এর আগে বহু মন্ত্রী নেতার মন্তব্য নিয়ে এগিয়ে চলো থেকেই কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়ানো বাসন্তী হলুদ সাংবাদিকতার গল্প!
বসন্ত ঢল নামিয়েছে হলুদের, সাংবাদিকেরা পিছিয়ে থাকবে কেন? শুধুমাত্র মুখরোচক শিরোনাম করার জন্য মনের মাধুরী, ঐশ্বর্য মিশিয়ে তারা যে সংবাদ পরিবেশন করেছেন তার থেকে পাবলিক টয়লেটের পরিচ্ছন্নতার মানও ভালো থাকে আজকাল।
এ ধরণের ‘সাংবাতিকতায়’ ভালোমত গবেষণা বা খোঁজ খবর না করেই দৃষ্টিগ্রাহী ও নজরকাড়া শিরোনাম দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। এই হলুদ সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য হলো সাংবাদিকতার রীতিনীতি না মেনে, যেভাবেই হোক খবরের কাটতি বাড়ানো। সহজ শব্দে ব্যবসা। ব্যবসা যেখানে মূখ্য, নীতি সেখানে বাংলা সিনেমার আনোয়ার হোসেনের মতোই বুকে হাত দিয়ে মৃত্যুবরণ করে প্রতিনিয়ত।
গতকাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়া ভেসে যাচ্ছে কচুরিপানায়। আমাদের মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান নাকি বলেছেন, ‘গরু কচুরিপানা খেতে পারলে আমরা পারবো না কেন?’ কেউ ঘুরিয়ে লিখেছেন, ‘সবাইকে কচুরিপানা খাওয়ার পরামর্শ দিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।’ এর জবাবে কেউ বলেছেন, ‘কচুরিপানা খাবেন ভালো কথা, তবে গাভীর মতো খাঁটি দুধও দিতে হবে।’
এমন হাস্যরসের খোরাক কি আর সহজে ছেড়ে দেয়া যায়? আগ্রহ নিয়ে মন্ত্রী সাহেবের কনফারেন্সের ভিডিওটি দেখলাম। পাঁচ মিনিটের ভিডিওটি পরপর দুইবার কম্পাইল করে দশ মিনিটের ভিডিও বানিয়েছে সময় টিভি, যার চার মিনিটের দিকে তিনি কচুরিপানা খাওয়ার কথা বলেছেন। তার আগে পরে কী বলেছেন আমরা কি জানি? না জানি না। কারণ, আমরা কচুরিপানা নিয়ে ট্রল করতেই ব্যস্ত হয়ে গেছি।
সেই কনফারেন্সে মন্ত্রী সাহেব বাংলাদেশের কৃষি রুপান্তর নিয়ে বহু কথাই বলেছেন। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় রুপান্তর কৃষিতেই হয়েছে উল্লেখপূর্বক নিজেকে গ্রামের ছেলে এবং কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছেন, একটা সময় গ্রাম বাংলায় মৌসুমের প্রথম কাঁঠাল খাওয়াটাও উৎসবের মতো ছিলো। সেই বড় বড় কাঁঠালের মান ঠিক রেখে সাইজে ছোট করার কথাও বলেছেন।
ঠিক যেভাবে বহির্বিশ্বে বড় বড় ফলমূল গবেষণার মাধ্যমে সাইজে ছোট করে উৎপন্ন এবং রপ্তানি করা হয়। উপস্থিত কৃষিবিদদের কাছ থেকে নতুন নতুন উদ্ভাবনের দাবী করেছেন। এ দাবী জানিয়ে, উনি কচুরিপানা নিয়ে কিছু একটা করতে বলেন। এমন সময় ঠাট্টাছলে বলে ওঠেন, আচ্ছা আমরা কি কচুরিপানা খেয়ে ফেলতে পারি না? আর তখনই পেছন থেকে কেউ একজন বলেন, গরু খায় স্যার। তখনো হাসিরধারা অব্যাহত রেখে তিনি সেই ব্যক্তিকে উত্তর দেন, গরু খেতে পারলে আমরা কেন পারবো না?
আমরা যারা শহরে বড় হয়েছি, তারা হয়তো গ্রামাঞ্চলে কচুরিপানার প্রভাব সম্পর্কে অবগত নই। বিশেষ করে ভাটি অঞ্চলে এটি একটি বড় সমস্যা। উজানের ঢলে নদী থেকে এসব কচুরিপানা ভিড় জমায় এবং খুব দ্রুত জন্মাতে থাকে। ফলশ্রুতিতে পানি প্রবাহে ব্যঘাত ঘটায়। চলাচল কিংবা পানিতে ডোবা শস্যক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। আমাদের কাছে কচুরিপানা হাস্যকর হলেও গ্রামবাসী বা কৃষকদের কাছে এটা অবশ্যই গুরুত্ববহন করে।
এই কচুরিপানা পরিস্কার করা যে কী পরিমাণ পরিশ্রমের কাজ সেটা এই শহুরে মানুষ আমরা হয়তো সহজে বুঝবো না। ট্রল করে উড়িয়ে দেবো। এ কারণেই পরিকল্পনামন্ত্রী কৃষিবিদদের গবেষণা কাজে লাগিয়ে কচুরিপানা প্রক্রিয়াজাত করার কথা বলেছেন। সেই কথাচ্ছলে হাস্যরস করতে গিয়ে কচুরিপানা খেয়ে ফেলার কথা বলেছেন। এখানে উল্লেখ্য, জাপান-কোরিয়ার মত উন্নত দেশে ‘সিউইড’ মানে সামুদ্রিক শ্যাওলা পুষ্টিকর খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এটিও সম্ভব হয়েছে প্রক্রিয়াজাতকরণের ফলেই।
একই কনফারেন্সে তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি কোনো এক ফ্লাইটে একটি ম্যাগাজিনে তিনি কৃষির রুপান্তর সম্পর্কিত আর্টিকেল পড়েছেন। সেখান থেকে তার অভিপ্রায় জাগে বাংলাদেশে কৃষি রুপান্তরে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার। এ ব্যাপারে তিনি ক্যাবিনেট মিটিং এ প্রধানমন্ত্রীর সাথে সরাসরি কথাও বলেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে ফান্ডিং এর আশ্বাস দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তির তাগিদ দেন। সেই তাগিদ থেকেই তিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন।
‘কচুরিপানা খাওয়া’ নিয়ে বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ‘বিষয়টি এমন নয় যে কচুরিপানা খেতে বলেছি। কাঁঠাল-কচুরিপানা নিয়ে আরও গবেষণা করা যায় কিনা সে কথা বলেছি। আমি নিজেও ছোটবেলায় কচুরিপানার ফুল খেয়েছি। মা বেসন দিয়ে ভেজে দিতেন। বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হবে। আমরা একটা সংরক্ষণবাদী জাতি। পান থেকে চুন খসার প্রবচন আর কোনও ভাষায় আছে কিনা জানি না। এসব ব্রাহ্মণ্য ছুৎমার্গ বাদ দিতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘গবেষণা হবে সীমাহীন। এটা বলা যাবে না, এটা করতে পারবেন না, জাত গেলো— এসব ছাড়তে হবে। আমি বলেছিলাম, কচুরিপানা নিয়ে গবেষণা করেন। কেউ যদি খেতে পারে ক্ষতি আছে? কেউ একজন সেসময় বললো, কচুরিপানা গরু ছাগল খায়। থাই গবেষকরা গবেষণা করে পেয়ারা থেকে বিচি উঠিয়ে দিয়েছে, আমরা খাচ্ছি। এসব প্রযুক্তি কি আমাদের দেশে সম্ভব না? সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলেছি, আরও গবেষণা করেন। কাঁঠালের আমসত্ব একসময় বইয়ে ছিল, এখন বাস্তবে আছে। এসব তো হয়েছে। আমি নাকি মানুষকে বলেছি কচুরিপানা খান। এটা আমি বলিনি। আমি কি বাঙলার মানুষ না, আমার বাবা-মা কি বাঙলার মানুষ না? কচুরিপানা ফুল আমি নিজে খেয়েছি। বেসনে ভেজে মা খাইয়েছেন। এসব মিস করি।’
আসুন, ট্রল করার আগে আলোচ্য কথাগুলো বলা মানুষটি সম্পর্কে আগে জেনে নিই। বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ছিলেন সাবেক সিএসপি কর্মকর্তা। তিনি কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রাম জেলার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর যুগ্মসচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এর মহাপরিচালক এবং এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এম এ মান্নান ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন শেষে সরকারী চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আমাদের ক্যাবিনেটে এমন একজন বিজ্ঞ লোক আছে সেটা হয়তো আমরা জানিই না। আমরা জানি শুধু ট্রল করতে। আমাদের মন্ত্রী মিনিস্টারেরা নিয়মিতই বেফাঁস মন্তব্য করে সমালোচিত হয়ে থাকেন। আমরা হয়তো অপেক্ষাতেই থাকি কে কখন কী বলবে আর আমরাও শুরু করে দেবো পচানো। অথচ কে কোন সেন্সে কী বলছে সেটার ব্যাপারে জানার আগ্রহ নেই কারোই। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের কাছে কমন সেন্স পৌঁছানোর আগেই ইন্টারনেট প্যাকেজ পৌঁছে গেছে।
এখানে আলাপটা হচ্ছে, তিনি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া কোনো রাজনীতিবিদ না। একজন যোগ্য মানুষ। হাজারো অযোগ্য লোকের ভিড়ে এই যোগ্য মানুষগুলোকে আমরা সঠিক মূল্যায়ন করতে পারি না। আর তাই এমন লোক নীতিনির্ধারক পর্যায়ে টিকে থাকতে পারে না। এর আগে বহু মন্ত্রী নেতার মন্তব্য নিয়ে এগিয়ে চলো থেকেই কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এবার ব্যাপারটি ভিন্ন। হলুদ সাংবাদিকতার পাল্লায় পড়ে, পাইকারি দরে ট্রল করা মেনে নেয়া যাচ্ছে না আসলে।
এখানে সাধারণ মানুষদের ওপর একপেশে দোষ চাপানোটাও যৌক্তিক নয়। আমাদের কাছে এমন মুখরোচক শিরোনামে যারা খবর পরিবেশন করেন এটা তো তাদের দায়িত্ব। বসন্তের উৎসবে যেসব ‘সাংঘাতিক’ সাংবাদিকেরা হলুদের ছোঁয়ায় রাঙিয়ে দিচ্ছেন এমন শিরোনাম, তারা কী একটু দায়িত্ববান হতে পারেন না? এটা তো আর রকেট সায়েন্স না। তাই না?
মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী কচুরিপানা নিয়ে আসলে কী বলতে চেয়েছেন আর হলদে মিডিয়া আমাদের কী বুঝিয়েছে সেটা নিজেই দেখে নিন। এই লিংকে ক্লিক করে ১০ মিনিটের সম্পূর্ণ ভিডিওটি দেখতে পারেন। তারপর না হয় নিজেই ঠিক করে নিন- লোকটা কথাগুলো বলে কি খুব বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন কিনা।
আরও পড়ুনঃ