রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক টিকবে তো?
গোলাম মওলা ।। দেশের ব্যাংকিং খাত এখন এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। যখন বেসরকারি কিছু দুর্বল ব্যাংক উদ্ধারে ব্যস্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়, তখন ভেতর থেকেই ভেঙে পড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। খেলাপি ঋণের পাহাড়, মূলধন ঘাটতি, প্রভিশন সংকট আর কমতে থাকা মুনাফায় এসব ব্যাংক আজ টিকে থাকার জন্য লড়ছে।
যদিও চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক দেশের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু আজ তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করছে। আর বিশেষায়িত ব্যাংক থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিণত হওয়া বেসিক ব্যাংকের করুণ দশা চলছে দীর্ঘদিন ধরে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যদি এখনই এই ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন, একীভূতকরণ ও কার্যকর সংস্কার শুরু না হয়, তবে এসব ব্যাংক অর্থনীতিকে সহায়তা করার পরিবর্তে একসময় অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
প্রশ্ন জাগছে—টিকে থাকবে তো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো? আর টিকিয়ে রাখতে হলে কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি?
খেলাপি ঋণের অগ্নিগর্ভ চিত্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের জুন শেষে চার রাষ্ট্রায়ত্ত (সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী) ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণ দাঁড়িয়েছে ১,৪৬,৩৬২ কোটি টাকা। মাত্র ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ শতাংশ। আশঙ্কাজনক হলো—এর মধ্যে ১,৩২,৪৯৯ কোটি টাকা বা ৯০ শতাংশই ‘খারাপ’ বা ‘ক্ষতি’ ঋণ, যা বাস্তবে আর আদায়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য মূলধন সংরক্ষণ অপরিহার্য। নীতিমালা অনুযায়ী, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ১২.৫ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার হার (সিআরএআর) ৫ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে।
ব্যাংকভিত্তিক চিত্র
জনতা ব্যাংক:
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে জনতা ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৭৬ শতাংশই খেলাপি, যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। মাত্র ছয় মাস আগেও, অর্থাৎ গত বছরের ডিসেম্বরে এই খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল ৬৭ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এই খেলাপি ঋণের ৯৩ শতাংশ ইতোমধ্যে ‘খারাপ’ বা ‘ক্ষতি’ শ্রেণিতে নেমে গেছে।
মূলধন পর্যাপ্ততার ক্ষেত্রেও ব্যাংকটির পরিস্থিতি ভয়াবহ। জনতা ব্যাংকের ক্যাপিটাল অ্যাডেকুয়েসি রেশিও (সিএআর) এখন ঋণাত্মক–৩.২৫ শতাংশ, যেখানে নিয়ম অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ বাফারসহ ন্যূনতম ১২.৫ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক।
তবে লোকসানের চাপ কিছুটা হলেও কমেছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে জনতা ব্যাংক নেট ক্ষতি দেখিয়েছে ২,০৭১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ঋণখেলাপির জালে জর্জরিত জনতা ব্যাংক এখন কার্যত টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছে। ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থাকে বিশেষজ্ঞরা ‘ডুবন্ত জাহাজ’ হিসেবে বর্ণনা করছেন।
সোনালী ব্যাংক:
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংক তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির মোট ঋণের ২০ শতাংশ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলেও তা অন্য ব্যাংকের তুলনায় অনেক কম। গত বছরের ডিসেম্বরে এ হার ছিল ১৮ দশমিক ২০ শতাংশ।
মূলধন সংরক্ষণে যেখানে অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে সোনালী ব্যাংক সক্ষমতা দেখিয়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ন্যূনতম ১০ শতাংশের শর্ত পূরণ করে।
এছাড়া জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সোনালী ব্যাংক নেট মুনাফা করেছে ৫৯১ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির আর্থিক ব্যবস্থাপনার ইতিবাচক দিক তুলে ধরে।
অগ্রণী ব্যাংক:
২০২৫ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২,২৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মোট ঋণের ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ খেলাপি, যা গত বছরের ডিসেম্বরেও একই পর্যায়ে ছিল। খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় ৮৭ শতাংশই ‘খারাপ’ বা ‘ক্ষতি’ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ হার (সিআরএআর) ১২ দশমিক ৫ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণ হার মাত্র ১ দশমিক ৯৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংক ১১৪ কোটি টাকা নেট মুনাফা করেছে। যদিও ২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে এ খাতে ব্যাংকটি ৯৩৬ কোটি টাকার লোকসানের মধ্যে পড়েছিল।
রূপালী ব্যাংক:
২০২৫ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২,১৭৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪৪ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এ হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশই ‘খারাপ’ বা ‘ক্ষতি’ ঋণ হিসেবে শ্রেণিকৃত, যা আদায়যোগ্য নয় বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, নীতিমালা অনুযায়ী ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর ১২.৫ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক হলেও রূপালী ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণ হার নেমে এসেছে মাত্র ২.৮৬ শতাংশে। এ অবস্থায় ব্যাংকটির আর্থিক টেকসইতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠছে।
লাভজনকতার ক্ষেত্রেও বড় ধস নেমেছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে রূপালী ব্যাংক নেট মুনাফা করেছে মাত্র ৮.৩৪ কোটি টাকা, যেখানে ২০২৪ সালের শেষার্ধে এই মুনাফা ছিল ৬৪.৪৯ কোটি টাকা।
বেসিক ব্যাংক:
দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে একসময় সবচেয়ে সবল হিসেবে পরিচিত ছিল বেসিক ব্যাংক। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটপাটের শিকার হয়ে ব্যাংকটি এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকের সব আর্থিক সূচক নিম্নমুখী; আমানত কমছে, ঋণ আদায় হচ্ছে না, খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে।
২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল হাই বাচ্চুকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় ব্যাংক লুটের মহোৎসব। ২০১২ সালের মধ্যে ঋণের নামে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। বিভিন্ন এলসির নামে টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। পরিণতিতে আজকের এই দুরবস্থা। বর্তমানে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছেই আটকে আছে ৫ হাজার কোটি টাকা।
একসময়কার গৌরব, আজ তলানিতে
১৯৮৯ সালে ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণ সহায়তার জন্য প্রতিষ্ঠিত বেসিক ব্যাংক দীর্ঘদিন শিল্প মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হয়। ২০০৯ সালের আগে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৩ শতাংশের নিচে। প্রতিবছর সরকারকে ৫০-৭০ কোটি টাকা মুনাফা দিতো। অথচ আজ ব্যাংক খাতের বড় সংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে, একসময়ের সেরা ব্যাংক বেসিক এখন ব্যাংক খাতের জন্য ‘বিষফোঁড়া’তে পরিণত হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন থাকা উচিত ৫ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা, অথচ রাখা হয়েছে মাত্র ৫৩৭ কোটি টাকা। ফলে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকায়। পাশাপাশি মূলধন ঘাটতি বেড়ে ৩ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা প্রতি বছরই বাড়ছে।
খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকটি বিপুল পরিমাণ সুদ আয় খরচ খাতে নিতে পারছে না। শুধু এ কারণে গত কয়েক বছরে প্রায় ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা সুদ আয় খরচ খাতে যোগ হয়নি। ব্যাংকের বার্ষিক লোকসানও বেড়েছে। ২০২০ সালে লোকসান ছিল ৩৭২ কোটি টাকা, আর ২০২৪ সালে তা দাঁড়ায় ৮৬৩ কোটি টাকায়। পুঞ্জীভূত লোকসান এখন ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
পুনর্গঠন ও একীভূতকরণ: দুর্বল ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে পুনর্গঠন বা একীভূতকরণ অপরিহার্য।
মূলধন পুনঃসংযোজন: সরকার চাইলে মূলধন ইনজেকশন দিতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলো সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা বকেয়া আদায়।
কঠোর তদারকি: বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর তদারকি ও করপোরেট গভর্ন্যান্স নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রভিশন ঘাটতি পূরণ: খেলাপি ঋণ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখতে হবে।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি ঋণগুলোকে প্রকৃত অবস্থায় দেখানো হয়নি। এখন যখন বাস্তব চিত্র সামনে এসেছে, তখন মনে হচ্ছে ঋণ এক লাফে বেড়ে গেছে।’
তার মতে, ‘শুধু আমানত সংগ্রহ ও নতুন ঋণ বিতরণ নয়, এখন সবচেয়ে জরুরি হলো রিকভারি। পাশাপাশি করপোরেট গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনও সমাধান সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সদিচ্ছা, সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ব্যাংকগুলো পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। গত ১৫ বছরের লুটপাট এক-দুই বছরে কাটিয়ে ওঠা যাবে না।’
-সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন