লেখালেখি

সাকিবকে যারা মারার হুমকি দেয় তারা কোন দেশের মানুষ?

যারা মারার হুমকি দেয়
সাকিব আল হাসান

সাকিবকে যারা মারার হুমকি দেয় তারা কোন দেশের মানুষ?

১৭ কোটি বাঙালি যাকে নিয়ে গর্ব করে, তিনি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ক্রিকেট মাঠের ২২ গজ পেরিয়ে তার উজ্জ্বলতায় আলোকিত হয় বিশ্ব মঞ্চ। নিষেধাজ্ঞায় এক বছর বাইরে থাকলেও করোনার কারণে এই সময় ক্রিকেট খেলা না থাকায় তার শ্রেষ্ঠত্বের আসন অক্ষুণ্নই আছে। নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার সাকিব। শুধু বাংলাদেশের নয়, সাকিব বিশ্বেরই সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডাদের একজন। দুর্দান্ত ব্যাটিং, বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং, সঙ্গে অসাধারণ ফিল্ডিং- সব মিলিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সাকিব অলরাউন্ডার। ক্রিকেট ইতিহাসে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি- তিন ধরনের ক্রিকেটে একই সময়ে এক নম্বরে থাকা একমাত্র ক্রিকেটার তিনি। ২০১৫ সালে সাকিব এই কৃতিত্ব প্রথম করে দেখান। সাকিবের নিষেধাজ্ঞার পুরো সময় বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনগণ তার পাশে ছিল, চোখের পানি ফেলে প্রার্থনা করেছে দ্রুত যেন সাকিব খেলায় ফিরতে পারেন! সেই সাকিবকে যারা মেরে ফেলতে চায়, এরা কারা? এরা কি বাংলাদেশের নাগরিক?  বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলা হলে এরা নিশ্চয়ই পাকিস্তানকে সাপোর্ট করে?  তা না হলে বাংলাদেশের গর্ব সাকিবকে তারা মেরে ফেলতে চায় কীভাবে? কোন সাহসে তারা হুমকি দেয়?

সাকিব ভারতে একটি পূজার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন- এমন খবর ও ছবি প্রকাশ করে কিছু গণমাধ্যম। আর তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করা শুরু হয় মূলত শনিবার (১৪ নভেম্বর) থেকেই। এর মধ্যে মহসিন তালুকদার নামে এক ব্যক্তি রোববার (১৫ নভেম্বর) রাতে তার ফেসবুক আইডি থেকে লাইভ ভিডিওতে সাকিবকে অশ্লীল গালিগালাজ ও হত্যার হুমকি দেন। পাশাপাশি তিনি সাকিবকে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের অনুসরণেরও পরামর্শ দেন ওই ভিডিওতে। পরদিন সকালে আবার লাইভে এসে তিনি সাকিবকে ভারতে কালীপূজা উদ্বোধন করতে যাওয়ার কারণে ক্ষমা চাইতে বলেন। এসব নিয়ে আলোড়িত হয়ে ওঠে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

এমন পটভূমিতে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিও বার্তায় সাকিব আল হাসান বলেন, তিনি পূজার উদ্বোধন করেননি বা উদ্বোধন করতে যাননি। এই বার্তায় তিনি নিজেকে গর্বিত মুসলমান উল্লেখ করে বলেন, ‘ভুলত্রুটি হবেই, ভুলত্রুটি নিয়েই আমরা জীবনে চলাচল করি। আমার কোনো ভুল হয়ে থাকলে অবশ্যই আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’

বাংলাদেশ চিরকালই একটি পারস্পারিক সৌহার্দের দেশ। এ দেশে সবার উৎসবে আমরা সানন্দে অংশ নিই। ধর্ম যার যার উৎসব সবার- এই নীতিতে বিশ্বাসী আমরা। আবহমানকাল ধরে এই বাংলায় সব ধর্মের মানুষ শান্তিতে পাশাপাশি বাস করে আসছে। ঈদের নামাজটা পড়ি আমরা, উৎসবটা করে সবাই। পূজা উৎসবের ধর্মীয় অংশটা করে হিন্দুরা, উৎসবটা করে সবাই। মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদে হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ বন্ধুরা বাসায় আসে, কোলাকুলি করে। আবার মুসলমান বন্ধুরা হিন্দুদের পূজায়, খ্রিষ্টানদের বড়দিনে অংশ নেয়। সামাজিক বন্ধনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না কোনো ‘দেয়াল’। কারণ, ধর্মের কোনো দেয়াল হয় না, হয় বন্ধন। এটা আমাদের দীর্ঘ দিনের প্রচলিত সংস্কৃতি। সাকিবও সেই সংস্কৃতিতে বড় হয়েছেন। সাকিবের জন্ম যে মাগুরায়, সেখানে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মুসলিম, হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বাস করে আসছে। আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইর্ডাসের হয়ে দীর্ঘদিন খেলার কারণে কলকাতার সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় তিনি কলকাতার আমন্ত্রণে পূজা দেখতে গিয়েছেন। পূজায় অংশ নিয়ে মূলত তিনি বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতার সংস্কৃতি বজায় রেখেছেন।

সাকিব আল হাসান এমন কিছু করেননি, যেটা নিয়ে ধর্মীয় বিতর্ক হতে পারে। তারপরও তাকে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলতে হয়েছে বাংলাদেশের এখনকার বাস্তবতার কারণেই। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বাস্তবতা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন ধর্ম নিয়ে একাডেমিক আলোচনাও করা যায় না। লক্ষ করে দেখুন গত কয়েক বছরে ধর্মীয় অনুভূতির নাম দিয়ে গণপিটুনি থেকে আরম্ভ করে মানুষ খুন- সবকিছুই হয়েছে। অর্থাৎ একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে।

এসব কারণেই হয়তো সাকিব আল হাসান কোনো ঝুঁকি নেননি। তাই ভালো হোক মন্দ হোক তিনি ক্ষমা চেয়ে নিজেকে নিরাপদ করার চেষ্টা হয়তো করেছেন। যদিও তিনি কোনো দোষ করেননি, কারণ পূজা দেখতে যাওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু মহসিন নামের নরপশুরা যখন মেরে ফেলার হুমকি দেয়, তখন নিরাপত্তার জন্য আর কী-বা করবেন সাকিব? এই হিংস্র পশুরা তো আক্রমণ করার আগে দেখে না কে নিরপরাধ। সাকিবের ছোট্ট দুটো ফুটফুটে মেয়ে আছে। তাদের নিরাপত্তার কথাও বাবা হিসেবে ভাবতে হয়! এই মাস কয়েক আগেও সাকিবের মেয়ে আলাইনাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ কমেন্ট করেছিল মানুষের মতো দেখতে কিছু নরপশু!

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কারা হিন্দু বা খ্রিষ্টান- সেই বিভেদ কি আমরা করি? যারা শহীদ হয়েছেন, মা- বোন পাকিস্তানের হিংস্র পশুদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে কতজন কোন কোন ধর্মের, সেই হিসাব কি আমরা করি? করি না, কারণ আমাদের কাছে তাদের পরিচয় তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ, তাঁরা বাঙালি বাংলাদেশি।
সাকিবের এই মাফ চাওয়ার পেছনে দায় রয়েছে আমাদের সমাজ তথা রাষ্ট্রের। ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’-এর নামে মানুষের ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া, মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলার যদি সঠিক সময়ে বিচার হতো, তাহলে আজ সাকিবের মাফ চাইতে হতো না। যে সাহসী সাকিব বিশ্বের বাঘা বাঘা বোলারদের বল সীমানার বাইরে পাঠান ছয় মেরে, তেমনি ওই নরপশুদেরও দেশছাড়া করতে পারতেন কথার মাধ্যমে। আমরা যারা বাঙালি, সাকিবের খেলা যারা পছন্দ করি, তাদের সামাজিক দায়িত্ব সমাজের এসব নরপশুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। এখনই ‘জয় বাংলা’ বলে এই দেশ থেকে ওদের বোল্ড আউট করতে হবে।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, সারাক্ষণ  (সাকিবকে যারা মারার হুমকি দেয় তারা কোন দেশের মানুষ? লেখাটি সারাক্ষণ থেকে নেওয়া)

ই-মেইল [email protected]

 

এসএস/সিএ



সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন