ওয়াজে জঙ্গীবাদ উসকে দেয়া ১৫ বক্তা চিহ্নিত
সারাদেশে ইসলামী জলসায়, ওয়াজ মাহফিলে, ফেসবুক, ইউটিউবে বিভ্রান্তিকর, উস্কানিমূলক, উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদে উৎসাহ দেয়া এমন ১৫ বক্তাকে চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। এর মধ্যে একটি জেলায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে ৩ বক্তাকে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মধ্যেও প্রশাসনের কোন অনুমতি না নিয়েই ইসলামী জলসা, ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এই ধরনের আয়োজক ও বক্তাকে নজরদারিতে রাখাসহ ৬ দফা সুপারিশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। সংস্থার ৬ দফা সুপারিশ পাঠানো হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ইসলামী জলসা, ওয়াজ মাহফিল, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ধুম পড়ে যায় শীত মওসুমে। করোনাভাইরাসের মধ্যেও দেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে ইসলামী জলসা, ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ব্যাপক আয়োজন হচ্ছে। এসব অনুষ্ঠান করার আগে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নেয়া অপরিহার্য। কিন্তু আয়োজকরা প্রশাসনের কোন অনুমতি না নিয়েই এই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চলেছেন। এসব অনুষ্ঠানে যেসব বক্তা থাকেন তাদের নামের আগে ও পরে বড় আলেম, ওলামা মাশায়েক, আউলিয়া, হুজুর পদবির ব্যক্তিগণ বক্তব্য রাখেন। নামের আগে ও পরে এই ধরনের পদবির ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ আল্লাহ, রসুল, দ্বীন ও ধর্মের প্রচারের নামে বিভ্রান্তিকর, উস্কানিমূলক, উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িক, জঙ্গীবাদে উৎসাহ দেয়া এমন বক্তব্য দিচ্ছেন। শুধু জলসা বা ওয়াজ মাহফিলেই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবে জ্বালাময়ী বক্তব্যসহ বক্তা ও অনুষ্ঠানের ব্যাপক ছবি ভাইরাল হয়ে চলেছে। এতে দেশে উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গীবাদ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ওয়াজে জঙ্গীবাদ উসকে দেয়া ১৫ বক্তা চিহ্নিত।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যাপক হারে পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। এতে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবের ইসলামী জলসা ও ওয়াজ মাহফিলের ভিডিও ছবি ভাইরাল করা হচ্ছে, যাতে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ ছড়ানোর আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, কিছু কিছু বক্তা বক্তৃতায় নারী অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্বেষ বা হিংসা ছড়াচ্ছেন। এই ধরনের ১৫ বক্তাকে চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামী জলসা ও ওয়াজ মাহফিলের কিছু বক্তা সাম্প্রদায়িক উস্কানি, জঙ্গীবাদে উৎসাহ, নারী অধিকার, বাংলা নববর্ষ, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ভাস্কর্যসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উস্কানি ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ধর্মের নামে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং শোবিজ তারকাকে নিয়ে বিষোদগার করা হয়। দেশের গ্রাম-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে এই ধরনের কিছু বক্তা যাচ্ছেন এবং তারা এখন ইউটিউবসহ সামাজিক নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করেও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ধর্মের নামে বিভ্রান্তিকর ফতোয়া দিয়ে দেশব্যাপী উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুর, মামলা দায়ের, গ্রেফতার, রিমান্ডে নেয়া, কারাগারে নিক্ষেপসহ আইনী পদক্ষেপ নেয়ার মতো ঘটনা ঘটে গেছে। এ ছাড়া দেশের কোন কোন স্থানে সাম্প্রদায়িক উস্কানির ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এমনকি কোন কোন স্থানে অপ্রতিকর ঘটনা ঘটেছে, যাতে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করা অসঙ্গতিপূর্ণ। সরকার কঠোর হস্তে এই ধরনের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রন করায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারেনি।
বিভ্রান্তিকর, উস্কানিমূলক ও উগ্রবাদকে উৎসাহিত করার মতো বক্তব্য দেয় এমন অভিযোগ করে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কাছে তিন বক্তার নাম নির্দিষ্ট করে অভিযোগ করেছেন কুমিল্লা জেলার স্থানীয় লোকজন। এরপর কুমিল্লা জেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুমিল্লা জেলা এলাকায় নিষিদ্ধ করা হয় তিন বক্তাকে। তাদেরকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বিষয়টি জানিয়ে তা কার্যকরের কথা বলা হয়েছে। যেই তিন বক্তার বিরুদ্ধে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তার মধ্যে একজন বেসরকারী টেলিভিশনে ধর্মীয় বক্তব্য দেয়ার জন্য পরিচিত।
গোয়েন্দা সংস্থার ৬ দফা সুপারিশে বলা হয়েছে, যেসব বক্তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্মীয় রাজনীতি বা মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন বক্তারাই বিভ্রান্তিকর, উস্কানিমূলক, উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িক, জঙ্গীবাদে উৎসাহ দিচ্ছে। এই ধরনের কয়েক বক্তার কারণে ইসলামী জলসা বা ওয়াজ মাহফিল নিয়ে যাতে ভ্রান্ত কোন ধারণার সৃষ্টি না হয় সেজন্য বিভিন্ন সুপারিশ রয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, মাদ্রাসায় উচ্চ শিক্ষকদের মধ্য থেকে ওয়াজের জন্য বক্তা হিসেবে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করার সুপারিশ অন্যতম। এছাড়া সুপারিশে বলা হয়েছে, ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের যারা হেলিকপ্টারে গিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ নেন, তারা আয়কর দেন কিনা, তা আয়কর বিভাগ খতিয়ে দেখতে পারে। ওয়াজ মাহফিলে কোন বক্তা উস্কানি ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিলে স্থানীয় প্রশাসন তাদের সতর্ক করতে পারে। প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে তাদের ওয়াজ করার অনুমতি না দেয়ার ব্যবস্থা নিতে পারে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারীদের আইনের আওতায় আনার সুপারিশও করা হয়েছে। ওয়াজ মাহফিল মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করার বড় একটা মাধ্যম। এবাদতকে যদি কেউ বিনোদনের মাধ্যম বানিয়ে নেয়, অথবা অশ্লীল অথবা অশালীন কোন ব্যঙ্গবিদ্রƒপ করে অথবা আইনের বিরুদ্ধে আইন হাতে তুলে নেয়ার মতো অবস্থা হয়, এই ধরনের কাজের জন্য একটি বিশেষ টিম বা সেল গঠন করে এর একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কোন বক্তার কোন রাজনৈতিক পরিচয় আছে কিনা, এছাড়া ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমে এবং অন্য কোন এলাকায় আগে বিতর্কিত বা উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন কিনা – এসব বিষয় খতিয়ে দেখার পর সীমিত পরিসরে জমায়েতের অনুমতি দেয়া যেতে পারে।