দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান!
রেদওয়ানুল হক ।। আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে হাজার মাইল দূরে থেকে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। প্রবাসী শ্রমিকরা সব সময় নিজেদের স্বাদ-আহ্লাদ সবকিছু বিসর্জন দেন শুধু পরিবারের কথা চিন্তা করে। দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে অনন্য অবদান রেখে চলেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান
যদিও দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান ক্ষেত্রে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও বেকার সমস্যার সমাধানকে প্রধান সুবিধা হিসেবে ধরা হয় কিন্তু বাস্তবে প্রবাসীরা বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে বিভিন্নমুখী অবদান রেখে যাচ্ছেন। প্রান্তিকপর্যায়ে অর্থনৈতিক বিপ্লবের নায়ক এই প্রবাসীরাই।
এমনকি আমদানি-রপ্তানি সমন্বয় করলে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত থেকেও এগিয়ে আছে জনশক্তি রপ্তানি খাত। দৈনিক আমার সংবাদের সঙ্গে আলাপকালে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের এসব অনন্য অবদানের বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরেন জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা।
তিনি বলেন, আমাদের এক্সপার্টরা শুধু দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন কিন্তু প্রবাসীদের অর্জন এত বেশি যে এর পরোক্ষ প্রভাব বিশ্লেষণ করলে এক কথায় বলা যায় আর্থিক খাতে একটা বড় বিপ্লব হয়ে যাচ্ছে।
সোয়া কোটি প্রবাসীর কর্মসংস্থান বিদেশের মাটিতে হওয়ায় দেশের ওপর থেকে চাপ কমছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব প্রবাসী বিদেশে থাকায় আবাসন, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পরিবহন খাতে দেশের ওপর থেকে চাপ কমেছে। যেমন- বর্তমানে দেশের যে পরিমাণ খাদ্য উৎপন্ন হয় তাতে দেশ খাদ্যে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু অতিরিক্ত সোয়া কোটি মানুষের খাদ্য যোগ হলে আমদানি নির্ভরতা বেড়ে যেত। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কোটি সেবাগ্রহীতা যুক্ত হলে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়ত স্বাস্থ্য খাত। পরিবহন খাতেও এর বড় প্রভাব পড়ত। বাড়ত যানজট আর গণপরিবহনে ভিড় কয়েকগুণ বেড়ে যেত যেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন আরও অনেক সূক্ষ্ম বিষয় আছে যা বিবেচনায় আনতে হবে। তাহলে এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা সহজ হবে।
গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে প্রবাসীদের অনন্য ভূমিকা বিশ্লেষণ করে বায়রার এ সাবেক সভাপতি বলেন, প্রবাসীরা গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। টাকার অভাবে এখন আর কোনো জমি অনাবাদি থাকছে না। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে সাত কোটি মানুষ ছিল তখন খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল, এখন জনসংখ্যা ১৭ কোটি অর্থাৎ প্রায় আড়াই গুণ তবুও খাদ্য সংকট হচ্ছে না বরং আমরা মাঝে শ্রীলঙ্কাতে কিছু রপ্তানিও করেছি। আমাদের এখনো মাঝেমধ্যে আমদানি করতে হয় কিন্তু ওরকম সংকট নেই।
এর পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে তা হলো— গ্রামের অধিকাংশ সক্ষম পুরুষ বিদেশে চলে যাওয়ায় ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করা হয়েছে। ফলে জমির বর্ষণ বেড়েছে। পাশাপাশি কৃষিবিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় উন্নত মানের বীজ উৎপাদন হওয়ায় ফলন বেড়েছে। আমাদের কৃষকরা এখন আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি রপ্ত করে ফেলেছে।
যারা দেশের বোঝা ছিল তারাই এখন নায়ক হয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে উল্লেখ করে মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, বিদেশে রপ্তানিকৃত জনশক্তির ৯৫-৯৬ ভাগ গ্রামের মানুষ। যাদের প্রায় সবাই ছিল অশিক্ষিত ও বেকার এবং সমাজের জন্য বোঝা। কিন্তু এরাই বিদেশে গিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সংসারের হাল ধরছে। প্রতিবছর দেশে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪২-৪৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দেশের যারা বোঝা ছিল তারাই এখন অর্থনীতির নায়ক।
গ্রামের সার্বিক জনজীবনে প্রবাসীদের ভূমিকা বর্ণনা করতে গিয়ে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের সাবেক এ প্রশিক্ষক বলেন, আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা মানিলন্ডারিং করে না বরং তাদের অর্জিত বিলিয়ন বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা দেশিয় মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে গ্রামে মা-বাবা, ভাই এবং স্ত্রীর কাছে যাচ্ছে। এসব টাকায় গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা পুরোপুরি বদলে গেছে। আগে মানুষ উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করত। রাতের আঁধারে খোলা জায়গায় প্রাকৃতিক কাজ সারতে হতো। এতে পরিবেশ মারাত্মক দূষণের শিকার হতো।
গ্রামে এখন আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কুঁড়েঘর এখন বিল্ডিং হচ্ছে। এখন আর পুকুরের পানি খেতে হয় না, নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি পানের ব্যবস্থা হয়েছে। অর্থকষ্ট ও খরচ মেটাতে অক্ষম হওয়ায় ছোট শিশুদের কাজে পাঠানো হতো। এসব শিশু এখন স্কুলে যাচ্ছে। এখন আর বিনাচিকিৎসায় মানুষ মারা যায় না। হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছে। অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা সাধারণ মানুষ এখন উন্নত খাবার খেতে পারছে। এসবই প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় হচ্ছে। এছাড়া গ্রামের সামাজিক কর্মকাণ্ডেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন প্রবাসীরা। শিল্প উৎপাদন, স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তারা অংশ নিচ্ছেন। এককথায় প্রবাসীদের মাধ্যমে জাতি বড় ধরনের বেনিফিট পাচ্ছে।
গড় আয়ু ৫৬-৫৭ বছর থেকে বর্তমানে ৭২-৭৩ বছর হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রবাসীদের ভূমিকা আছে বলে মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ। অর্থকষ্ট না থাকায় স্বাচ্ছন্দ জীবন ও সামাজিক উন্নয়ন এর প্রধান কারণ। আর এ ক্ষেত্রে পরোক্ষ ভূমিকা রাখছেন প্রবাসীরা। বায়রার সাবেক এ সভাপতি বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পণ্য রপ্তানি খাত সবার শীর্ষে থাকলেও সার্বিক বিচারে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান তথা মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম।
কারণ পণ্য রপ্তানি বাবদ যে অর্থ উপার্জিত হয় তার একটি বড় অংশই কাঁচামাল আমদানিতে চলে যায়। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানি খাত এমনই এক অর্থনৈতিক খাত যার উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে।
একইসঙ্গে জনশক্তি রপ্তানি খাত দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা নিরসনে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে। এরা যদি বিদেশে কর্মসংস্থানে যেতে না পারত তাহলে দেশের বেকার সমস্যা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করত। একই সাথে পণ্য রপ্তানি খাতে ভর্তুকী, প্রণোদনা ও ঋণ সহায়তা হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
বিতরণকৃত ঋণের শত-সহস্র কোটি টাকা আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে জনশক্তি রপ্তানি খাতে নেই কোনো প্রণোদনা, নেই কোনো ঋণ। যেহেতু ঋণ নেই তাই খেলাপিও নেউ। অর্থাৎ জনশক্তি রপ্তানি খাত পুরোটাই বিনিয়োগবিহীন লাভজনক খাত।
-সূত্রঃ আমাদেরসংবাদ
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান