গাজীপুরে দুদিনের উত্তেজনার পর এখন কী অবস্থা
ঢাকার কাছেই গাজীপুরে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলার খবরকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের জেরে দলটির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও স্থাপনাগুলো এখন জনশূন্য। নগরীর ধীরাশ্রমে মি. হকের বাড়ির আশপাশ থেকে আতঙ্কে সরে গেছেন অনেক সাধারণ মানুষও। খবর বিবিসি বাংলা’র।
স্থানীয় সাংবাদিকদের অনেকে জানিয়েছেন যে, তারা আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘরবাড়ি আজ রবিবার সকালে তালাবদ্ধ দেখেছেন। এমনকি কোন কোন নেতা যেসব ঘরবাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন, সেসব বাড়ি থেকে ভাড়াটিয়ারাও দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে সরে পড়েছেন।
গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শনিবার রাত থেকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামের যে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে, তাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৮২ জন গ্রেফতার হয়েছে। তবে তিনি দাবি করেছেন, ‘গাজীপুর অস্থিতিশীল করতে প্রচুর অস্ত্র ঢুকছে’।
অন্যদিকে, সহকারী পুলিশ কমিশনার আমির হোসেন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে, অভিযান শুরুর পর সেখানকার পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। “আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব জায়গায় অবস্থান করছে। আজ আর মিছিল সমাবেশও হয়নি। এছাড়া আর কোন অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেনি,” বলছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
শুক্রবার সন্ধ্যায় একদল ব্যক্তি ধীরাশ্রমের দক্ষিণখানে মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা করে। সে সময় পাশের মসজিদ থেকে ‘মন্ত্রীর বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। গ্রামে ডাকাত পড়েছে। গ্রাম রক্ষা করেন’ এমন ঘোষণা এলে লোকজন বাড়িটি ঘিরে ফেলে কয়েকজনকে আটকে ব্যাপক মারধর করে।
পরে সেখানকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা দাবি করেন যে, সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে লুটপাট হচ্ছে শুনে সেটি প্রতিহত করতে শিক্ষার্থীরা সেদিকে যান। এর মধ্যে ১৫/১৬ জন আগেই সেখানে পৌঁছে যান। তারা গিয়ে লুটপাট হচ্ছে দেখতে পেয়ে বাধা দিলে পেছন থেকে অনেক মানুষ জড়ো হন। তারা আগে যাওয়া ১৫/১৬ জনকে বেধড়ক মারধর করেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার রাতেই বিক্ষোভ মিছিল করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
![](https://cbna24.com/wp-content/uploads/2025/02/c31588e0-e6cc-11ef-bd1b-d536627785f2.jpg.webp)
শনিবার যা যা হলো
গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘরবাড়িতে যারা থাকছিলেন, শনিবার ভোর থেকেই তারা সরে পড়তে শুরু করেন।
এর আগে রাতে যৌথবাহিনীর বিশেষ অভিযান শুরু হলে তাতে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
পাশাপাশি নাগরিক কমিটি ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিকে ঘিরেও এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছিলো অনেকের মধ্যে।
শুক্রবারের ঘটনার জের ধরে শনিবার নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গাজীপুরের রাজবাড়ী মাঠে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
শনিবার দুপুর দেড়টার পর বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও মিছিল আসতে শুরু করে। তারা জেলা প্রশাসকের (রাজবাড়ী মাঠের কাছেই) কার্যালয়ের সামনে মিছিল করতে থাকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ দুপুরের পর সেখানে যান ও বক্তব্য দেন। ওই সমাবেশ থেকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম ও মোজাম্মেল হককে দায়ী করা হয়।
এর মধ্যেই মোজাম্মেল হকের বাড়িতে আগুন দেয়া হবে- এমন খবর আবার ছড়িয়ে পড়ে। যদিও তখন আর ওই বাড়িসহ আশেপাশের বাড়িতে আর লোকজন কেউ ছিলো না।
ওদিকে রাজবাড়ীর মাঠে বক্তব্য দিয়ে সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ একটি অটোরিকশা করে চলে গেলে আবারো খবর ছড়ায় যে মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা হবে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি।
তবে সারজিস আলম যেখানে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেখানেই অর্থাৎ ডিসি অফিসের সামনে বিকেলে একজন গুলিবিদ্ধ হলে নতুন করে উত্তেজনা ছড়ায় । মটর সাইকেলে করে দুজন এসে এক রাউন্ড গুলি করে চলে যায় বলে দাবি করা হয়।
এর আগে সারজিস আলম জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও পুলিশ কমিশনারের সাথে কথা বলেন।
পুলিশ কমিশনার পরে জেলা প্রশাসক অফিসের সামনে ছাত্রদের কাছে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন ও সদর থানার ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেন।
এই মধ্যে ঢাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ অভিযানের ঘোষণা দেয়। পরে রাতে সেনাবাহিনীসহ অভিযান শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ‘ডেভিল হান্ট অপারেশন’ নামে এই অভিযানে ৮২ জনকে আটকের তথ্য দিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ বলেছে, যাদের আটক করা হয়েছে তারা ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের লোক’।
তবে শনিবার দিবাগত রাতে আর নতুন করে কোন ঘটনা ঘটেনি।
এবং আজ রোববারেও পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ রয়েছে বলে দাবি করেছেন পুলিশ কমিশনার।
গাজীপুর আওয়ামী লীগের পরিস্থিতি
স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা বরাবরই শক্তিশালী এবং এর মূল কেন্দ্রেই ছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল হক। যদিও গত পাঁচ বছর ধরে দলটির রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছিলেন গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। এর বাইরে টঙ্গীর শিল্প এলাকায় প্রভাব আছে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলেরও।
আবার দলটির মধ্যে মি. আলমকে কেন্দ্র করে কোন্দলও চরমে উঠেছিলো। এক পর্যায়ে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ মুহূর্তে তিনি আন্দোলনকারীদেরও হামলার শিকার হয়েছিলেন। এ সময় তার একজন সহকারী নিহতও হয়েছেন।
পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মি. হকের বাড়িতে এক দফা হামলা হলেও এ নিয়ে বড় কিছু ঘটেনি। তবে ওই দিনের পর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন গাজীপুরের আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সবাই।
কিন্তু এবার ঢাকায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ভবন গুড়িয়ে দেয়ার পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িঘরে হামলার কারণে গাজীপুরেও এমন কিছু হতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছিলেন।
গাজীপুরের মধ্যম সাড়ির একজন আওয়ামী লীগ নেতা বিবিসিকে বলেছেন, মোজাম্মেল হকের এলাকায় বরাবরই তার অবস্থান শক্ত এবং এটি স্থানীয় লোকজন জানেন।
ওদিকে গাজীপুর মহানগরে বিএনপিরও একটা অবস্থান আছে এবং আওয়ামী লীগের নেতারা এলাকা ছাড়ার পর মূলত বিএনপিই এখন নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়।
এমন পরিস্থিতিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন করে আলোচনায় এসেছে শুক্রবারের ঘটনার পর থেকে। তারা শুক্রবারের ঘটনার জন্য মোজাম্মেল হক ও জাহাঙ্গীর আলমকেই দায়ী করেছেন।
শুক্রবার রাতে যা ঘটেছিলো
স্থানীয় সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের কয়েকজনের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, মোজাম্মেল হকের বাসায় হামলা হচ্ছে- এমন খবর প্রথম শহরে ছড়িয়ে পড়েছিলো বৃহস্পতিবা। কিন্তু সেদিন এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি।
গত বছর অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই মি. হক পলাতক এবং তার বাড়ীতে একজন নারী তত্ত্বাবধায়ক আরও কয়েকজনকে নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন।
এরপর শুক্রবার আবার শহরে এই খবর ছড়াতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার দিকে ‘হামলা হচ্ছে’ এমন খবর আসে। কারা হামলা করছে এটি তখন জানা না গেলেও স্থানীয়দের মতে, একদল ব্যক্তি সেখানে লুটপাট শুরু করার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজনের পরামর্শে স্থানীয়রা পাশের মসজিদে ঘোষণা দিতে শুরু করেন- ‘গ্রামে ডাকাত ঢুকেছে। যেভাবে পারবেন প্রতিরোধ করবেন। গ্রাম রক্ষা করতে হবে’।
এ ঘোষণার পর স্থানীয়রা লাটি সোটা ও দা নিয়ে প্রাচীর ঘেরা বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এ ঘটনা যখন চলছে তখন শিক্ষার্থীদের একটি দল সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেয় যে – ‘আওয়ামী লীগের লোকজন ছাত্রদের আটকে রেখেছে। বহু ছাত্র আটকা পড়েছে’।
এর মধ্যেই আরেকদল শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে যায়। তখন সদর থানা ও গাছা থানায় খবর দিলেও পুলিশ কার্যত সংশয়ে ছিলো এবং তারা স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথেও যোগাযোগ করে তাদের সাথে যাওয়ার জন্য বলে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীও ঘটনাস্থলে যায়।
তারা যখন সেখানে যায় তখন মোজাম্মেল হকের বাড়ির সামনেই তিন জন আহত অবস্থায় পড়েছিলো। ভেতর থেকেও কয়েকজনকে উদ্ধার করা হয়। কয়েক জনের শরীরে দায়ের কোপের আঘাত দেখা গেছে বলেও জানা গেছে।
ঘটনাস্থলে ছিলেন না, তবে সংশ্লিষ্টএলাকায় বসবাস করেন- এমন কয়েকজন জানিয়েছেন প্রথমে একদল এসে হামলা শুরু করলে তারাই স্থানীয়দের হাতে আটক পড়েন। পরে সেনাবাহিনী গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। যদিও এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা।
আহতদের প্রথমে তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এর মধ্যে গুরুতর আহত কয়েকজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
শুক্রবার রাতেই হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা কর্মীরা। তাদের একজন নেতা মো: আবদুল্লাহ তখন সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার রাতে তারা খবর পান যে সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা ও লুটপাট হচ্ছে।
“এটি শোনার পর আমাদের শিক্ষার্থীরা রওনা হন। ১৫-১৬ দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে যান। তারা গিয়ে লুটপাটে বাধা দিলে পেছন থেকে অনেকে জড়ো হয়ে ওই ১৫ জনকে ছাদে নিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করে”।
ঘটনার খবর পেয়ে রাতেই গাজীপুরে হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম। এসময় হাসনাত আব্দুল্লাহর করা একটি মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তিনি সেখানে তাদের অনুসারীদের ‘কেউ মব বলার চেষ্টা করলে তাকেও সাইজ করে দেয়ার’ পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এরপর সারজিস আলমসহ অনেকে গাজীপুরের বিষয়ে ফেসবুকে নানা পোস্ট দেন। মিস্টার আলম শুক্রবার দিবাগত রাত সোয়া দুইটার দিকে একটা পোস্ট দেন- ‘গাজীপুরে আজকেই হবে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের শেষ দিন। আমরা আসছি……”।
তারা আহতদের দেখতে রাতেই গাজীপুরের হাসপাতালে যান এবং শনিবার আবার সেখানে গিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন।
-সূত্র: বিবিসি বাংলা