ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস-এর তিনটি অণুগল্প

আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস-এর তিনটি অণুগল্প


লালায়িতা প্রাণ

জৈগন বেওয়ার অসুখ হয়েছে। আত্মীয়রা  প্রতিদিনই তাকে দেখতে আসছে। যে যেখানে আত্মীয় আছে। আসার সময় হাতে করে কেউ না কেউ কিছু না কিছু নিয়ে আসছে। কেউ ফল, কেউ বিস্কুট, কেউবা হরলিক্স। কিন্তু জৈগন বেওয়া সে সবের কিচ্ছুটি মুখে করছে না। ফলে তার বিছানার পাশে সব গুলো ডাঁই লেগে আছে। তা দেখে ছেলে পলাশ তার পাশ খানে গিয়ে বসল—-মা!
—-কে, খোকা!
—-হ‍্যাঁ, মা।
—-কী হোলো, বুল!
—-তুমি কিছু খাচ্ছ না কেন, মা!
জৈগন বেওয়া বলল—-কী কইর‍্যা খাবু বুল,খাতে যে কুচ্ছুু ভাল্লাগছেনা। এ্যা সবের দিকে ঘুইর‍্যা তাকাতেও না।
—-তাহলে অন্য কিছু খাও!
—-অন্য কুছু কী খাবু?
—-চিকেন, বিরিয়ানি, কাবাব, কোপ্তা…..
—-অসব খালে যে এ্যাকদিনও বাঁচবু না; বদ হজম হইয়‍্যা প‍্যাট ফুইল‍্যা মইর‍্যা যাবু। প‍্যাটে অসব সহাবে না।
—-তাহলে কী খেতে চাও বল, তুমি যা খেতে চাইবে তাই এনে দিব।
—-আমি যা খাতি চাহাব তাই আইন‍্যা দিবি?
—-হ‍্যাঁ, তুমি শুধু বল।
—-সত্যি বুলছিস?
—-হ‍্যাঁ মা, সত্যি বলছি।
—-কিন্তু সে জিনিস কি শহরে পাবি? শহরের মানুষ কি সে জিনিস খায়?
—-কী জিনিস তুমি বল না, শহরে পাওয়া যাবে না এমন জিনিস নেই। টাকা দিলে সব  পাওয়া যাবে। এমনকি বাঘের দুধ পর্যন্তও। এটা তো আর আমাদের পুরনো সেই কাশিমপুর গ্রাম না যে, কিছু পাওয়া যাবে না। যাইহোক, তুমি আর দেরি করোনা মা, চট করে বলে ফেলো!
—-বুলছি। তার আগে তুই বুল, এডা কী মাস চলছে? ভাদোর মাস না?
—-হ‍্যাঁ, এটা ভাদ্র মাস চলছে। কিন্তু মাস নিয়ে তুমি কী করবে?
—-না মানে, আমি বুলতি চাহাচি যে, ভাদোর মাসে ভাদই ধানের চালের পানি দ‍্যাওয়া বাসি ভাত কাঁচা পিঁয়াজ আর নুন-মরিচ দিইয়‍্যা মাইখ‍্যা খাতে খুব ভাল্লাগে। যা অমৃতের চাইহ‍্যাও বেশি সুস্বাদু! তাই, আমি তুর কাছে ভাদই ধানের পানি দ‍্যাওয়া বাসি ভাত খাতে চাহাচি। তুই আইন‍্যা দিলে আমি প‍্যাট ভইর‍্যা খাবু। হ‍্যাঁ খোকা, আমি প‍্যাট ভইর‍্যা খাবু। তুই কি আইন‍্যা দিতি পারবি?
—-কিন্তু মা, তোমার বুকে যে এখন প্রচুর কফ বসে আছে। পানি দেওয়া বাসি ভাত খেলে তুমি বাঁচবে? সঙ্গে সঙ্গে আরও কফ বসে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হয়ে মারা যাবে না? আমি ছেলে হয়ে সেটা পারি কী করে বল! তার চাইতে তুমি আগে ভাল হয়ে ওঠো, তারপর না হয় একদিন খেও। আমি এখন তোমাকে ওসব এনে দিতে পারব না।
জৈগন বেওয়ার মনটা তো খারাপ হলই শুনে, পানি দেওয়া বাসি ভাতের জন্য তার প্রাণটাও লালায়িতা হল।
————

জমেলা বিবির ছাগল


পথের ধারে নিত্য পথচারীদের চেনা ভাঙা বাড়িটা হল জমেলা বিবির। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে সবাই ঘর পেলেও জমেলা বিবি পায় নি।
তবে বছর খানেক আগে তার নামে একটা ঘর এসেছিল; পাড়ার মেম্বার তার উঠোনে দাঁড়িয়ে তার কাছে কুড়ি হাজার টাকা চেয়েছিল,” তোমার নামে ঘর বেরিয়েছে, কুড়ি হাজার টাকা দাও।”
“সরকার ঘর দিছে, টাকা দিব ক‍্যানে?”
“ঘরটা তোমার নামে আমরা বের করে এনেছি যে। তাছাড়া ঘর যারা পায় সবাই টাকা দেয়। তাই, তোমারও টাকা লাগবে।”
“না ভাই, আমি টাকা দিতি পারব না। গরিব মানুষ, টাকা দিব কুনঠে থিক‍্যা। তবে তুমরা এ্যাক কাজ করলি করতি পারো, তুমরা অতে থিক‍্যা কুড়ি হাজার টাকা কেটে লিও! ঘরডা আমাকে দ‍্যাও ভাই! দেকতিই পাছো, ঘরের আমার ক‍্যামুন কষ্ট! একটা ঘর আমার খুব দরকার। কুটুম আলে শুতি দিতি জায়গা পাই ন‍্যা!”
“কিন্তু ও রকম সিস্টেমে যে এসব কাজ হয় না, টাকা তোমার আগেই লাগবে।”
“তাহিলে যে দিতি পারনু না ভাই, আমার অবস্থার কথা তুমরা তো সবই দেখতি পাছো, সবই জানছ।”
মেম্বার তখন তার নামটা কেটে দিয়ে অন্য একটা নাম ঢুকিয়ে দেয়। সে হয়তো পয়সা দিবে।

জমেলা বিবির স্বামী রহমত সেখ একজন অক্ষম মানুষ। একটা লরিতে সে কাজ করত। বছর পাঁচেক আগে লরিতে কাজ করতে গিয়ে ওই লরিতেই তার পা দুটো চলে গেছে। জমেলা বিবি এখন হাঁস, মুরগি ও ছাগল পুষে সংসার চালায়।
তার বাড়িতে এখন চারটে ছাগল রয়েছে। চারটেই হল ধাড়ি ছাগল এবং বেশ জাতের ছাগল। বছরে দু’ বার করে বিয়ান দেয়। তার উপর আবার প্রতিটি ধাড়ি চারটে করে বাচ্চা দেয়। ওই সব বাচ্চা বেচেই জমেলা বিবি সংসার চালায়। যে কারণে ছাগলের প্রতি সে খুব যত্নবান। না হলে শীতে ছাগলের যদি ঠাণ্ডা লাগা অসুখ হয়ে যায়!
গত বছর খুব যখন ঠাণ্ডা পড়ছিল তখন তার কয়েকটা বাচ্চা ঠাণ্ডা লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। এ বছর তাই সে খুব বেশি ঠাণ্ডা পড়ার আগেই বাচ্চা গুলো বেচে দিয়ে ধাড়ি গুলোর আগাম যত্ন নেওয়া শুরু করেছে। যাতে ধাড়ি গুলোর ঠাণ্ডা লাগা অসুখ না হয়। তাইতো, সে ছাগলের মাথায় গরম তেল আর গায়ে সব সময় চট জড়িয়ে রাখে। আবার ছাগলের ঘরে খড় বিছিয়ে দিয়ে বিছানাও করে রাখে এবং বেড়ার ফাঁক দিয়ে যাতে বাতাস ঢুকতে না পারে তার জন্য পলিথিন টাঙিয়ে রাখে। সব মিলিয়ে তার ছাগল যাতে সুরক্ষিত থাকে তার ব‍্যবস্থা করে রাখে। ছাগলই যে তার সব। ছাগল ছাড়া তারা যে….
কী ভালো জমেলা বিবির ছাগল!
————-

ধান‍্য দেবী পুজো


এ বাড়ির বৌ হয়ে আসা কামিনীর খুব বেশি দিন হয় নি। ফলে এখানকার পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে তার তেমন ধারণা নেই। সন্ধ্যা হতে না হতেই তাই সে পিছনের জানলা বন্ধ করে দেয়। না হলে পিছনের মাঠ থেকে যদি কোন মেঠো ভূত এই বড় বড় দাঁত বের করে তাকে ভয় দেখায়! স্বামী তো আর সব সময় ঘরে থাকে না। ব‍্যাটা ছেলে মানুষ কখন, কোথায় বেরিয়ে যায়।

কিন্তু কামিনী একদিন জানলা বন্ধ করতে ভুলে যায়। সেদিনই আবার তার স্বামী কলকাতা যায়। তারপর এক ঘুম পেড়ে উঠে অনেক রাতের দিকে যখন জানলা বন্ধ করতে যায় কামিনী মাঠে একটা জিনিস দেখতে পায়।

মাঠে এখন ধান চাষ রয়েছে। কিছু কিছু ধান পাকতেও শুরু করেছে। সব ধান পাকেনি। তবে কিছু দিনের মধ্যে সব ধান পেকে যাবে। সোনালি রং ধরতে শুরু করেছে। চাষিরা তখন মহা উল্লাসে সেই ধান কাটতে শুরু করবে। চাষিদের কাছে ওটা একটা মহা উৎসব।

কামিনী দেখতে পায়, চাঁদের আলোয় একটি সুন্দরী ললনা; মাঠে মাঠে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পরনে অতি মূল্যবান ঝলমলে পোশাক আর দুই হাতে ধানের দুটো শিষ। শিষ দুটো মাঝে মাঝে কোন না কোন ধানের মাথায় ঠেকাচ্ছে।…
সব মিলিয়ে একটি চমৎকার দৃশ্য!

কিন্তু দৃশ‍্যটি কামিনী বেশিক্ষণ দেখে না, হড়াম করে জানলা বন্ধ করে দেয়।

পরের দিন শাশুড়ি মায়ের কাছে কামিনী গল্পটি করলে তিনি বলেন যে, ও হল ধান‍্য দেবী, ধানের ফলন বৃদ্ধি করা হল ওর কাজ। ধান উঠে যাওয়ার পর চাষিরা ওর নামে সবাই পুজো করে, ধান‍্য দেবী পুজো।
—————-
আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস- লেখক, গল্পকার। মুর্শিদাবাদ।পশ্চিম বঙ্গ,ভারত।

 





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন