লেখালেখি

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ এর মৃত্যুতে আমরা আমরা গভীরভাবে শোকাহত

স্যার ফজলে হাসান আবেদ

-বিদ্যুৎ ভৌমিক

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশের কৃতি সন্তান ও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ এর মৃত্যুতে আমরা আমরা গভীরভাবে শোকাহত, মর্মাহত ও ব্যথিত। দেশ-বিদেশে বিপুল খ্যাতি, বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মান অর্জনকারী বিশ্বের অন্যতম সফল এনজিও ব্যক্তিত্ব স্যার ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশ সময় ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ  করেন । মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলে এবং তিন নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য  শুভাকাংখী ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল তদানীন্তন সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমার বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনট্যান্টসে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি তাঁর প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন । ১৯৭১ সালে  লন্ডনে  তিনি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ‘এ্যাকশন বাংলাদেশ’ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন । ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাণপুরুষ স্যার ফজলে হাসান আবেদ তাঁর লন্ডনের চাকরি ছেড়ে বাড়ি বিক্রি করে সেই অর্থ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরে এই বৃহৎ যুদ্ধে আত্মনিয়োগ করেছিলেন । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর ১৯৭২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন । যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ভারত-প্রত্যাগত শরণার্থীদের জরুরী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে আত্মনিয়োগ করেন । এ লক্ষ্যে তিনি ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করে সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত শাল্লা এলাকায় ফিরে আসা শরণার্থীদের নিয়ে আর্থসামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করেন । ১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করার পর সংস্থাটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়েছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নে অনন্য অবদান রাখায় স্যার ফজলে হাসান আবেদ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পূরস্কার, ইউনিভার্সিটির সম্মানসূচক ডিগ্রি ও স্বীকৃতিতে ভূষিত হয়েছেন । ১৯৮০ সালে অত্যন্ত সম্মানজনক ম্যাগসেসে পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি । ২০১০ সালে ব্রিটেনের রানী প্রদত্ত নাইটহুড মর্যাদা লাভ করেন । । এছাড়াও তিনি বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, স্প্যানিশ অর্ডার অব সিভিল মেরিট, অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব অরেঞ্জ-নাসাউ, লিউ টলস্টয় ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড মেডেলসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন । শিক্ষা উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ পুরস্কার ইয়াইদান পুরস্কার ও সোনার মেডেল পেয়েছেন। ২০০৬ সালে জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্টের প্রধান তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘ফজলে হাসান আবেদের মতো মাত্র ছয়জন রাষ্ট্রপ্রধান যদি পেতাম, তাহলে পৃথিবীতে আমি খাদ্যের অভাব চিরতরে দূর করে দিতে পারতাম । ২০১০ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব কর্তৃক স্বল্পোন্নত দেশসমূহের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত পরামর্শদাতা দলের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন । ১৯৯৪ কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি, ২০০৩ যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার থেকে ডক্টর ইন এডুকেশন ডিগ্রি এবং ২০১৪ যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি অর্জন করেন ।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন সততা, বিনয় ও মানবিকতার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত । নিজের সততা, আত্ববিশ্বাস, কর্মদক্ষতা ও দূরদর্শিতা নিয়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদ  অনেক ত্যাগী ও বিবেকবান কর্মী নিয়ে ব্র্যাককে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পেরেছেন । ব্র্যাক আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত এনজিও । বর্তমানে এক লাখ কর্মী নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর ১১টি দেশের ১৩ কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নে নিরলস কাজ কাজ করে যাচ্ছে ও সেবা দিয়ে চলেছে ব্র্যাক । তাঁর জ্ঞান, সাহস, মানবতা ও বিচক্ষণতার জন্য পৃথিবীর অনেক সম্মানিত মানুষ ও রাষ্ট্রপ্রধান তাঁকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছেন । যে সব বাংলাদেশী তাদের সততা, আত্ববিশ্বাস ও কর্মগুণে বিশ্বজুড়ে পরিচিত, স্যার ফজলে হাসান আবেদ তাদের অন্যতম । শুধু শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন অথবা ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি নয়, ব্র্যাক সমাজ গঠনের জন্য প্রতিটি খাতে কাজ করে যাচ্ছে । ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত টানা চার বছর জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংস্থা ‘এনজিও এ্যাডভাইজার’ কর্তৃক ব্র্যাক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এনজিও হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে । আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । ২০১৪ ও ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন কর্তৃক স্যার ফজলে বিশ্বের শীর্ষ প্রভাবশালী ৫০ জন ব্যক্তিত্বের অন্যতম হিসেবে উল্লেখিত হন । তিনি এ বছর নেদারল্যান্ডের রাজা কর্তৃক নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত হন  । স্যার ফজলে হাসান আবেদের ইতিহাস আমাদের গর্বের ইতিহাস। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ এর প্রতি রইলো আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি । শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি রইলো গভীর সমবেদনা।

লেখক, কলামিষ্ট ও CBNAএর উপদেষ্টা  , ২০ ডিসেম্বর ২০১৯

 

আরও পড়ুনঃ বিশেষ মন্তব্য ।। আমি আজ বেদনা ভারাক্রান্ত

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 5 =