কাউন্টডাউন স্টার্টস: থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো…
সাইদুজ্জামান আহাদ ।। ব্লগারদের যখন হত্যা করা হয়েছে, আপনি চুপ ছিলেন। যখন ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে, পূজার সময় প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে, আপনি আওয়াজ তোলেননি। কাল আপনাকে যখন জুয়েলের মতো পিটিয়ে, পুড়িয়ে মারা হবে, তখন কেউ কথা বলবে না। কারন আপনার হয়ে যাদের প্রতিবাদ করার কথা ছিল, তারা অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে…
ভারতীয় সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে অনেকেই হয়তো চিনবেন। ২০১৯ সালে প্রথমবার তৃণমূল কংগ্রেস থেকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক এই ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার। অভিষেকেই ভারতীয় ফ্যাসিবাদ নিয়ে তার দেয়া একটা বক্তব্য আলোড়ন তুলেছিল ভারতজুড়ে, তিনশোর বেশি সরকার দলীয় সাংসদের চিৎকার-চেঁচামেচির মাঝখানেও অকপটে নিজের কথাটা বলে গিয়েছিলেন মহুয়া, তরুণ এক রাজনীতিবিদের এমন ভাষণ ভারত অনেকদিন শোনেনি।
মহুয়া মৈত্রের কথা কেন আনলাম? উগ্রবাদী হিন্দুদের নেতৃত্বে গরুর মাংস খাওয়ার বা গোহত্যার অভিযোগে মুসলমানদের যখন পিটিয়ে মারা হচ্ছিল ভারতে, তখন এই ভদ্রমহিলা সংসদে দাঁড়িয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছিলেন। মহুয়া বলেছিলেন- “আমরা ততক্ষণই হিন্দু, যতক্ষণ এই দেশে মুসলমানরা আছে। যখন আমরা সব মুসলমানকে মেরে শেষ করে ফেলব, তখন নিজেরাই নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে যাব। আমরা আর হিন্দু থাকব না, পরিণত হবো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র বা দলিতে। এখন হিন্দুরা মুসলমানদের মারছে, তখন ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের মারবে, ক্ষত্রিয়রা শূদ্রদের ওপর অত্যাচার চালাবে, বৈষ্ণব আর ব্রাহ্মণদের মধ্যে শুরু হবে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। সেই দিনটা দেখতে না চাইলে এখনই মব লিঞ্চিং বন্ধ করুন, মানুষকে পিটিয়ে মারার ঘটনাগুলোর বিচার করুন।
মহুয়ার ওই বক্তব্য বা ভারতের তখনকার পরিস্থিতির সাথে এই সময়ের বাংলাদেশের যদি মিল খুঁজে না পান, তাহলে হয় আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন, নতুবা জোর করে চোখে টিনের চশমা পরে রয়েছেন। এই যে কখনও ডাকাত সন্দেহে, কখনও ছেলেধরার গুজব রটিয়ে, কখনও মসজিদের মাইক ব্যবহার করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কিংবা কখনও খোদ মসজিদের ভেতর থেকেই কাউকে ‘কোরআন শরীফ’ পায়ে মাড়ানোর অভিযোগে পিটিয়ে, পুড়িয়ে জ্যান্ত মেরে ফেলা হয়, এই ঘটনাগুলো দেখার পরও বাংলাদেশকে যদি আপনার অসভ্য-ইতর-অমানুষে ভর্তি একটা দেশ বলে মনে না হয়, তাহলে আপনার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার সবারই আছে।
লালমনিরহাটে শহীদুন্নবী জুয়েল নামের যে লোকটাকে ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগে প্রথমে পিটিয়ে মারা হলো, এরপর তার লাশটা আগুনে পোড়ানো হলো- সেই ভদ্রলোক মানসিকভাবে খানিকটা অপ্রকৃতস্থ ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, বিষয় ছিল ইনফরমেশন সায়েন্স এন্ড লাইব্রেরী ম্যানেজমেন্ট। শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন তিনি, রংপুরের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে চাকরি করতেন একসময়, ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসও নিতেন। ফেসবুকে তার ছাত্র-ছাত্রীরাই জানাচ্ছে, তিনি কেমন সহজ-সরল মানুষ ছিলেন, সবার সাথে কিভাবে মিশতেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন- সেসব। এমন একজন মানুষের বিরুদ্ধে কোরআন শরীফ পায়ে মাড়ানোর অভিযোগ তারা মানতেই পারছে না।
শিশু সন্তানের সঙ্গে শহীদুন্নবী জুয়েল
আর মানসিক অসুস্থতার কারনে তিনি যদি কোরআন শরীফের অবমাননা করেও থাকেন, তাতে কি ধর্মের বিশাল ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল? শহীদুন্নবী জুয়েল নাহয় অসুস্থ ছিলেন, তাকে যে লোকগুলো বর্বরভাবে পিটিয়ে মারলো, তারপর লাশটা আগুনে পোড়ালো, শহরজুড়ে বিক্ষোভ করলো- তারা কি মানসিকভাবে সুস্থ? মনের ভেতরে খুনী স্বত্ত্বা পুষে রেখে যে অমানুষগুলো আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, তাদের সুস্থ বলার পেছনে কোন যুক্তি কি আছে? শহীদুন্নবী জুয়েল যদি কোরআন অবমাননা করেই থাকেন, তাকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া যেতো না? আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া কেন?
এসব প্রশ্ন তোলাটাও আসলে অবান্তর। সারাবছর পাপে ডুবে থাকা জানোয়ারের দল কিছু একটা হলেই ধর্ম রক্ষার মিশনে নামে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা, যে যত বড় পাপী, তার ধর্মীয় চেতনা তত জাগ্রত। ধর্মটাকে একটা মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করার এই কালচারটা অনেক পুরনো। এরা ফেসবুকে ধর্ম কায়েম করে, জিহাদের ডাক দেয়, বয়কট বয়কট খেলে, আর চোখের সামনে কারো একচুল দোষ পেলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। ভীড় জমে যায় হাজার হাজার লোকের, একজনকে পিটিয়ে মারার জন্য হাজারো হাত একত্রিত হয়। তারপর যে হাতে তারা একটা মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করার মতো পাপ কাজ করেছে, সেই হাত তুলেই স্রষ্টার কাছে মোনাজাত করে। স্রষ্টার কী ঠেকা পড়েছে এদের দোয়া কবুল করার?
মহানবী (সা) যখন তায়েফে ইসলাম প্রচারের জন্য গিয়েছিলেন, সেখানকার লোকজন তাকে একের পর এক আঘাত করেছে, পাথর মেরে তার মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে, রক্ত জমাট বেঁধে জুতা পায়ের সাথে লেগে গিয়েছিল, খোলা যাচ্ছিল না। আল্লাহ তখন জিবরাইল (আ) কে দূত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন নবীর কাছে, বলেছিলেন, আপনি অনুমতি দিলেই এই জাতির ওপরে গজব নাজিল হবে। নবী সেই অনুমতি দেননি, বরং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন তাদেরকে সৎবুদ্ধি দেয়ার জন্য, যাতে তারা সত্য ও সুন্দরের পথ চিনতে পারে। সেই নবীর উম্মত হয়ে এরা কোরআন অবমাননার অভিযগ তুলে হাজারজন মিলে একটা মানুষকে পিটিয়ে মারে। নবীজীর কেমন উম্মত এরা? কোন ইসলামকে অনুসরণ করে তারা?
ধর্ম কি এতই ঠুনকো জিনিস যে, কারো কথায়, কারো লেখায়, কারো আঁকায়, বা কেউ কোরআন শরীফকে পায়ের তলায় পিষ্ট করলেই ধর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে? যে কোরআন হাজার হাজার বছর ধরে লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত ছিল, মুহাম্মদ (সা) এর আগমনের আগে আল্লাহ আর কারো ওপর এই কোরআন নাজিল করেননি, সেই কোরআন শরীফকে একজন মানুষ পায়ের নিচে ফেললেই কোরআনের অবমাননা হবে? যে কোরআন স্বয়ং আল্লাহর সৃষ্টি, সেটাকে অপমান করার সামর্থ্য কি মানুষের আছে? আর কোরআনের হেফাজত করার জন্যেও তো আল্লাহই আছেন, সেই দায়িত্ব মানুষকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার কে দিয়েছে?
এই ক্রোধ, এই জিঘাংসার আগমন হয় কোথা থেকে? এই যে কার্টুন আঁকার জবাবে কাউকে গুলি করে বা কুপিয়ে হত্যা করা, কোরআন পায়ের নিচে ফেললে লোকটা সুস্থ নাকি অসুস্থ সেটা বিচার না করেই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা, সেই মৃত্যুকে আবার জাস্টিফাই করা- এসব নির্মম কর্মকাণ্ডের শিক্ষা তো ধর্ম কাউকে দেয় না। তাহলে এই হিংস্র আচরণের জন্ম হয় কোথা থেকে? ধর্ম রক্ষার নামে এই অধর্মের আচরণ কেন করতে হয়? কেন একটা মানুষকে খুনের আগে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে শ্লোগান দিতে হয়? আপনারা কথায় কথায় বলেন ইসলাম হচ্ছে পরিপূর্ণ জীবন বিধান, কোরআনের আইন হচ্ছে শাশ্বত আইন। সেই ইসলাম বা কোরআনের কোথায় বলা আছে যে, নবীকে নিয়ে কটুক্তি করলে বা কোরআনের অবমাননা করলে কাউকে পিটিয়ে হত্যা করতে হবে? দেখান আমাকে!
পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যার পর জুয়েলের লাশটা পোড়ানো হয়েছে
জার্মান কবি মার্টিন নিমলারের একটা কবিতা আছে, ‘ফার্স্ট দে কাম’ শিরোনামের। বাংলায় অনুবাদ করলে কবিতাটা এরকম দাঁড়ায়-
“প্রথমে যখন ওরা কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার করার জন্য এসেছিলো, আমি কোনো কথা বলিনি, কারণ, আমি কমিউনিস্ট নই। তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম, কারণ আমি শ্রমিক নই। তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মারতে, আমি তখনও চুপ করে ছিলাম, কারণ, আমি ইহুদি নই। আবারও এলো ওরা, ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে, আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি, কারণ আমি ক্যাথলিক নই। শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে, তখন আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বললো না, কারণ, কথা বলার মতো তখন আর কেউ বেঁচে ছিলো না।”
কবিতাটা খুব মন দিয়ে পড়ুন। ঘটনাক্রম বোঝার চেষ্টা করুন। ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে যখন এদেশে ব্লগারদের কুপিয়ে মারা হয়েছে, তখন একদল উল্লাস করেছে, বড় অংশটা চুপ ছিল। ধর্মের নামে মানুষ খুন করাটা তখন থেকেই এদেশে বৈধতা পেয়ে গেছে। কাউকে মেরে ফেলে তার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলে দাও, মানুষ এমনিতেই দুইভাগ হয়ে যাবে। এমনকি যে লোক হত্যাকান্ডের বিচার চাইবে সেও মুখ বাঁকা করে বলবে, ধর্ম নিয়ে বাজে মন্তব্য করা ঠিক না… অথচ নিহত লোকটা আসলেই ধর্ম নিয়ে কোন কটুক্তি করেছিল কিনা, সেটা প্রমাণিত হবে না কখনও, হলেও তাকে পিটিয়ে বা কুপিয়ে মারাটা বৈধতা পাবে না।
ব্লগারদের যখন হত্যা করা হয়েছে, আপনারা চুপ ছিলেন। যখন ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ মিথ্যে অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে, ফেসবুকে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে অপপ্রচার চালানো হয়েছে- তখনও আপনি চুপ ছিলেন। যখন পূজার সময় মন্দিরে হামলা করা হয়েছে, প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে, তখন আপনি আওয়াজ তোলেননি, বরং মুসলমান হয়ে হিন্দুর পূজা দেখতে যাওয়া উচিত কি উচিত না সেই সমীকরণে ব্যস্ত থেকেছেন। এখন আপনার ওপর আক্রমণ আসা শুরু হয়েছে, কাল হয়তো এই ভীড় আপনাকে খুঁজে নেবে, পিটিয়ে মেরে ফেলবে, পত্রিকায় ছাপা হবে ধর্ম বা কোরআন অবমাননার অভিযোগে আপনার মৃত্যুর ঘটনাটা।
আপনি চুপ থাকতে থাকতে হাজারো ফ্রাংকেনস্টাইনের জন্ম দিয়ে ফেলেছেন নিজের অজান্তেই, তারা এখন গিলে খাবে আপনাকে। কাউন্টডাউন স্টার্টস, থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো… আপনাকে বাঁচানোর জন্য কেউ বেঁচে নেই, কারন আপনার হয়ে যাদের প্রতিবাদ করার কথা ছিল, তারা অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে…
সূত্রঃ এগিয়ে চলো (https://egiyecholo.com/article/shahidunnabi-murder-lalmonirhat)
এসএস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন