অর্থ পাচার
টরন্টোর বাংলাদেশীদের প্রতিরোধের গল্প
তীব্র শীতে জীবনযাত্রা নির্জীব হয়ে ছিল টরন্টোর প্রবাসী বাংলাদেশীদের। হঠাৎ করে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হওয়া একটা খবর দেখে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে তারা। সেই খবরে দেখা যায়, এক দম্পতি বাংলাদেশের বেসিক ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা চুরি করে কানাডায় চলে এসেছে। ১৪ জানুয়ারি দেশ রূপান্তর পত্রিকায় ‘৩০০ কোটি টাকা মেরে কানাডায়’—এ শিরোনামে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, “রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডায় ‘আত্মগোপন’ করে আছেন স্ক্র্যাপ (জাহাজ ভাঙা) ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু ওরফে জি বি হোসেন। তিনি ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। আলোচিত এ ‘শিল্পপতি’ দুটি পাসপোর্টের অধিকারী। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রথমে তার বাংলাদেশী পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশে আসা-যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু তিনি কানাডিয়ান পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ওই অবস্থায় গত বছরের ১৮ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক একেএম ফজলে হোসেন তার দুটি পাসপোর্ট নম্বর উল্লেখ করে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন। তার পরও তিনি বিদেশে চলে যেতে সমর্থ হন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান দলের নেতা ও দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জি বি হোসেন আদালতের আদেশ নিয়ে বিদেশ যান। দুদকের দেয়া নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তিনি আদালতে আবেদন করেন। আদালত তাকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়। এরপর তিনি কোথায় গায়েব হয়ে গেছেন, সেটা আমরা জানতে পারিনি। বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি তিনি কানাডায় আছেন। তার বাড়ি ও কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঠিকানা আমরা পেয়েছি। সেগুলোর বিষয়ে তথ্য চেয়ে আমরা শিগগিরই কানাডা সরকারের কাছে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকুয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠাব।’
গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠুর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ২০১২ সালে বাংলানিউজ২৪ও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করেছিল। ‘মিঠুর হাতে বন্দি নৌপরিবহন খাত, ক্ষুব্ধ সিমেন্ট শিল্প ও
নৌমালিকরা’—এ শিরোনামে সেখানে লেখা হয়, ‘একজন নৌব্যবসায়ীর স্বেচ্ছাচারিতায় হুমকির মুখে পড়েছে নৌপথে পরিবহনে নির্ভরশীল আরো বেশ কয়েকটি শিল্প খাত। একটি মাত্র কোম্পানির মালিক হয়ে এই ব্যবসায়ী তার দখলে নিয়েছেন নৌপরিবহন খাতে মালিকদের তিনটি সংগঠনকেই। ফলে গোটা খাতটিই এখন গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু নামের
এই ব্যবসায়ীর হাতের মুঠোয়। তার রাঙাচোখ উপেক্ষা করে কিছুই করা সম্ভব হয় না বলে অভিযোগ জানিয়েছেন অন্য একাধিক নৌপরিবহন মালিক।’
বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে টাকা চুরির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এ দম্পতিও প্রথম নয়, যারা টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশ থেকে। টরন্টোতে বেগমপাড়া বলে একটা অচিহ্নিত ও অনির্দিষ্ট এলাকা রয়েছে। এ বেগমপাড়ায় বাংলাদেশের সব দুর্নীতিবাজ সামরিক ও বেসামরিক আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও সন্তানরা স্বামীর দুর্নীতির টাকায় রাজকীয় জীবনযাপন করেন। একই সময়ের আরেক সংবাদে দেখা যায়, প্রশান্ত কুমার হালদার নামের আরেক ব্যক্তিও সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে গেছেন বাংলাদেশ থেকে। অসমর্থিত সংবাদে জানা যায়, তিনি কানাডাতেই রয়েছেন।
গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু ও নাহিদ আক্তারের এ ঘটনা এবং অন্য সব টাকা পাচারের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় টরন্টোতে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে। এই তীব্র প্রতিক্রিয়ার মূল কারণ হচ্ছে, এ দুজন সেখানকার বাংলাদেশীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। গাজী বেলায়েত হোসেন এখানে অনেক অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়েছেন উদার হাতে চাঁদা দেয়ার কারণে। সেসব অনুষ্ঠানের মঞ্চে তিনি আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে, গণ্যমান্য একজন ব্যক্তি হিসেবে বক্তৃতাও দিয়েছেন। তার বক্তৃতা শুনে মানুষ হাততালিও দিয়েছে। শুধু তিনিই নন, তার স্ত্রীও বাংলাদেশীদের
মধ্যে অত্যন্ত সক্রিয়। টরন্টোর বাঙালিপাড়ায় ব্যবসা চালানোর সুবাদে প্রবাসী বাংলাদেশীদের একটা বড় অংশের সঙ্গে তার নিত্যদিনের ওঠাবসা রয়েছে। স্বামীর মতো তিনিও অনেক কিছুরই মধ্যমণি।
এমন দুজন সুপরিচিত ব্যক্তি দেশের টাকা আত্মসাৎ করে এনে এখানে দাপটের সঙ্গে চলছেন, সম্প্রদায়ের কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছেন,
বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা সামনের সারিতে অবস্থান করছেন, এটা জানার পরে প্রতিক্রিয়াটা তীব্র হয়েছে সবার মধ্যে। এটাই মানুষের সাধারণ মনস্তত্ত্ব। অপরিচিত দুর্নীতিবাজদের প্রতি মানুষের ঘৃণা জন্মায়, তবে সেটা অতটা তীব্রতা পায় না, সেই ব্যক্তিকে ব্যক্তিগতভাবে না চেনার কারণে। এ দম্পতির ক্ষেত্রে এই চেনাজানাটাই ঘৃণা ও
প্রতিক্রিয়ার মাত্রা বাড়িয়েছে। মুখোশ পরা এ দুজন সবার মাঝখান দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সাধু সেজে, বড় বড় কথা বলেছেন নানা ফোরামে, এগুলো ভাবতেই বিবমিষা তৈরি হয়েছে অনেকের মাঝে।
তবে শুধু এ দম্পতির কারণেই নয়, একই সময়ে অন্য টাকা পাচারের ঘটনাগুলো আগুনে ঘি ঢেলেছে। প্রবাসজীবন কঠোর পরিশ্রমের এক জীবন। এখানে দুর্নীতি করার সুযোগ নেই বললেই চলে। প্রায় সবাইকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা লাগে পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য আর মাথার উপরে আশ্রয়ের জন্য ছাদ তৈরি করতে। বাংলাদেশ থেকে এগুলো বোঝা যাবে না। মনে হবে চাকচিক্যের মধ্যে
বসবাস করছে প্রবাসীরা। এ ধারণা সঠিক নয়। আমরা যারা বিদেশে আছি, তারা জানি কতটা পরিশ্রম করা লাগে এখানে টিকে থাকার জন্য।
এমন একটা জীবনকে এসব লুটেরা এসে অবিন্যস্ত করে দেবে, এটা মানতে পারাটা কঠিন। এর সঙ্গে আরেকটা বিষয়ও যুক্ত হয়েছে। যতই আমরা বিদেশে থাকি না কেন, আমাদের শিকড় কিন্তু
রোপিত ওই বাংলাদেশেই। আমাদের সবারই আত্মীয়স্বজন রয়ে গেছে সেখানে। এ তস্কররা যে টাকা চুরি করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, সেই টাকা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষেরই টাকা। সেই সাধারণ মানুষের মধ্যে কেউ আমাদের ভাই, কেউ বন্ধু, কেউবা আত্মীয়স্বজন।
এসব কারণে লুটেরাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে টরন্টোর বাংলাদেশীরা। ১৯ জানুয়ারি প্রচণ্ড শীত ও তুষারপাত উপেক্ষা করে মানববন্ধন করে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানাতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায় প্রতিটা মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকে। তীব্র সামাজিক ঘৃণায় তারা ভাসিয়ে দিতে থাকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের টাকা চুরি করে নিয়ে আসা
লোকগুলোকে। এ ঘৃণার তোড়ে মিঠু-নাহিদ দম্পতির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কেউ ভাংচুর চালায়নি, কেউ কাস্টমারদের সেখানে যেতে বাধা দেয়নি। মানুষ শুধু বর্জন করেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ অভিযুক্ত এ দুই ব্যক্তিকে।
বাংলাদেশ থেকে সম্পদ চুরি করে এনে সুখের জীবন কাটাবে বলে ভেবেছিল অনেক দুর্নীতিবাজ। সাধারণ মানুষের এই তীব্র ঘৃণার আঘাতে কুঁকড়ে গেছে তারা। কুঁকড়ে গেলেও একটু সামলে নেয়ার
চেষ্টা চালানো হয়েছে। টরন্টোর প্রতিবাদকারীদের বেশ কয়েকজন আইনি চিঠি পেয়েছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে। বাংলাদেশের মতো এ দেশেও আইনি পথটা ব্যয়বহুল। দুর্নীতিবাজদের হাতে যেহেতু প্রচুর অবৈধ টাকা রয়েছে, তাই তারা ভেবে নিয়েছে যে এ পথে গেলে সৎ মানুষগুলোকে আটকে দেয়া যাবে। কারণ এদের কারো পকেটেই সে রকমভাবে টাকা নেই আইনি পথে লড়াই করার জন্য। কিন্তু তাদের সেই ভাবনা তাদের বিরুদ্ধেই গেছে। আইনি চিঠি পাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশীরা আরো একাত্ম হয়েছে। এখন আর এটা একক কারো বিষয় নয়। দল-মত নির্বিশেষে টরন্টোর সব বাংলাদেশী এটাকে নিজের ওপর আঘাত হিসেবে নিয়েছে। এখানে বসবাসরত বাংলাদেশী আইনজীবীরাও এগিয়ে এসেছেন। তাদের তরফ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে এ লুটেরাদের বিরুদ্ধে চলমান এই আন্দোলনে তাদের অনেকে সংহতিও প্রকাশ করেছেন।
২৪ জানুয়ারি টরন্টোতে অত্যন্ত বৈরী আবহাওয়া ছিল। সেই বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে ২০০-২৫০ জন জড়ো হয়েছিলেন এক জায়গায়। সেখানে তারা গানে গানে ও কবিতায় লুটেরাদের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সেই প্রতিবাদ সভায় তারা বজ্রমুষ্টিতে শপথ নিয়েছেন কানাডাকে দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্য হতে না দেয়ার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মেহনতি মানুষদের টাকা চুরি করে এনে
কানাডায় সুখের জীবন যাপন করবে লুটেরা ও তস্কররা, সেটা তারা কিছুতেই হতে দেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের এ আন্দোলন চলমান থাকবে বলেই প্রত্যয়
ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ থেকে আসা এসব দুর্নীতিবাজকে সামাজিকভাবে বয়কট করবেন তারা, প্রতিনিয়ত তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রদর্শন করবেন এবং কানাডার আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হলে সেই পথেও পা বাড়াবেন তারা।
টরন্টোর বাংলাদেশীদের প্রতিরোধের গল্প
ফরিদ আহমেদ: লেখক ও ব্লগার
বণিক বার্তা থেকে
আরও পড়ুনঃ