মত-মতান্তর

দিল্লিতে সংঘাত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত

দিল্লিতে সংঘাত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত ।  ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে (Citizenship Amendment Act সংক্ষেপে CAA) কেন্দ্র করে বিক্ষোভ-সংঘর্ষে দিল্লিতে বৃহস্পতিবার মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে  ৪২ জনে । সংঘর্ষে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০০ জন । টানা চারদিন ধরে চলতে থাকা সংঘর্ষে রণক্ষেত্র তৈরি হয়েছে দিল্লির ভজনপুরা, মৌজপুর, কারাওয়ালনগরে । বিতর্কিত সিএএ সমর্থক ও বিরোধিতাকারীদের মধ্যকার ওই সংঘর্ষ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিস্হিতি আরো সহিংস হয়ে ওঠে । এ সংঘাত দিল্লীর হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল-যা খুবই দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের (CAA) মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতে প্রথমবারের মত ধর্মকে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার নির্ধারক হিসেবে রাখা হয়েছে । নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) সংশোধন করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের হিন্দু, সহ কয়েকটি ধর্মাবলম্বীদের ভারত তাদের দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে কিন্তু মুসলমানদের বাদ দেওয়া হয়েছে ।

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল হল ২০১৯ সালের ১০ ও ১১ ডিসেম্বরে ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাস হওয়া একটি আইন। এর  উদ্দেশ্য ১৯৫৫ সালে গৃহীত নাগরিকত্ব সংশোধন আইন । আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে ভারতে আগত নিপীড়িত ির্যাতিত সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসী এবং খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী অবৈধ অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরকিত্ব পাওয়ার সুযোগ হয়েছে এই  আইনের মাধ্যমে। কিন্তু মুসলিমদের জন্য এজাতীয় কোনো সুযোগের ব্যবস্থা রাখা হয় নি। ভারতীয় আইনের আধারে প্রথমবারের মত ধর্মীয় পরিচয়কে নাগরিকত্ব লাভের শর্ত হিসাবে যুক্ত করা হয়েছে। সংশোধিত আইন অনুযায়ী, এসব ধর্মের লোকজনকে অবশ্যই ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ এর আগে ভারতে প্রবেশ করতে হবে এবং সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে “ধর্মীয় নীপিড়নের” শিকার অথবা ধর্মীয় নিপীড়নের ভীতি প্রদর্শন করলে তবেই ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারবেন । এই বিল পাশের পর ভারতজুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয় । বিতর্কিত এই আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দেশজুড়ে সরব হয়েছে কংগ্রেস, তূনমূল কংগ্রেস সহ একাধিক রাজনৈতিক দল । বিভিন্ন জায়গা থেকে এই সংশোধনী বিল পাসের পরপরই সমালোচনা শুরু হয়। Human Rights Watch এর মতে সংশোধনী আইন মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইনকে মুসলমানদের জন্য বৈষম্যমূলক হিসেবে বর্ণনা করে তা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানায় জাতিসংঘের মানবাধিকার  কমিশন । ১৯৫০ সালের কার্যকর হওয়া গনতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সংবিধান অনুসারে সে দেশের বাসিন্দারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ভারতের নাগরিক ।

দিল্লিতে সংঘাত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত । ভারতের বিজেপি সরকার বলছে, নাগরিকত্ব নেয়ার জন্য নয় দেয়ার জন্যই নাগরিক আইন সংশোধন করা হয়েছে । তবে সমালোচকরা বলছে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন মুসলমানদের জন্য বৈষম্যমূলক । এদিকে দিল্লীর উদ্বেগজনক পরিস্হিতি নিয়ে অন্তবর্তীকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধী এবং ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর নেতৃত্বে কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতি ভাবনে গিয়ে ভারতের  রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দের কাছে একটি স্মারকলিপিও প্রদান করে  রামনাথকে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, ‘দিল্লিতে চার দিনে যা ঘটেছে তা জাতীয় লজ্জার বিষয়।’ পরে তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে তাঁকে বলি যে, তিনি যাতে এই বিষয়ে কেন্দ্রকে পরামর্শ দেন। দিল্লিতে চার দিনে যা ঘটেছে তা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এবং জাতীয় লজ্জার। যা ঘটল তা কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।’ অন্তবর্তীকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধী ভারতের রাষ্ট্রপতিকে ‘রাজধর্ম’ (দুষ্টের দমন-শিষ্টের পালন) পালনের অনুরোধ জানান। এইসঙ্গে তিনি দাঙ্গা সামলানোয় ব্যর্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগ দাবি করেন । ভারতের দিল্লিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতা বন্ধ করে শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন বলিউড তারকারা। যারা ঘৃণাসূচক মন্তব্য ছাড়াচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন দিল্লি হাইকোর্ট। আদালত উত্তেজনা সৃষটিকারী অনুরাগ ঠাকুর এবং কপিল মিশ্রর বিরুদ্ধেও এ ধরণের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন । পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিজের বাসভবনে স্থানীয় বিধায়ক ও কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল । দাঙ্গায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনায় পৃথক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মুসলিম দেশগুলোর জোট দ্য অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) ও জাতিসংঘ। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস তাঁর বিবৃতিতে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আহ্বান জানান । ছয় মুসলিমের প্রাণ বাঁচিয়ে প্রেমকান্ত এখন মৃত্যুমুখে : দাঙ্গার সময় দিল্লিতে ছয় মুসলিমকে প্রাণে বাঁচানো প্রেমকান্ত এখন নিজেই মৃত্যুর মুখোমুখি। তিনি আগুনে জ্বলতে থাকা ঘরগুলো থেকে একে একে মুসলিমদের বের করে এনেছিলেন। মুসলিম বন্ধুর বয়স্ক মাকে জ্বলন্ত ঘর থেকে বের করতে গিয়ে গুরুতর দগ্ধ হন প্রেমকান্ত। তখন তার শরীরের অন্তত ৭০ শতাংশ পুড়ে যায়। প্রেমকান্তর চিকিৎসা চলছে, তবে জীবন তার সংকটাপন্ন । আজ শুক্রবার কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি ।

আমরা ভারতের রাজধানী দিল্লিতে চলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত । আমরা বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সহায়তাকারী  বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের এহেন দাঙ্গা পরিস্থিতিতে গভীর উৎকন্ঠা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছি । আমরা ভারত সরকার ও জনগণকে হৃদয় দিয়ে আহ্বান জানাচ্ছি, দ্রুত কার্যকর ও নিরাপওামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ভারতের ঐতিহ্য ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা  করতে সচেষ্ঠ হউন । চলুন সবাই মানবতার কথা বলি। শান্তির পক্ষে কথা বলি। সামপ্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখি । ধর্মের নামে অশান্তির বিরুদ্ধে কথা বলি, প্রতিবাদ করি। দিকে দিকে সত্য, সুন্দর,ন্যায়বিচার, মানবতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জয় সূচিত হউক-এ প্রত্যাশা ও প্রার্থনা করছি ।

বিদ্যুৎ ভৌমিক, লেখক, কলামিষ্ট ও সিবিএনএ’র উপদেষ্টা। মন্ট্রিয়ল, ক্যানাডা,  ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

আরও পড়ুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ     
কানাডার সংবাদ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen − 3 =