্যয়ের কারণে পাখিটি আমরা হারাতে বসেছি। একসময় প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জের তাল, ও খেজুর গাছে এরা বাসা বেঁধে থাকতো। কিচির মিছির শব্দে এলাকা মুখরিত করে রাখে। প্রকৃতি থেকে তাল আর খেজুর গাছ বিলুপ্ত হওয়ায় বাবুই পাখিও হারিয়ে যেতে বসেছে।
এক সময় আমতলীতে তিন প্রজাতির দেখা যেত। দেশি বাবুই, দাগি বাবুই ও বাংলা বাবুই পাখি। বর্তমানে কিছু দেশি বাবুই পাখি দেখা গেলেও বাংলা ও দাগি বাবুই পাখি এখন বিলুপ্তির পথে। দেশি বাবুই পাখির সংখ্যাও খুব সীমিত। বাসা তৈরি করার জন্য বাবুই পাখির প্রথম পছন্দ তালগাছ এরপর খেজুর গাছ। এদের বাসা বাঁধার গঠনও বেশ জটিল, তবে আকৃতি খুবই সুন্দর। বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি মজবুত। এরা খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, ঝাঁউ ও কাঁশবন দিয়ে বাসা বাঁধে।
বাসা বাঁধার শুরুতে বাবুই পাখি বাসায় দুটি নিম্নমুখী গর্ত রাখে। অর্ধেক বাসা বাঁধার পর তার সঙ্গীকে খুঁজতে থাকে। স্ত্রী বাবুই পাখিটিকে পছন্দ হলে মাত্র চার দিনে বাসা বাঁধার কাজ শেষ করে। তখন বাসার নিম্নমুখী একটি গর্ত বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা করে নেয়। অন্যটি খোলা রাখে প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য। বাসার ভেতরে-বাইরে কাদা লাগিয়ে রাখে। ফলে প্রবল ঝড়ে বা বাতাসেও টিকে থাকে বাসা। রাতে বাসা আলোকিত করার জন্য জোনাকি পোকা ধরে এনে রাখে। সাথী বানানোর জন্য কত কিছুই না করে পুরুষ বাবুই পাখি। স্ত্রী বাবুইকে নিজের প্রতি আকর্ষিত করতে খাল-বিল ও ডোবায় গোসল সেরে ফূর্তিতে নেচে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে।
সাধারণত মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। একটি পুরুষ পাখির একাধিক বাসা ও পরিবার থাকতে পারে। স্ত্রী বাবুই পাখি দুই থেকে চারটি ডিম দেয়। সেই ডিম থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। তিন সপ্তাহ পর বাচ্চাগুলো উড়তে যায়।
বাবুই মূলত বীজভোজী পাখি। তাই এদের ঠোঁটের আকৃতি সহজে বীজ ভক্ষণের উপযোগী চোঙাকার। আর ঠোঁটের গোড়ার দিকটা মোটা। এরা সাধারণত খুঁটে খুঁটে বিভিন্ন ধরনের বীজ, ধান, ভাত, পোকা, ঘাস, ছোট ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু- রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে থাকে।
হারিয়ে যাওয়া বাবুই পাখির মনোমুগ্ধকর ছন্দের কথা উল্লেখ করে উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের টেপুড়া গ্রামের ৭০ ঊর্ধ্ব বৃদ্ধ হানিফ আকন বলেন, এক সময় আমাদের বাড়ির পুকুর পাড়ের তালগাছে বাবুই পাখির বাসা ছিলো। সবুজ রঙের এই বাবুই পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যেত প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায়। এ পাখি যেমন শিল্পী তেমন ঘুম জাগানিয়াও। প্রতিদিন সকালে চমৎকার সুরে মানুষের ঘুম ভাঙাতো। কালের বিবর্তনে আমাদের বাড়িসহ বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জ থেকে তাল ও খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় বাসা বাঁধার জায়গা না পাওয়া এবং বংশ বৃদ্ধি করতে না পেরে বাবুই পাখি এলাকা থেকে বিদায় নিয়েছে।
অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আয়লা, ফনি, বুলবুল ও সর্বশেষ আম্ফানের আঘাতের কারণে এবং ক্ষেত বীজতলায় কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহার করায় বাবুই পাখি মারা যায়। তাই বংশ রক্ষার্থে তারা এলাকা ত্যাগ করে অন্যাত্র চলে যাওয়াও অন্যতম কারন।
এ বিষয়ে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য রক্ষা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মুখপাত্র ও পাখি বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে দেশে বাবুই পাখির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর ব্যাপার হয়ে পড়েছে। হারিয়ে যাওয়া অনেক প্রজাতির পাখির মধ্যে বাবুই পাখি অন্যতম। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় বাবুই পাখির বংশ বিস্তারে বেশী করে তাল ও খেজুর গাছ রোপণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই সাথে কীটনাশকের অপব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। -সূত্রঃ কালেরকন্ঠ
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন