দুঃসময়ে মানুষের আনন্দ বিদ্যানন্দ
আজিজুল পারভেজ || কয়েক বছর আগে থেকেই মানবতার সেবায় ভূমিকা রাখছিল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। দেশে করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর যখন মানুষের জীবনযাপন ও জীবনমান বদলে যায়, সেই চরম দুঃসময়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবামূলক বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করেছেন এ সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা।
করোনা পরিস্থিতিতে হঠাৎই কর্মহীন হয়ে পড়েন বহু মানুষ। ঘরে সংকট দেখা দেয় খাবারের। চক্ষুলজ্জায় হাতও পাততে পারতেন না কারো কাছে। শিশুসন্তানসহ পরিবারের সবাইকে থাকতে হয়েছে অভুক্ত, অর্ধভুক্ত। শহরের ফুটপাত ও বস্তির এমন ভাসমান, অসহায় নিম্ন আয়ের হাজার হাজার মানুষকে প্রতিদিন বিনা মূল্যে রান্না করা ও শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়েছে বিদ্যানন্দ। শুরুতে প্রকল্পটি রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে চললেও কিছুদিনের মধ্যে দেশের বেশির ভাগ জেলায় এবং পাহাড়ি বা দুর্গম এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এসব এলাকার নিরন্ন মানুষের হাতে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দিয়েছে; অনেকের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছে সংগঠনটি। যৌনকর্মী, পাহাড়ি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, বেদেপল্লী, বিহারি অধ্যুষিত এলাকা এই সহায়তার অধীনে ছিল। করোনায় সংকটাপন্ন মানুষের পাশে আলোর দিশারি হয়ে, সবার আনন্দ হয়ে ওঠে বিদ্যানন্দ।
সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, প্রায় তিন লাখ ৮০ হাজার পরিবারকে প্যাকেটজাত চাল, ময়দা, মসুর ডাল, চিনি, লবণ, মসলা ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে বিদ্যানন্দ পাশে পেয়েছিল ৭৩টি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ পুলিশকে।
সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী রিপন মার্দি বলেন, ‘করোনার অনেক আগে থেকেই বিদ্যানন্দ পথশিশুদের জন্য এক টাকায় আহারের প্রকল্প চালাচ্ছিল। করোনা শুরুর পর অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা আগ্রহ দেখান সংকটাপন্ন মানুষের জন্য খাবার পৌঁছে দেওয়ার কোনো আয়োজন হলে এ ব্যাপারে সহায়তা দেবেন। তার পরই শুরু হয় রান্না করা খাবার সরবরাহের কাজ।’
করোনা পরিস্থিতিতে আরেকটি উদ্যোগ ছিল ‘বিনা মূল্যের বাজার’। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ফসল, শাকসবজি, মৌসুমি ফল ইত্যাদি কিনে এনে লকডাউনে থাকা স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর জন্য উন্মুক্ত স্থানে রেখে দেওয়া হতো, সেখান থেকে যার যার প্রয়োজনমতো নিয়ে যেত। এর ফলে একদিকে দরিদ্র মানুষ পেয়েছে বিনা মূল্যে সহায়তা, অন্যদিকে কৃষকের ফসল নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে গেছে।
করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই ইত্যাদিও সরবরাহ করেছে সংগঠনটি। ‘বিদ্যানন্দের বাসন্তী’ প্রকল্প থেকে উৎপাদিত পাঁচ হাজারেরও বেশি পিপিই দেওয়া হয়েছে বিনা মূল্যে। এ ছাড়া ফ্রি হ্যান্ড স্যানিটাইজার, প্রতিরক্ষামূলক পিপিই এবং মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে। বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীরা হাসপাতাল, বাসস্টেশন, রেলস্টেশন, থানা, লঞ্চ টার্মিনাল এবং বস্তি এলাকাগুলোতে নিয়মিত এই স্প্রে কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮২০ টন উচ্চমানের স্যানিটাইজার স্প্রে করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
মৌসুমি তাজা ফল, ভিটামিন-সির জন্য সাইট্রাস এবং বিভিন্ন শুকনো আইটেম প্যাকেটসহ উপহারের ঝুড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আইসোলেশনে থাকা রোগীদের জন্য।
কর্মহীন হয়ে পড়া পরিবারগুলোর শিশুদের জন্য দুধ, শিশুদের উপযোগী খাবার, শস্য এবং ডালের ব্যাগ পৌঁছে দিয়েছেন বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীরা। সংকটে পড়া কয়েক শ অভাবী শিক্ষার্থীকে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে ফি প্রদানের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে চট্টগ্রামে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১০০ শয্যার এ হাসপাতালে উন্নত সেবা, খাবার এবং ওষুধের ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে পুরুষ ও মহিলা রোগীর জন্য পৃথক ওয়ার্ড সুবিধা, নন-কভিড রোগীর জন্য বহির্বিভাগ এবং অ্যাম্বুল্যান্স সুবিধাও রয়েছে। হাসপাতালটিতে ১২ জন চিকিৎসক, ১৮ জন নার্স, ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন।
দেশের উপকূলীয় প্লাবন ভূমিতে দুস্থ মানুষের কাছেও চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিয়েছে বিদ্যানন্দের ভাসমান হাসপাতাল ‘জীবন খেয়া’। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের তত্ত্বাবধানে মোংলা বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে উপকূলের ২১টি পয়েন্টে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে ‘জীবন খেয়া’। আটজন চিকিৎসক, দুইজন দন্ত চিকিৎসক এবং দুইজন চক্ষু বিশেষজ্ঞসহ নার্স, ফার্মাসিস্ট, স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মচারীরা হাসপাতালটি পরিচালনা করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার রোগীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করেছে ‘জীবন খেয়া’।
সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ সহায়তা থেকেই এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে বলে জানান বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কর্মরত উম্মে সিনহা। করোনাকালীন কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা জানতে বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাসের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও সম্ভব হয়নি, তিনি বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় অবস্থান করার কারণে।
আনন্দের মাধ্যমে শেখা—এ মূলমন্ত্র থেকেই ‘বিদ্যানন্দ’ নামের সৃষ্টি। পড়ব, খেলব, শিখব—এ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে বিদ্যানন্দের কার্যক্রম শুরু হয়। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিনা মূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে পরে আরো নানামুখী উদ্ভাবনী প্রকল্প পরিচালনার মধ্য দিয়ে বিদ্যানন্দ আজ দেশে-বিদেশে আলোচিত ও অনুকরণীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
২০১৬ সালে শুরু হওয়া ‘এক টাকায় আহার’ প্রকল্পের মাধ্যমে পথশিশু, এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা মাত্র এক টাকার বিনিময়ে খাবার কিনে খাওয়ার সুযোগ পায়। প্রতিদিন হাজার হাজার শিশুকে খাবার প্রদানের মাধ্যমে এ প্রকল্প এরই মধ্যে ৮০ লাখেরও বেশি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, রাজবাড়ী, কক্সবাজার, বান্দরবান পার্বত্য জেলা ও খাগড়াছড়িতে রয়েছে বিদ্যানন্দের স্কুল ও শিখন কেন্দ্র। শিশু শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত এসব স্কুল ও শিখন কেন্দ্রে প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করা হয়।
দরিদ্র শিশু ও বয়স্ক মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিদ্যানন্দের রয়েছে ‘এক টাকায় চিকিৎসা’ কার্যক্রম। এ পর্যন্ত ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ এ প্রকল্পের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা পেয়েছে। দুর্গম এলাকার এতিম অনাথ শিশুদের জন্য বিদ্যানন্দের রয়েছে ছয়টি এতিমখানা। এতে ঠাঁই হয়েছে প্রায় ৫০০ এতিম শিশুর। দুস্থ মহিলাদের আত্মনির্ভরশীল করতে রয়েছে ‘বাসন্তী গার্মেন্টস’ প্রকল্প। এর মাধ্যমে দরিদ্র কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালে সচেতন করতে ‘বাসন্তী স্যানিটারি প্যাড’ নামে মাত্র এক টাকায় বিশেষ প্যাডের ব্যবস্থা করা হয়।
ঢাকায় নানা কাজে আসা নারীদের মাত্র ৭১ টাকার বিনিময়ে এক রাত থাকার সুবিধা দেওয়া হয় আবাসিক হোটেল ‘বাসন্তী নিবাসে’। ‘যখন খুশি, তখন খাবে’ পথশিশুদের খাওয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিদ্যানন্দের উদ্ভাবনী প্রকল্প ‘খাবারের এটিএম মেশিন’। প্রতি বছর রমজান মাসে বিদ্যানন্দের ইফতার ও সাহির বিতরণ কার্যক্রম ‘সিয়াম সাধনায় একসাথে’ পরিচালিত হয়। ‘দুস্থদের সাথে আমার কুরবানি’ উত্তরবঙ্গের দুর্যোগকবলিত এলাকায় চলতি বছর ৮০০ জন দাতার পক্ষে গরু-ছাগল কোরবানি করে রান্না করা হয় এবং বিতরণ করা হয় দুস্থ পরিবারগুলোর মাঝে। সাহিত্যের বই প্রকাশের জন্য রয়েছে ‘বিদ্যানন্দ প্রকাশনী’।
করোনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপন্ন মানুষের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে যেভাবে রাত-দিন বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করেছেন, তা ইতিহাসে উদাহরণ হয়ে থাকবে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। -কালের কন্ঠ
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন