কোথায় গেল এত আওয়ামী লীগ!
রফিকুল ইসলাম রনি ।। টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এ সময়ে জামায়াত-বিএনপি থেকে লাখ লাখ নেতা-কর্মী এমপি-মন্ত্রীদের হাত ধরে আওয়ামী লীগে ঠাঁই নিয়েছেন। খোলস বদল করে তারা রাতারাতি বাগিয়ে নিয়েছেন দলীয় পদপদবিও। দিবসভিত্তিক কর্মসূচি, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডির কিংবা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কোনো কর্মসূচি থাকলে বিশাল বিশাল মিছিল চোখে পড়ত। পা ফেলার জায়গা থাকত না সমাবেশে।
এমনকি গাড়ি থেকে কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রীদের নামানো ও উঠিয়ে দেওয়ার জন্য গড়ে উঠেছে ‘প্রটোকল’ বাহিনী। আওয়ামী লীগের আট সহযোগী ও দুই ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাড়াও নামের শেষে শুধু ‘লীগ’ লাগিয়ে গত ১৬ বছরে ১০০ ভুঁইফোঁড় সংগঠনের জন্ম হয়েছে। দলে একটি কথা প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল-‘গাছের পাতাও এখন আওয়ামী লীগ করে।’
এখানেই শেষ নয়, আওয়ামী লীগেরই এক শীর্ষ পর্যায়ের নেতার কথা-‘দলীয় কার্যালয়ে যার সঙ্গে ধাক্কা লাগে বলে সে আওয়ামী লীগের নেতা।’ তবে সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পাওয়া যায়নি এসব তথাকথিত নেতাকে। ওই আন্দোলনের বিপরীতে সাংগঠনিকভাবে রুখে দাঁড়াতে পারেনি আওয়ামী লীগ। লাপাত্তা হয়ে ছিলেন দলের অনেক এমপি-মন্ত্রী!
দলীয় সূত্রমতে, টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও এ ধরনের একটি ধাক্কা কেউ দিতে পারে-এটা ছিল কল্পনার বাইরে। পুলিশ প্রশাসন থাকার পরও নেতা-কর্মীরা ঘুরে দাঁড়াতে পারলেন না কেন, এটা একটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমন্বয়হীনতা ছিল চারদিকে। সঠিক সময়ে সঠিক নির্দেশনা পাননি কর্মীরা। ভেঙে পড়ে দলের চেইন অব কমান্ড। আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রামের হৃৎপি- ঢাকায় থানা-ওয়ার্ডে কমিটি নেই প্রায় দুই বছর। অথর্ব ও অযোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে চলছে ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগ। কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে দলের পদপদবি কিনে নিয়েছেন। সহযোগী সংগঠনে ঢুকে পড়েছে অনুপ্রবেশকারী। যে কারণে দলের ভঙ্গুর অবস্থা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতায় সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকট হয়েছে। কেন এ সমন্বয়হীনতা, তা জানতে দফায় দফায় ঢাকার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। এতে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বীকার করে বলেছেন, ‘কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কোনো জায়গায় রুখে দাঁড়াতে না পারা দলীয় সাংগঠনিক ব্যর্থতা।’ এখন খোদ দলের ভিতরেই প্রশ্ন উঠেছে-এত আওয়ামী লীগ গেল কোথায়? তাহলে এতদিন যে দেখে মনে হয়েছে, সাংগঠনিক শক্তিতে উপচে পড়ছে। বিশাল বিশাল মিছিল, কোনো দিবস এলেই বিশাল বিলবোর্ড, পোস্টার, ফেস্টুন সাঁটানো নেতারা কি গর্তে ঢুকে ছিলেন? যারা মাঝে মাঝেই নিজেদের মধ্যে বা পরস্পর দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন, এমনকি সশস্ত্র সংঘাতেও লিপ্ত হয়েছেন টেন্ডার, ইজারা ইত্যাদির ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে; সেগুলো কি শুধুই ক্ষমতার জন্য? নাকি ক্ষমতার আড়ালে হারিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ? রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন যেন একটি টেস্ট কেস। একটি প্রতীকমাত্র। সারা দেশেই আওয়ামী লীগের এ অবস্থা। টানা তিন মেয়াদ শেষ করে চতুর্থ মেয়াদের সাত মাস পার করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় থাকার ফলে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে আওয়ামী লীগের যে মাঠের রাজনীতি তা সংকুচিত হতে হতে প্রায় নিঃশেষিত। দলের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে গেছে। সুবিধাবাদী, মতলববাজরা দলে কর্তৃত্ব দখল করেছে। যারা নিঃস্বার্থ, আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করে তারা কোণঠাসা হতে হতে নিষ্ক্রিয়প্রায়। যার ফলে এসব সুবিধাবাদী, মতলববাজ, দুর্বৃত্ত সংকটের সময় রুখে দাঁড়াতে পারে না। দলের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনা যেন তারই প্রমাণ। আওয়ামী লীগকে এখনই শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে হবে। যোগ্য, পরীক্ষিত, দক্ষ সংগঠকদের সামনে আনতে হবে। সাবেক ছাত্রনেতাদের ও মাঠের পরীক্ষিতদের রাজনীতিতে আনতে হবে। টাকার বিনিময়ে সুবিধাবাদীদের পদপদবি দিলে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে রাজনীতি বিশ্লেষক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর রশিদ বলেন, ‘কোটা আন্দোলন নিয়ে পরিস্থিতির গভীরতা কতদূর যেতে পারে তা উপলব্ধি করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে দলের ভিতরে বহু অনুপ্রবেশ ঘটেছে। টাকার বিনিময়ে পদ কিনে নিয়েছে যারা আদর্শ বিশ্বাস করে না। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন চলছিল, তখন ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছেন, এরা কারা? আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতাও যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমন আদর্শিক অবস্থা থেকে পদস্খলন ঘটেছে। যখন কোনো কাজ প্রাপ্তিযোগের জন্য করে তখন কেউ ঝুঁকি নেয় না। এ ১৫ বছরে অনেকেই অনেক কিছু হয়েছে। অনেকে অনেক টাকার মালিক হয়েছে। কাজেই তারা এখন নিরাপদ দূরত্বে রয়েছে। ঝুঁকি নিতে চায়নি।’ খোদ দলের নীতিনির্ধারকরাই বলছেন, রাজধানীতে কোনো কর্মসূচি দেওয়া হলে ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বিশাল বিশাল মিছিল আসে। সচিবালয়, অফিসপাড়া আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর আনাগোনায় মুখরিত থাকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় যখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা হলো, দলীয় কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হলো তখন এত আওয়ামী লীগ কোথায় ছিল? যখন বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করা হলো, তখন আওয়ামী লীগ কোথায় ছিল? আওয়ামী লীগ কি এতই দুর্বল এবং প্রতিরোধহীন একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে? যারা ন্যূনতম প্রতিরোধ করতে পারেনি?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই স্বীকার করছেন, শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশেই আওয়ামী লীগের অবস্থাটা এ রকম। গত এক যুগে আওয়ামী লীগের রাজনীতি পুলিশ এবং প্রশাসন নির্ভর হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতা, জেলার শীর্ষ নেতাদের হাত ধরে যেসব জামায়াত-শিবির, ফ্রীডম পার্টির লোকজন আওয়ামী লীগে প্রবেশ করল, পদপদবি পেল তারা কোথায়?
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিভক্ত সরকারি আওয়ামী লীগ এবং অনুপ্রবেশকারী আওয়ামী লীগ দিয়ে সংকটে আওয়ামী লীগ কখনো দাঁড়াতে পারবে না, কোটা সংস্কার আন্দোলন তা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিল। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগের ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এখনই দলে সাংগঠনিক শক্তি এবং সত্যিকারের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের সামনে আনতে হবে। না হলে দুঃসময়ে সবাই পালিয়ে তামাশা দেখতে থাকবে।
-বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে নেওয়া
CBNA24 রকমারি সংবাদের সমাহার দেখতে হলে
আমাদের ফেসবুক পেজে ভিজিট করতে ক্লিক করুন।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল ভিজিট করতে পোস্ট করুন।