ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

নিহারুল ও তার দুই মেয়ে : ছোট গল্প : আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস

নিহারুল ও তার দুই মেয়ে

নিহারুল ও তার দুই মেয়ে : ছোট গল্প : আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস
এক

প্রতিদিন সকাল পাঁচটার মধ্যে ঘুম ভাঙে নিহারুলের। আজকেও তার ব‍্যতিক্রম হল না। যদিও আজ তার ব‍্যতিক্রম হওয়ার কথা ছিল। শুতে যে তার অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। ফলে নিহারুল ধরেই নিয়েছিল যে, আজ তার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হতে পারে। ও আজ তার হাঁটতে বেরনো নাও হতে পারে। তারপর নিহারুল মনের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নিয়েছিল যে, একটা দিন না হাঁটলে এমন কোন অসুবিধা বা ক্ষতি হবে না। আজ তিন বছর ধরে সে তো হাঁটছে। কোন দিন হাঁটা কামাই নেই। লিভারের চর্বি কাটানোর জন্য ডাক্তারের পরামর্শে নিহারুল কাজটা করে ভালো আছে।

হ‍্যাঁ, ঘুম থেকে উঠে নিহারুল যখন হাঁটতে বেরনোর জন্য তৈরি হল অমনি তার ফোনটা বেজে উঠল। ছায়ার নম্বর থেকে ফোন। তবে কি ছায়ার লেবার পেন উঠেছে? সেটা জানাতে ফোন করেছে?

কাল বিকালেই তো ছায়ার সঙ্গে তার ফোনে অনেকক্ষণ ধরে কথা হল এবং ডেট এর কথা জিজ্ঞেস করলে আগামী বাইশ তারিখের কথা বলল। আজ তো সবে বারো তারিখ হল। বাইশ তারিখ আসতে এখনও দেরি আছে। তাহলে কি অন্য কোন সমস্যা হল? ভাবতে ভাবতে নিহারুল ফোনটা ধরল,” হ‍্যালো!”
” কে, ভাই?”
” কে, সজল?”
” হ‍্যাঁ।”
” কী হল, বল।”
” বুবুর লেবার পেন উঠেছে।”
” কী!” নিহারুল চমকে উঠল।
” হ‍্যাঁ। বুবুকে নিয়ে আব্বা-মা হাসপাতালে যাচ্ছে।”
নিহারুল এখন তার নিজের বাড়িতে রয়েছে। যে বাড়িতে তার বাবা বা ভাইদের কারও কোন অংশ নেই। নিজের টাকায় সে বাড়ি করেছে। বছর সাতেক আগে সে একটা লটারি জিতেছিল। প্রথম পুরস্কার, এক কোটি টাকা। ওই টাকায় জায়গা কিনে সে বাড়ি করেছে। দেখবার মতো খুব সুন্দর একটা বাড়ি। তার বাবার অনেক বিষয় সম্পত্তি থাকলেও ওই বাড়ি নেই। শুধু তার বাবার কেন? তার ভাইদেরও নেই। ফলে নিহারুল এখন খুব সুখী। কিন্তু এক সময় সে খুব দুঃখী ছিল। তার প্রথম কন্যা সন্তান ‘মায়া’ জন্ম নেওয়ার পর।

।। দুই।।
নিহারুলরা মোট পাঁচ ভাই, বোন নেই। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে নিহারুল হল প্রথম। কিন্তু বিয়ে করে সে সব শেষে। তার সব ভাইদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর। তার সব শেষে বিয়ে করারও উপযুক্ত একটা কারণ আছে। সেটা হল, তারা কয়েক জন বন্ধু মিলে একটা স্কুল চালাত, জুনিয়র হাইস্কুল। তাদের আশা ছিল স্কুলটা হয়ে যাবে এবং সরকার তাদের কাজে খুশি হয়ে বেতন দেবে। তারপর বিয়ে করবে। করে সুখী হবে। কিন্তু বছর দশেক চালিয়েও স্কুলটা হল না। ফলে বিয়ে করতে তার দেরি হয়ে গেল।

নিহারুল যখন বিয়ে করে তার ভাইয়েরা তখন কে দুটো কে তিনটে করে ছেলের বাবা হয়ে গেছে। নিহারুল ছাড়া তারা যে কেউই লেখাপড়া করে নি। সব ক অক্ষর গো-মাংস। সুতরাং তারা কেউই বেকারের জ্বালা বোঝে নি। হাফ প‍্যান্ট পরা ছেড়ে যেই লুঙ্গি পরা শিখেছে অমনি বিয়ে করে নিয়েছে। যে কারণে নিহারুলের মতো চাকরির জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয় নি। তাও আবার নিজেরা পছন্দ করে। কিন্তু নিহারুল বিয়ে করে তার বাবার পছন্দ করা মেয়েকে। তারপরও বছর খানেক বাদে ছায়ার পেটে যখন বাচ্চা আসে তার বাবা সামির সেখ তাকে বলে,” বৌমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ওয়াশ করিয়ে আনছিস না কেন?”
নিহারুল বাবার এহেন কথার তাৎপর্য কী ঠিক বুঝতে পারে না। তাই, সে জিজ্ঞেস করে,” কীসের জন্য ওয়াশ করিয়ে আনতে বলছেন?”
” ও, এখনও বুঝতে পারিস নি না!”
” না, বুঝিয়ে বলুন!”
সামির সেখ বুঝিয়ে বলে,” বৌমার পেটে কন্যা সন্তান রয়েছে। কন্যা সন্তান নেওয়া যাবে না। তাই, ওয়াশ করিয়ে আনতে বলছি।”
নিহারুল এর কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে জিজ্ঞেস করে,” আপনাকে কে বলেছে?”

সামির সেখ হাসে,” আমাকে কে বলবে, পেট দেখে আমি বুঝতে পারছি না!”
” পেট দেখে কী করে বুঝতে পারছেন? ডাক্তার বাবুরাই তো বুঝতে পারেন না।”
সামির সেখ এর উত্তরে তখন বলে,” কন‍্যা সন্তান হলে পেট বেশি মোটা আর চওড়া হয়। দেখছিস না, বৌমার পেট কত মোটা আর চওড়া!”
” কিন্তু কন‍্যা সন্তান থাকেও যদি তাকে নষ্ট করতে হবে কেন?”
” তারও কারণ আছে।”
” কী কারণ আছে?”
” কারণটা হল, আমি কন্যা সন্তান পছন্দ করি না।”
” সে কী! পছন্দ করেন না কেন?”
” পছন্দ করি না কারণ, সম্পত্তির ভাগ বেরিয়ে যাবে। আর তাছাড়া, মেয়েরা হল জঞ্জাল আর আবর্জনার স্তূপ। এরা বাপের কোন কাজে লাগে না, কোন উপকারে আসে না। স্বামী-সংসার পেয়ে গেলেই পর হয়ে যায়। এমনি তো আর আগে যুগে মানুষ কন্যা সন্তান হত্যা করত না! মেরে মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখত না! এই সব কারণের জন্য।”
শুনে নিহারুলের গা রাগে রি রি করতে থাকে, সামির সেখের টোল পড়া দু’ গালে ঠাস ঠাস করে দু’ চড় বসিয়ে দিতে তার ইচ্ছে করে। কিন্তু তা পারে না। বাবা বলে বেঁচে যায়। কিন্তু বলতে ছাড়ে না,” মেয়ে হয় আমার হবে। তাতে আপনার কী? আপনার মনে এত বিষ ধরল কেন, শুনি!”

” শুনতেই যখন চাস, শোন তাহলে।” সামির সেখ বলে,” উত্তরাধিকার সূত্রে তুই আমার কোন সম্পত্তির ভাগ পাবি না, মানে আমি তোকে আমার সম্পত্তির ভাগ দেবো না। আমার সব কিছু থেকে তোকে বঞ্চিত করব। কেননা, তোকে ভাগ দিলে তোর মেয়ে ভাগ পেয়ে যাবে। আমি সেটা কখনোই চাই না, হতে দেবো না।”
সামির সেখের মুখের উপর নিহারুল তখন বলে,” আপনার মতো চিন্তার মানুষ পৃথিবীতে অনেক আছে। আগেও ছিল এবং এখনও আছে। তবে তাদের জন্য আমার কষ্ট হয় না। কষ্ট হয় আপনার জন্য। কারণ, আপনি আমার বাবা। একটা জঞ্জাল লোকের আমি ছেলে। নিজের প্রতি এর জন্য খুব ঘৃণাও হয়।”
” কী বললি, আমি জঞ্জাল!” সামির সেখ চেঁচিয়ে ওঠে।
” শুধু জঞ্জাল হলে তো ভালোই হতো, ঝেঁটিয়ে বিদায় করা যেত। আপনি তার চাইতেও বেশি।”
” মুখ সামলে কথা বলবি, হারামজাদা!” সামির সেখ চিৎকার করে।
” আপনিও মুখ সামলে কথা বলবেন।” তারপর নিহারুল নিজে থেকেই থেমে যায়। কারণ, সে বুঝতে পারে যে, একটা মূর্খ লোকের সাথে তার তর্ক করা ঠিক হচ্ছে না, সে ভুল ক‍রছে। সামির সেখ যদিও মূর্খ নয়, শিক্ষিত। আগেকার উচ্চমাধ্যমিক পাশ। সে সময় সে বেশ কয়েকটা চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু আর্থিক অবস্থা ভালো থাকার দরুন চাকরি সে করে নি। তবু অরুচিকর ব‍্যবহারের জন্য নিহারুলের চোখে সে একটা মূর্খ ছাড়া আর কিছুই নয়। এতদিন সে তার বাবাকে একটা ভদ্র, শিক্ষিত এবং মার্জিত রুচির মানুষ বলে জেনে এলেও সে যে আসলে একটা নীচ মনের মানুষ নিহারুলের কাছে তখন সেটা পরিষ্কার হয়ে যায় এবং পরে ছায়ার পেট থেকে যখন খুব সুন্দর একটা ফুটফুটে কন‍্যা শিশু সন্তান জন্ম নেয় নিহারুল খুব খুব খুশি হয়। মুখটা তার কী মায়াময়! ফলে নিহারুল তক্ষুনি তার নাম রেখে দেয় ‘মায়া’।

কিন্তু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সামির সেখ তাকে বলে,” কী রে, আমার কথা ঠিক হল? আমি বলেছিলাম না মেয়ে হবে, হল?”
” হল হল, তাতে আপনার কী? মেয়ে হয়েছে আমার হয়েছে। আমার মেয়ে ব‍্যাপারে আপনি একদম কোন কথা বলবেন না।”
” কথা বলব না মানে? একশো বার বলব। কারণ, যে বাড়িটায় তুই বাস করছিস ওটা আমার বাড়ি। বাপের বাড়িতে থাকতে হলে বাপের কথা শুনতে হবে, বাপের আইন মানতে হবে। তোর বউকে এক্ষুনি তোর তালাক দিতে হবে। না হলে ও বছর বছর শুধু কন‍্যা সন্তানই জন্ম দেবে। আর তোর যে কন‍্যা সন্তানটি হয়েছে তাকে মেরে ফেলতে হবে। কীভাবে মেরে ফেলতে হবে আমি তোকে দেখাচ্ছি। দুই হাতে এই ভাবে গলাটা টিপে ধরে—–” সামির সেখ দুই হাতে নিজের গলাটা আলতো ভাবে টিপে ধরে দেখায়।
নিহারুল গর্জে ওঠে,” খবরদার! দ্বিতীয়বার আর ও কথা একদম উচ্চারণ করবেন না। যদি করেন, বাবা-ছেলের সম্পর্কের কথা তাহলে ভুলে যেতে বাধ্য হব।”
” কী! আমাকে চোখ রাঙানো! এই মুহূর্তে তুই আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা কুলাঙ্গার, এই মুহূর্তে তুই আমার বাড়ি থেকে—–”
” হ‍্যাঁ, তাই যাব। থাকব না আপনার বাড়ি।”
” হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ, তাই যা। তোর মতন অবাধ্য ছেলের আমার দরকার নেই। আমার আরও ছেলে আছে তারা থাকবে। আমার বিষয় সম্পত্তি সব তাদের নামে লিখে দেব।”
” তাই দিবেন। আমার দরকার নেই আপনার পাপের ওই বিষয় সম্পত্তির।”
ব‍্যস, তারপরই সামির সেখ নিহারুলের ঘরে এই মোটা একটা তালা ঝুলিয়ে দেয়। নিহারুল তার তীব্র প্রতিবাদ করতে যায়। কিন্তু তার বাপ-ভাইয়েরা সব এক দিকে হয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং তাকে সারা জীবনের মতো বাড়ি থেকে উৎখাত করে।

।।তিন।।
নিহারুল দেশে থাকে না। মনের দুঃখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ছায়াকে তার বাপের বাড়ি রেখে কলকাতা চলে যায়। অনেক ঘুরে ঘুরে একটা রেস্তোরাঁয় কাজ পায়। চেয়ার, টেবিল পরিষ্কার করা ও থালাবাসন ধোয়ার কাজ। যা তার যোগ‍্যতার চাইতে অনেক ছোট। তবু মাইনে খুব কম। কিন্তু খাটুনি বেশি। এই জন্য কিছু দিন করার পর কাজটা নিহারুল ছেড়ে দেয়। কিন্তু দেশে ফিরে আসে না। দেশে ফিরে এসে কী করবে? লোকের জমিতে মুনিশ খাটা ছাড়া। মুনিশ খাটা কাজটা আবার নিহারুলের কোন দিনই পছন্দ নয়। তার থেকে ব‍্যবসা করা ভালো। যে কোন ব‍্যবসা। হোক তা ছোট। তাতে শরীর, মন এবং স্বাস্থ্য সব কিছু ভালো থাকে। পাঁচটা মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়। অতএব নিহারুল শিয়ালদহ স্টেশনে ‘লেবু চা’ বিক্রি করা শুরু করে। প্রথম প্রথম কয়েক দিন একটু লজ্জা লাগলেও পরে ঠিক হয়ে যায়। সারাদিন কেটলি হাতে ‘লেবু চা লেবু চা’ আর রাতের বেলায় ফুটপাতে ঘুম।

এই ভাবে চা বিক্রি করতে করতে একদিন এক টিকিট বিক্রেতার সাথে নিহারুলের আলাপ হয়। নাম তার দীপ। বিধান নগরে বাড়ি। বিবাহিত। তারও খুব কষ্টের সংসার। ছোট একটা কুঁড়ে ঘরে তারা তিনটে প্রাণী বাস করে। তারা স্বামী-স্ত্রী দু’ জন, আর তাদের একমাত্র মেয়ে। টিকিট বিক্রি করে তার সংসার চলে। তারও বাবার অবস্থা ভালো। কিন্তু বাবার অমতে নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে বলে তার এই হাল। নিহারুলও তার লাইফ হিস্ট্রিটা শোনায়। শোনার পর দীপ বলে,” তোমার যে আমার চাইতেও বেশি দুঃখ, বেশি কষ্ট গো!” তারপর বলে,” ও নিয়ে কোন দুঃখ বা চিন্তা করো না, একদিন দেখবে তুমিই সবার চাইতে ভালো থাকবে, জীবনে প্রচুর উন্নতি করবে। কীভাবে করবে বলতে পারব না, কিন্তু করবে।”
” তোমার কথা যেন সত্যি হয় দীপ, তোমার কথা যেন সত্যি হয়।” বলতে বলতে নিহারুল কেঁদে ফেলে।
দীপ নিহারুলের পিঠ চাপড়ে বলে,” কাঁদে না,হবে।”
নিহারুল তারপর আর কাঁদে না। বলে,” আমি স্বপ্নেও কোন দিন ভাবি নি যে, আমার মতো ছেলের এই হাল হবে।”
দীপ সান্ত্বনা দেয়,” তুমি জানো না, ভালো ছেলেদের কপালে চিরকাল কষ্ট বেশি। সেটা ঘরে হোক অথবা বাইরে। তবে ভালো ছেলেদের জন্য ভগবান ভাবেন। নিশ্চয়ই তোমার জন‍্যও তিনি ভাববেন।”
নিহারুল বলে,” তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার বুকটা অনেক খানি হালকা হল, দীপ। মনের দুঃখ অনেক খানি লাঘব হল। বল, তুমি কী খাবে?”
দীপ বলে,” একটু জল তেষ্টা পেয়েছে অনেকক্ষণ হল। একটু জল খাবো। খাবার জল আছে নাকি?”
” আছে।”
” একটু জল দাও তাহলে, খাই।”
নিহারুল একটা বিস্কুট বের করে দেয়। বিস্কুটটা দেখে দীপ বলে,” আমি তো শুধু একটু জল চাইলাম। বিস্কুট কেন?”
নিহারুল বলে,” কখন খেয়ে বেরিয়েছ তার ঠিক নেই, বিস্কুটটা খেয়ে জল খাও।”
দীপ নিহারুলের বলার মধ্যে এতটাই আন্তরিকতা দেখে যে, বিস্কুটটা না খেয়ে সে পারে না। তারপর এক কাপ চা খেয়ে নিহারুলকে বলে,” তোমার চা, বিস্কুটের দাম কত দিতে হবে বল।”
নিহারুল বলে,” দাম দিতে হবে না, আমি তোমার কাছে দাম নেব না। আমি তোমাকে এমনি খাওয়ালাম।”
দীপ তা শোনে না। বলে,” এমনি খাওয়া হয়? এটা তোমার ব‍্যবসা না! বল, কত দিতে হবে।”
না, নিহারুল বলে না। দীপ তখন মনে মনে ঠিক করে যে, নিহারুলকে সে একটা টিকিট দেবে। ও অনেক টিকিটের ভিতর থেকে সে একটা টিকিট বের করে দেয়,” এই টিকিটটা তুমি রাখো, নিহারুল। কপাল ভালো হলে প্রথম পুরস্কার এক কোটি টাকা পেয়ে যেতে পারো। আর হ‍্যাঁ, আমি এখন কয়েক দিন আসব না। কাল আনন্দবাজারে তুমি দেখে নিও।”
” আসবে না কেন?”
” কয়েক দিনের জন্য শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে যাব।”
” ও, আচ্ছা। কিন্তু দীপ?”
” বল।”
” আমি টিকিট কাটি না যে।”
দীপ বলে,” তুমি তো কাটছো না, আমি তোমাকে নিজে থেকে দিচ্ছি। রাখো।”
নিহারুল এবার টিকিটটা হাসি মুখে গ্রহণ করে এবং পরের দিন দীপের কথা মতো টিকিটটা সে আনন্দবাজারে মিলিয়ে দেখে, প্রথম পুরস্কার এক কোটি টাকা তার নম্বরে লেগে গেছে। নিহারুল অমনি আনন্দে কেঁদে ফেলে। তারপর সে চা বিক্রি করা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে আসে। এসে রোডের ধারে একটা জায়গা কিনে বাড়িটা বানিয়ে ফেলে। পরে নিহারুল দীপের খোঁজে অনেক বার কলকাতা গিয়েছে, স্টেশনে অনেক খোঁজা খুঁজি করেছে, অন্য টিকিট বিক্রেতাদের ধরে ধরে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু দীপের সঙ্গে তার আর কোন দিন দেখা হয় নি। কেউ তার কথা বলতে পারে নি, কেউ না।

।।চার।।
ছায়া নিহারুলের এই বাড়িতেই ছিল। মাস খানেক হল সে ওখানে গিয়েছে। তার বাবার বাড়ি। তার বাবা এসে নিয়ে গিয়েছে। মায়ার বেলাতেও সে এই সময় ওখানে ছিল। সেবারও তার বাবা এসে নিয়ে গিয়েছিল।

।।পাঁচ।।
সজলের সঙ্গে কথা বলার পর নিহারুলের আর হাঁটতে বেরনো হল না। তক্ষুনি সে বেরিয়ে পড়ল। তাকে যে এক্ষুনি হাসপাতালে ছায়ার কাছে পৌঁছাতে হবে। ছায়া নিশ্চয়ই তাকে খুব মিস করছে। এই সময় মেয়েরা প্রিয় জনকে খুব মিস করে।
হাসপাতালে কদম গাছতলায় ছায়ার মা-বাবা বসে রয়েছে। নিহারুল হাসপাতালে পৌঁছে তাদের দেখে কাছে এগিয়ে গেল,” আপনারা  বাইরে কেন?”
ছায়ার বাবা বলল,” ভিতরে বাড়ির লোক থাকতে দিল না, বের করে দিল। তাই, বাইরে এসে বসলাম।”
” আর ছায়া?”
” ছায়া ভিতরে আছে।”
” বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়েছে?”
” এখনও হয় নি। হলে মাইকে ডাকবে বলেছে।”
” ডাকেনি?”
” না।”
” সে কী!” নিহারুলের চিন্তা হল।
ছায়ার মা তখন বলল,” আমার খুব ভয় করছে।”
নিহারুল জিজ্ঞেস করল,” কেন?”
” ছায়া ভর্তি হওয়ার পর দুটো মেয়ে প্রেসার বেড়ে খিঁচুনি হয়ে মারা গেল। ও দুটো বাচ্চা হয়ে হয়ে। ছায়ার কপালে যে কী আছে এক মাত্র খোদাই জানে!”
নিহারুলের চোখে, মুখে এতক্ষণ আতঙ্কের কোন ছাপ ছিল না। সে এতক্ষণ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ছায়ার মায়ের মুখে কথাটা শোনার পর সে কেমন হয়ে গেল। গত মাসে লাস্ট চেক আপে গিয়ে ডাক্তার তার ব্লাড প্রেসার হাই বলেছিলেন। কাঁচা নুন, ঝাল,মশলা ও চর্বি জাতীয় খাবার খেতে নিষেধ করেছিলেন। সুতরাং নিহারুলের চিন্তা বেড়ে গেল। তার কিছু হয়ে গেল না তো? তাহলে সে যে বড় একা হয়ে যাবে, বড় একা। তাদের মায়াও যে মা হারা হয়ে যাবে। তার মায়ের অভাব সে কি পূরণ করতে পারবে? পৃথিবীতে সন্তানের কাছে বাবার চেয়ে মা-ই হল বেশি আপন, বেশি প্রিয়। সে তাকে মানুষ করবে কীভাবে? মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্টে যে তার বুক ফেটে যাবে।…ভাবতে ভাবতে নিহারুলের চোখে জল চলে এল এবং খানিক বাদে ভেজা চোখ দুটো রগড়ে নিয়ে সে বলল,” মায়া কোথায়?”
” মায়া বাড়িতে। ওর খালার কাছে রেখে এসেছি।”
মায়ার এই খালার নাম হল সাকিনা। তার বিয়ে হয় নি। কলেজে পড়ছে। মায়া তার এই খালার কাছে খুব থাকে। মায়াকেও সে খুব পছন্দ করে। ছায়ার কিছু হয়ে গেলে মায়ার কথা ভেবে হয়তো তাকে বিয়ে করতে হতে পারে। অতএব মায়ার ব‍্যাপারে তখনকার মতো নিহারুল নিশ্চিন্ত হলেও ছায়ার জন্য তার চিন্তা আরও বেড়ে গেল এবং ঘনীভূত হল। ছায়াকে সে একবার দেখতে পেল না। কে জানে যে এত আগে….তাহলে সে তো দু’ দিন আগেই চলে এসে ছায়ার পাশে বসে থাকত। যেমন মায়ার বেলায় ছিল। ছায়ার যেন কিছু না হয়। মা ও শিশু দু’ জনেই যেন খুব ভালো থাকে। দ্বিতীয় বিয়ে তাকে যেন করতে না হয়। উপর অলাকে নিহারুল স্মরণ করল। আর তখনই হাসপাতালের মাইকে ঘোষণা হল,” ছায়া বিবির বাড়ির লোক কে আছেন, আসুন!”
নিহারুল অমনি ছুটতে লাগল।ছুটতে ছুটতে গিয়ে বলল,” সিস্টার, আমি ছায়া বিবির বাড়ির লোক, আমি ছায়া বিবির স্বামী। কী হয়েছে, আমাকে বলুন!”
সিস্টার বললেন,” আপনার মেয়ে হয়েছে।”
শোনা মাত্র নিহারুল আর ওখানে দাঁড়াল না। ‘আমার মেয়ে হয়েছে, আমার মেয়ে হয়েছে’ করে লাফাতে লাফাতে বাইরে বেরিয়ে চলে এল। বাইরে অধীর আগ্রহে বাড়ির লোক যারা অপেক্ষা করছিল খবরটা তখন সবার শোনা হয়ে গেল।
প্রথমটা যেহেতু কন্যা সন্তান হয়েছে নিহারুলের শ্বশুর বাড়ির মানুষের তাই এবার একটা পুত্র সন্তান কাম‍্য ছিল, মানে ব‍্যাটা ছেলে। বিশেষ করে নিহারুলের শাশুড়ি মায়ের। কিন্তু সেটা হল না বলে তার মনটা খারাপ হল। নিহারুলের সামনে তো সে বলেই ফেলল,” আল্লা এবারও মেয়ে দিল! একটা ছেলে দিল না!”
নিহারুল তার শাশুড়ি মায়ের কথায় ভীষণ রেগে গিয়ে তার শাশুড়ি মাকে বলল,” মেয়ে হল তো কী হল? মেয়েরা কি মানুষ নয়? আপনিও তো মেয়ে। তাহলে আপনি কি মানুষ নন? সুতরাং মেয়ে হয়েছে শুনে…. কেন আপনি?” তারপর সে সাবধান করে দিল,” খবরদার! এ রকম কথা আর একদম  বলবেন না। অন্তত আমি যেন শুনতে না পাই।”
নিহারুলের শাশুড়ি মা তখন বিরাট লজ্জা পেয়ে গিয়ে নিহারুলের কাছে ভুল স্বীকার করল,” আমার ভুল হয়েছে, বাবা।” তারপর জিজ্ঞেস করল,” মা ও শিশু কেমন আছে?”
নিহারুলের এটা জিজ্ঞেস করে আসা হয়নি। সুতরাং সে আবার ছুটল,” সিস্টার, মা ও শিশু কেমন আছে?”
সিস্টার বললেন,”আপনি কি পাগল আছেন একটা?”
সিস্টারের তাকে এ রকম কথা বলার কারণ কী, নিহারুল সেটা ঠিক বুঝতে না পেরে সিস্টারের মুখের দিকে হাঁ করে তাকাল।
সিস্টার বললেন,” মেয়ে হয়েছে শুনে তখন তো নাচতে নাচতে খুব ছুটলেন। একবারও জানতে চাইলেন না, মা ও শিশু কেমন আছে?”
” সরি! আমার ভুল হয়ে গেছে। এখন বলুন,মা ও শিশু কেমন আছে?”
” বাচ্চার অবস্থা ভালো নেই। বমি করছে। নোংরা খেয়ে ফেলেছে। স‍্যালাইন চলছে।”
সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে উদ্ভাসিত নিহারুলের সুন্দর মুখ খানা কেমন ফ‍্যাকাশে হয়ে গেল। তারপর কাঁদো কাঁদো হয়ে জিজ্ঞেস করল,” আর মা?”
” মায়েরও স‍্যালাইন চলছে।”
তারমানে মা ও শিশু দু’ জনের কেউই ভালো নেই। যার দরুন ভীষণ দুশ্চিন্তায় কেটে গেল পুরো সারাটা দিন এবং পরের দিনও। তারপরের দিন থেকে নিহারুলের মনের আকাশে যত কালো মেঘ ছিল সব আস্তে আস্তে কেটে গেল। মা ও শিশু দু’ জনই এখন সুস্থ আছে, ভালো আছে।

পুনশ্চঃ নিহারুলের দুই মেয়ে হল। দুই মেয়েকেই নিহারুল মানুষের মতো মানুষ করবে। এতে তার যত টাকা লাগে সে খরচ করতে রাজি আছে। তারপর তার মেয়ে দুটো মানুষ হয়ে গেলে তার আর কোন চিন্তা থাকবে না। শুধু পুত্র সন্তানের জন্য যারা লালায়িত হয় তাদের দেখিয়ে দেবে যে, শুধু ছেলেরাই নয়, মেয়েদের প্রতি উদার মানসিকতা থাকলে মেয়েরাও মানুষ হয়। পরবর্তীতে নিহারুলের মেয়ে দুটো সত্যি সত্যি মানুষ হয়। মায়া হয় আই পি এস অফিসার। আর দ্বিতা হয় ডাক্তার। নিহারুল সেটা সমাজের মানুষদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও ওরা দেখে না। আসলে সমাজটাই যে অন্ধ। নিহারুল এর কী ব‍্যাখ‍্যা দেবে!

 

এসএস/সিএ

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন