বিশ্ব নেতাদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে জলবাযু সম্মেলনে আসার আহ্বান
বিশ্ব এখন দুর্যোগের প্রথম সারিতে
কাওসার রহমান ।। ‘এবারের চরম বিরুপ আবহাওয়া ২৮তম জলবায়ু সস্মেলনকে (কপ-২৮) বিশ্ব দুর্যোগের প্রথম সারিতে এনে দাঁড় করিয়েছে। এখন আর শুধু উপকূলীয় দেশ নয়, এ বছর দ্রুত ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা সবাইকে বিপর্যয়ের প্রথম সারিতে ফেলে দিয়েছে। তাই বিশ্ব নেতাদের অবশ্যই কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে অলসতা ভেঙ্গে কাজ শুরু করতে হবে।’
এমনটাই বলেছেন জাতিসংঘের শীর্ষ জলবায়ু কর্মকর্তা সাইমন ইমানুয়েল কারভিন স্টিয়েল। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘জলবায়ু দুর্যোগ এখন সবার ঘাড়েই নি:শ্বাস ফেলছে। কোন দেশ এখন আর নিজেকে বিপর্যয়ের উর্ধ্বে ভাবতে পারবে না। আমরা দূর-দূরান্তের ফ্রন্টলাইনে মানুষকে রক্ষা করার কথা বলতে অভ্যস্ত। আমরা এখন এমন এক বিন্দুতে রয়েছি, যেখানে আমরা সবাই সামনের সারিতে আছি। তবুও বেশিরভাগ সরকার এখনও হাঁটছে, অথচ তাদের এখন দৌঁড়ানোর প্রয়োজন’।
তিনি বলেন, ‘এবারের সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ক্ষয় ও ক্ষতিকে (লস এন্ড ডেমেজ) সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এ ব্যাপারে তহবিলে অর্থায়নসহ আমাদের সামনের দিকে এগুতেই হবে। এখান থেকে পেছন ফেরার সুযোগ নেই।’
তিনি অর্থায়ন প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘উন্নত দেশগুলো বেশ কয়েক বছর আগে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। গরীব দেশগুলোকে এই অর্থ দেয়া হবে তাদের অভিযোজন ও সবুজ জ্বালানির উন্নয়নে। আমরা আশা করছি, এবছর আমরা এই প্রতিশ্রুতির কাছাকাছি পৌছাতে পারব।’
তবে যে কোন অর্জনের জন্য গরীব দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ থাকার কোন বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা নতুন রেকর্ড ভেঙেছে, যা এই বছরটিকে রেকর্ডে সবচেয়ে উষ্ণ করে তুলেছে, এবং বিপদজনকভাবে ১.৫ সেলসিয়াসের থ্রেশহোল্ডের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। অথচ দেশগুলো প্যারিস চুক্তিতে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্প স্তরের উপরে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতে সম্মত হয়েছে। তাপমাত্রা এখন একটি ‘নারকীয়’ জলবায়ু সংকটের দিকে যাচ্ছে। এখনই যদি না জরুরী এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় তাহলে গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
এ প্রসঙ্গে স্টিয়েল বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ সীমার মধ্যে থাকার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করা এখনও সম্ভব, তবে আরও বিলম্ব বিপজ্জনক হবে। অথচ প্রতি বছর আমরা বিন্দুর মতো শিশুর পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমাদের আরও বড় পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যদি আমরা এই দৌঁড়ে থাকতে চাই তাহলে প্রতিটি বছরের সঙ্গে আমাদের আরও বড় লাফ দিতে হবে। আমাদের কি করতে হবে বিজ্ঞান তা একেবারে পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এবারের সম্মেলনই প্রথম কোন জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এর আগেও এমন দেশে (কাতার) জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ভবিষ্যতেও হবে। এখন জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রতিটি দেশ, এমনকি যারা প্রধান তেল উৎপাদনকারী, তাদেরও বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।’ তিনি বলেন, এখানে আমাদের ভবিষ্যত প্রেসিডেন্সি যে বার্তাগুলো এবং সংকেতগুলো দিবেন তা গুরুত্বপূর্ণ। তারা জরুরী পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলবেন এবং পৃথিবীকে একটি নতুন ডিকার্বনাইজড বিশ্বে রূপান্তরের কার্যক্রমকে গতিশীল করার উপর ফোকাস করবেন।
সাইমন স্টিয়েল জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু সম্মেলনে ফসিল ফুয়েল নির্বাহীদের উপস্থিতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কারণ ফসিল ফুয়েলের এক্সিকিউটিভরাও সম্ভবত শীর্ষ সম্মেলনে কার্যকর হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা স্বীকার করছি, জীবাশ্ম জ্বালানী শিল্পকেও এই সমস্যার সমাধানের অংশ হতে হবে। আমরা জানি সমস্যাগুলো কোথায়। কিন্তু আলোচনার অগ্রগতির জন্য কী করা দরকার, কীভাবে করা দরকার তার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানী শিল্পকেও এই আলোচনার অংশ হতে হবে। এই সংস্থাগুলোকে দেখাতে হবে যে তারা বিশ্বকে শূন্য-কার্বন অর্থনীতিতে স্থানান্তরিত করার বিষয়ে আন্তরিক। জলবায়ু আলোচনার প্রক্রিয়ায় তাদের নিযুক্তি বৈধ হতে হবে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তারাই পারে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর আমাদের বর্তমান নির্ভরতা থেকে একটি নতুন ডিকার্বনাইজড ব্যবসায়িক মডেলে রূপান্তরিত করতে।
২৮তম জলবায়ু সম্মেলনের মূল বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হবে জলবায়ু বিপর্যয়ে আক্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্রতম এবং সবচেয়ে দুর্বল দেশগুলোকে উদ্ধার ও পুনর্বাসনের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি দীর্ঘস্থায়ী অভিযোগ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয় ও ক্ষতি (লস এন্ড ডেমেজ) তহবিলের অনুপস্থিতি। গত জলবায়ু সম্মেলনে দেশগুলো একটি তহবিলের গঠনের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। কিন্তু ধনী দেশগুলো এখনও তহবিলে অবদান রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
স্টিয়েল এবারের সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অর্থ ছাড়া একটি যে তহবিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তা আমাদের যেখানে থাকা দরকার সেখানে পৌঁছাতে পারবে না। কীভাবে তহবিলে পুঁজি (অর্থ) সরবরাহ করা হবে সে সম্পর্কে শক্তিশালী সংকেত পাঠানোর জন্য এবং সেই মূলধনের পরিমান বাড়ানোর জন্য আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনে ধনী দেশগুলোকে প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে।
২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির পর থেকে নির্গমন হ্রাসে কতটা সামান্য অগ্রগতি হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক উত্তাপকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণে বিশ্ব কতটা দূরে রয়েছে তার একটি বৈশ্বিক মূল্যায়ন (ষ্টকটেক) সরকারগুলোকে উপস্থাপন করা হবে। এই বৈশ্বিক মুল্যায়ন করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, জলবায়ু সংকটের প্রভাব দ্রুত বিপর্যয়কর এবং অপরিবর্তনীয় হয়ে উঠবে।
স্টিয়েল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, সরকারগুলোকে অবশ্যই ‘সমাধান, সমাধান, সমাধান’ মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে। প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তারা জানে কোথায় কোথায় পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন পদক্ষেপ নিতে হবে নবায়নযোগ্য শক্তি ও বিদ্যুতায়ন পরিবহন বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ডিকার্বনাইজ করা। সর্বত্র মানুষ আশা করছে, সরকারগুলো এসব এব্যাপারে এই সম্মেলনকেই কাজে লাগাবে। জনসাধারণের মনোযোগ আমাদের দিকে থাকবে এবং সকলেরই প্রত্যাশা যে, এই জলবায়ু সম্মেলন সেই সমাধানগুলো এবং জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপের ব্যাপারে কথা বলবেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা কেবল আশার কথা বলতে পারি, তবে আশা কেবলমাত্র তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যদি প্রসবের, কর্মের লক্ষণ থাকে। আমি বিশ্বাস করি, জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি মোকাবেলায় সংগ্রামরত সাধারণ মানুষ কপ-২৮-এ বিশ্ব নেতাদের কাছে এই সংকেত প্রত্যাশা করছে।’
তথ্য সূত্র: এপি ও গার্ডিয়ান