লেখালেখি

কোভিড-১৯ এবং এলকোহল গার্গেলের বিপদ

এলকোহল-গার্গেলের-বিপদ

কোভিড-১৯ এবং এলকোহল গার্গেলের বিপদ!

বাংলাদেশের কিছু পত্রিকা আর কতিপয় টেলিভিশন মিডিয়ায় কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এলকোহল/ইথানল/ইথাইল এলকোহল দিয়ে গার্গেল/কুলকুচি এমন কি নাকে ভাপ দেবার উপকারিতা বিষয়ে ধারণা ভিত্তিক আলোচনা জনগণের মধ্যে কৌতূহলের আর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের মত দেশে যেখানে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে ওষুধ কিনে খাবার সংস্কৃতি প্রচলিত আছে, সেখানে কোভিড-১৯ এর বিশ্বময় কঠিন পরিস্থিতিতে, মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে ক্লান্ত, শ্রান্ত, মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীর জন্যে এধরণের আলোচনা এবং এ থেকে সৃষ্ট কৌতূহল জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

এলকোহল গার্গেলের বিপদ: উচ্চ ঘনত্বের ইথাইল এলকোহল দিয়ে গার্গেল করা কিংবা নাকে বাস্প নেওয়া অত্যন্ত বিপদজনক। উচ্চ ঘনত্বের যেমন ৪০-৫০% মাত্রার এলকোহল আমাদের নাকের, মুখের ভেতরে যে স্পর্শকাতর মিউকাস মেমব্রেন বা ঝিল্লী থাকে তা ক্ষতিগ্রস্ত করে রক্তপাত ঘটাতে পারে। ইথানল বাস্প ব্রেইনে চলে গেলে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। করোনা/কোভিড-১৯ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি ওয়েব পেজ আছে “মিথ বাস্টারস” নামে যেখানে এই ভাইরাসটির চিকিৎসা নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা সম্পর্কে তথ্য আছে। সেখানে এটি পরিষ্কার বলা আছে এলকোহল নাক এবং মুখের ঝিল্লির জন্যে ভীষণ ক্ষতিকর।

বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে দেখা যায় কোভিড -১৯ এ আক্রান্ত ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জন এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। ১০ শতাংশের মত হার্ট, উচ্চ রক্তচাপ বা ফুসফুসের সমস্যা সহ অন্যান্য জটিলতায় হাসপাতালে যেতে হয়। হাসপাতালে এই গ্রুপের প্রয়োজনে অক্সিজেন এমনকি ICU তে ভেন্টিলেটরের সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়। তাঁদের ক্ষেত্রে ইথাইল এলকোহলের গার্গেল বিষয়ে অবশ্য কোন বক্তব্য আসেনি। যে ৯০% এমনিতেই ভাল হয়ে যায়, তাঁদের ক্ষেত্রে এলকোহল গার্গেলের প্রস্তাবনা এসেছে যেটি ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ একটি প্রস্তাব।

ইংরেজীতে “ট্রেড অফ” বলে একটি কথা আছে যাকে সোজা বাংলায় বললে “কোন কিছুর বিনিময়ে কোনকিছু পাওয়া”। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি গুরুতর ইথিক্যাল এবং লিগ্যাল প্রশ্ন। উপকার আর অপকারের মাঝে যে ডেল্টা বা পার্থক্য, জনস্বাস্থ্যের যে কোন গবেষণা শুরুর আগে এই প্রশ্নটির মীমাংসা প্রাথমিক কাজ। এটির মীমাংসা ছাড়া হাইপোথেসিস দাড় করানো অনৈতিক। জনস্বাস্থ্যে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সেফটি রেগুলেটরি সংস্থাগুলোর তথ্য-উপাত্ত, বিধি নিষেধ যাচাই বাছাই না করে গবেষণা কার্যক্রমের ধারণা আসলে দিনশেষে “এন্ডআপ উইথ নাথিং”। যে কোন একশনে বিশেষ করে রোগ বালাই বিষয়ক গবেষণায় ফাংশনের চেয়ে মানুষের সেফটি নিশ্চিত করাটাই প্রাথমিক শর্ত।

কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই এটা সবার জানা ৬০% এর উপরের ঘনত্বের ইথাইল এলকোহল দিয়ে ত্বকের উপরিভাগের/সার্ফেসে থাকা SARS CoV-2 ধ্বংস করা যায়। উত্তর আমেরিকায় ফার্মাসিতে ৫০% ইথানল কিনতে গেলে উনারা সতর্ক করে দেন যে এতে SARS CoV-2 ধ্বংস করা যাবে না আর এটি শুধু ত্বকের উপরিভাগের/সার্ফেসের জন্যে প্রযোজ্য। জীবানুনাশক হিসেবে ৭০-৮০% ইথানল, ৭৫% আইসোপ্রোপাইল এলকোহল, ০.১২৫% হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড। ইথানলে তো ব্যাকটেরিয়াও মারা যায়, তো টনসিল বা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে কিন্তু মেডিক্যাল সায়েন্স এলকোহল দিয়ে গার্গেলের পরামর্শ দেয়না। পানি-ইথানলের মিশ্রনের ভাপ নেবার বিপদজনক পরামর্শ এসেছে সাইনাসের ভেতরের করোনা মারা জন্যে। সাইনাসের ভেতরের মিউকাস মেমব্রেন বা ঝিল্লি খুবই স্পর্শকাতর। গবেষণায় দেখা যায় উচ্চ ঘনত্বের এলকোহলে এই মেমব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রক্তপাত হতে পারে যা প্রথমেই বলেছি। পানি ফুটে ১০০ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেডে আর ইথানল ৭৮ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেডে, ফলে পানি-ইথানলের মিশ্রনের ভাপ থেকে অনেক বেশী ঘনত্বের ইথানল নাকে যাবে যা মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এলকোহল বাস্পের আসক্তিজনিত এবং অন্যান্য মারাত্মক পরিনতি নিয়ে তো গবেষণা প্রবন্ধের কমতি নেই। ইউএস FDA এর নির্দেশনা হচ্ছে ওরাল ড্রাগে ১০% এর বেশী ইথানল ব্যবহার করা যাবে না। বাচ্চাদের ড্রাগে এটি ৫% এর বেশী নয়, আর ৫ বছরের নীচের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এলকোহলই ব্যবহার করা যাবে না।

সাইনাসের সমস্যা হলে, লবণ পানি দিয়ে নাক, মুখ রিঞ্জ করতে আমরা অভ্যস্ত এবং ডাক্তারদের পরামর্শ সে রকমই । উচ্চ ঘনত্বের লবণ পানি গলা নাক পরিষ্কার করে, ব্যাকটেরিয়া ভাইরাল লোড কমিয়ে আনে ফলে আরামবোধের কারণ হয়। কোভিড-১৯ এ যাদের হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয় না, তাঁদের জন্যে এটি সহায়ক। লবণ পানির মত নির্দোষ ধরণের ব্যবস্থাপনায় যে উপকার/আরাম পাওয়া যায়, সেই একই ধরনের বা কাছাকাছি উপকার/আরামের জন্যে অতি উচ্চ ঝুঁকির এলকোহল ব্যবহারের ভাবনাটুকু মোটেও বিবেচনা প্রসূত নয়।

এলকোহল গার্গেলের বিপদ:

এলকোহলের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যে সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিষয়। জীবানুনাশক বা অন্য প্রয়োজনে এর ব্যবহারের বদলে অপব্যবহারের উদাহরণ তো কম নয়। কোভিড-১৯ কে কেন্দ্র করে SARS CoV-2 ভাইরাসের হাত থেকে মুক্তির আশায় ইরানে এলকোহল পানে মৃত্যুর ঘটনা, কিংবা আফ্রিকায় ডেটল খেয়ে মৃত্যুর উদাহরণ তো আমরা জানি। কানাডার টিভি চ্যানেলগুলো বরাবরের মতই দায়িত্বশীল ভূমিকায় এই ধরণের বিপদের হাত থেকে জনগণকে বাঁচাতে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছে আর হেলথ কানাডা ডাটাবিহীন ব্যবস্থাপত্রের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে। অতএব বুঝতেই পারছেন, এলকোহল নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভাল।

সামাজিক আর শারীরিক দূরত্ব, হাত/মুখ জীবাণুমুক্ত রাখা, নাকে/মুখে/চোখে হাত লাগানোর অভ্যেসটি কঠিনভাবে দমন সহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর সরকারের নির্দেশনা কঠোরভাবে মানতে পারার মধ্যেই করোনা থেকে বেঁচে থাকার আপাতত একমাত্র ফলপ্রসূ উপায়। নিরাপদে থাকবেন সবাই আশেপাশের সকলকে সাথে নিয়ে।

ডঃ  শোয়েব সাঈদ ।। মন্ট্রিয়লের বায়োটিক বিষয়ক বহুজাতিক কর্পোরেট গবেষণা পরিচালক হিসেবে কর্মরত, সাবেক বাকসু’র সাবেক সাহিত্য সম্পাদক এবং সিবিএনএ২৪ডটকমের উপদেষ্টা।

 

সিবিএনএ/এসএস

 


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × three =