দেশের সংবাদ

ফাঁসির দণ্ড পাওয়া সাতজনের কার কী দায়

ফাঁসির দণ্ড পাওয়া সাতজন
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাত আসামি
রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বেকারিতে হামলা মামলার রায়ে আট আসামির মধ্যে সাতজনের ফাঁসির দণ্ড আদেশ দিয়েছেন আদালত। এই মামলায় একজনকে বেখসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। বিচার শুরু হওয়ার এক বছরের মাথায় এ মামলার রায় হয়।
 
আজ বুধবার বহুল আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করলেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।
 
ফাঁসির দণ্ড পাওয়া সাত আসামি হলেন- রাকিবুল ইসলাম রিগ্যান ওরফে রাফিউল ইসলাম, রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর আলম, মোহাম্মদ আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, মোহাম্মদ হাদিসুর রহমান সাগর ওরফে সাগর, মামুনুর রশিদ রিপন, শরিফুল ইসলাম খালেদ। আর খালাস পেয়েছেন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান।
 
২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ংকর জঙ্গি হামলা স্তম্ভিত করেছিল পুরো বাংলাদেশকে। ফাঁসির দণ্ড পাওয়া সাত আসামির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনে রায় ঘোষণা করেছেন আদালত সেগুলো হলো-
 
১. রাকিবুল ইসলাম রিগ্যান ওরফে রাফিউল ইসলাম
অভিযোগ : নিষিদ্ধ সত্তার সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ গ্রহণ, হামলায় জড়িতদের প্রশিক্ষণ দিয়ে হত্যাকাণ্ডে সহায়তা ও প্ররোচিত করা। এইচএসসি পাস। হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী জঙ্গিদের প্রশিক্ষক। বসুন্ধরার যে বাসা থেকে হামলাকারীরা হলি আর্টিজানের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন, সে বাসায় যাতায়াত ছিল। ২০১৪ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে পড়ার সময় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। পরের বছর ঢাকায় চলে আসেন। মোট ছয়টি বাসায় ছিলেন। ২৭ জুলাই কল্যাণপুরের জাহাজ বিল্ডিংয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অভিযানে গুরুতর আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন।
দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি অনুযায়ী গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির হামলা ছিল প্রকৃত ইসলাম কায়েমের একটি দৃষ্টান্ত।
 
২. রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর আলম
অভিযোগ : নিষিদ্ধ সত্তার সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ গ্রহণ, পরিকল্পনা হামলায় জড়িতদের সহায়তা, ঘটনাস্থল রেকি, সার্বিক বিষয়ে অবগত থেকে হত্যাকাণ্ডে সহায়তা সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর আলম হলি আর্টিজানে হামলাকারী খায়রুল ইসলাম পায়েল ওরফে, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বলকে সরবরাহের কথা স্বীকার করেছেন।
আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি নব্য জেএমবির উত্তরবঙ্গের ‘ইসাফা’ গ্রুপের প্রধান। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৪টি জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণের পর সক্রিয়ভাবে জেএমবিতে যুক্ত হন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানাধীন বোনারপাড়ার একটি বাসায় তামিম চৌধুরী, মেজর জাহিদ, সারোয়ার জাহান মানিক, তারেক, মারজান, শরিফুল ইসলাম খালিদসহ তিনি আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করেন। ওই পরিকল্পনা বৈঠকেই সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় তামিম চৌধুরী ওরফে তালহাকে। হলি আর্টিজানে হামলাকারী সরবরাহ করেছেন।
 
৩. মোহাম্মদ আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ
অভিযোগ : নিষিদ্ধ সত্তার সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ লেনদেন, হামলাকারীদের তুলে নিয়ে প্রশিক্ষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া ও বোমা ছোড়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া, ঘটনাস্থল রেকি করা, অস্ত্র বহন করে নিয়ে আসা। মোটের ওপর হামলার পরিকল্পনায় অংশ নিয়ে হত্যাকাণ্ডে সহায়তা ও প্ররোচনা দেওয়া হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার কথা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন। এসএসসি পাস। ২০১৪ সালের ১ রমজান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র শরিফুল ইসলাম খালেদের হাতে হাত রেখে বায়াত নেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তামিম চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর নব্য জেএমবিতে যোগদান। হামলাকারীদের ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে তুলে নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য পৌঁছে দেন। তাদের প্রস্তুত করে অস্ত্র, গুলি ও ম্যাগাজিন সরবরাহ করেন। হলি আর্টিজান বেকারি রেকি করেন। বসুন্ধরায় হামলাকারীদের অবস্থানের জন্য বাসা ভাড়ার সন্ধান করেন।
 
৪. আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ
অভিযোগ : শুরা সদস্য হয়ে টাকা গ্রহণ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক পদার্থ সংগ্রহ, তৈরি ও সরবরাহ করে হোলি আর্টিজান বেকারির হত্যাকাণ্ডে সহায়তা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, জেএমবিতে যুক্ত ২০০২ সাল থেকে। সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইয়ের সহযোগী ছিলেন। নওগাঁর আত্রাইতে বোমা বানানোর সময় হাত উড়ে যায়। তার সরবরাহকৃত অস্ত্র ও গ্রেনেড গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির হামলায় ব্যবহার হয়েছিল।
২০১৬ সালের মে মাসে নব্য জেএমবিতে যোগ দেন। মিরপুরের একটি বাসায় তামিম চৌধুরী ও বাশারুজ্জামান চকলেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ। সেখানেই গুলশানে বড় হামলার পরিকল্পনা। এ জন্য লোক সংগ্রহ, অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ছোট মিজান ও আসলামকে অস্ত্র বুঝিয়ে দেন।
 
৫. মোহাম্মদ হাদিসুর রহমান সাগর ওরফে সাগর
অভিযোগ : নিষিদ্ধ সত্তার সমর্থন, সদস্য পদ গ্রহণ, অর্থ গ্রহণ, হামলার জন্য অস্ত্র গ্রেনেড সরবরাহ করে হত্যাকাণ্ডে সহায়তা ও প্ররোচিত করা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, ঝিনাইদহে অবস্থানের সময় হলি আর্টিজানে হামলায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী নিবরাস ও মোবাশ্বেরের সঙ্গে সাংগঠনিক কাজে যুক্ত ছিলেন। ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ায় হামলা ও প্রস্তুতি হিসেবে টার্গেট কিলিং সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। হলি আর্টিজানে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র নিজেদের জিম্মায় রেখেছিলেন। হলি আর্টিজানে হামলার ২০–২২ দিন আগে তামীম আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশে একটি কালো ব্যাগে করে হাদিসুর চারটি গ্রেনেড ঝিনাইদহ থকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ওই গ্রেনেড হলি আর্টিজান বেকারির হামলায় ব্যবহৃত হয়েছিল।
 
৬. মামুনুর রশিদ রিপন
অভিযোগ : দাখিল পাস। জেএমবির দায়িত্বশীল নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। সারোয়ার জাহান, ডাক্তার নজরুল ও অন্যদের নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক উদ্বুদ্ধকরণ মিটিং ও সদস্য সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রাখেন। তামিম আহমেদ চৌধুরী ও সারোয়ার জাহানদের সঙ্গে মিলে আইএসপন্থী নব্য জেএমবি গঠনে যুক্ত ছিলেন। ২০১৪ সালের মে মাসে জয়পুরহাটে বৈঠক করে আইএস ভাবাদর্শ অনুসারে কাজের সিদ্ধান্ত নেন।
 
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া বাজার কলেজ মোড়সংলগ্ন একটি বাড়িতে সারোয়ার জাহান মানিক, নুরুল ইসলাম মারজান, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, বাশারুজ্জামান চকলেট, মেজর (অব) জাহিদ, রাজীব গান্ধী, শরিফুল ইসলাম খালেদ, রায়হানুল কবির রায়হানদের সঙ্গে বৈঠক। ওই বৈঠকেই ঢাকার হলি আর্টিজানে হামলার প্রাথমিক পরিকল্পনা হয়ে যায়। হাদিসুর রহমান সাগরের সঙ্গে তিনটি একে-২২ রাইফেল, গুলি, চারটি গ্রেনেড, দুটি ৭.৬২ পিস্তল ও ১২ রাউন্ড গুলি মারজানের মাধ্যমে তামিম আহমেদ চৌধুরীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।
 
৭. শরিফুল ইসলাম খালেদ
অভিযোগ : সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ লেনদেন, প্রশিক্ষণে সহায়তা, হামলা পরিকল্পনায় অংশ নিয়ে হামলাকারীদের যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়াসহ হত্যাকাণ্ডে সহায়তা ও প্ররোচিত করা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল নিজ বিভাগের অধ্যাপককে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া বাজার কলেজ মোড়ে হামলার পরিকল্পনা বৈঠকে হাজির ছিলেন। হামলাকারী জঙ্গিদের দলে অন্তর্ভুক্তিকরণ, প্রশিক্ষণসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
 
এই মামলায় মোট আসামি ছিলেন আটজন। তার মধ্যে ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন সাতজন এবং এর মধ্যে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান খালাস পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল নিষিদ্ধ সত্তার সদস্য পদ গ্রহণ, বিস্ফোরক পদার্থ (জেল জাতীয় পদার্থ), যা বোমা তৈরির উপাদান সরবরাহ করে হত্যাকাণ্ডে সমর্থন দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মিজান বলেছিলেন, তিনি মাছ ব্যবসায়ী। ২০১৬ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে জামাল নামে এক ব্যক্তি তাঁর জিম্মায় বড় ব্যাগ রেখে যায়। ওই ব্যাগে জেল বোমা ছিল বলে পরে জানতে পেরেছেন।
 
সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − two =