ফিচার্ড লেখালেখি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৪৯তম মহাপ্রয়াণ দিবস স্মরণে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৪৯তম মহাপ্রয়াণ দিবস স্মরণে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। বিদ্যুৎ ভৌমিক

শোকাহত
রক্তঝরা ১৫ আগস্ট । বাংলার ইতিহাসে অবিরল অশ্রুঝরার দিন । ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এক বিভিষিকাময় রাতে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনাটি ছিলো একাধারে নৃশংস, কাপুরুষোচিত ও বীভৎস – গোটা জাতি হয়েছিলো স্তম্ভিত, দুঃখভারাক্রান্ত ও শোকাহত । বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ছিল একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

বাংলাদেশের অভ্যূধ্যয়ে যে মহান, ত্যাগী সংগ্রামী  মানুষটি তার জীবনের সর্বস্ব উজাড় করে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নতুন দেশ উপহার দিয়েছেন ,সেই স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, গণসংগ্রামে সর্বদা আপসহীন   জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের  ৪৯তম শাহাদত বাষ্িকীতে  বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি বাঙালি জাতির বাঁচার অধিকারের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এমন  ত্যাগ, বীরত্ব, বিবেক সাহসীকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন যে, যিনি ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলের প্রায় বারো বছর জেলে কাটিয়েছেন বারো বছর জেলে এবং দশ বছর কড়া নজরদারীতে থাকার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে পাকিস্তানকে নিজের স্বাধীন বাসভূমির পরিবর্তে বরং ভয়ংকর কারাগার বলেই মনে হতো। বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। সেই আত্মপরিচয়ের সংগ্রামকে আত্মআবিষ্কার স্বাধীনসার্বভৌম জাতিসত্তায় উত্তরণের ক্ষেত্রে ২৪ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে বাঙালি জাতির আত্মত্যাগ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অংশগ্রহণ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় () দফার ঘোষণা থেকেই মূলত বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম আত্মআবিষ্কারের সুস্পষ্ট ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল। ১৯৬৯এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০এর নির্বাচন, ১৯৭১এর ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বর আক্রমণকালে জাতির পিতার স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা তারই গৌরবোজ্জ্বল রক্তস্নাত অধ্যায় বাঙালি জাতিসত্তা দীর্ঘ পথচলায় অজস্র অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। দুর্জয় মনোবল, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক অঙ্গীকার আত্মত্যাগের মহিমায় আদর্শ নিয়ে সেই সব অগ্নিপরীক্ষায় বাঙালি জাতি উত্তীর্ণ হয়েছে। এই অস্তিত্ব সচেতন লক্ষ্যাভিমুখী জাতিসত্তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক মহান দিক নির্দেশক হিসেবে আবির্ভূত হন কেবলমাত্র নেতা হওয়ার বাসনা নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের জন্ম বিকাশ ঘটাননি বঙ্গবন্ধু অসংখ্য নেতাকর্মী সৃষ্টি করে দেশকে পরাধীনতার গ্লানি হতে মুক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দক্ষতা বাড়াতে সারাদেশ চষে বেরিয়েছেন কোনরকম পারিবারিক, আমলাতান্ত্রিক বা গোষ্ঠীগত কায়েমী স্বার্থবাদী ফ্রেমে বন্দী থাকার মানুষ বঙ্গবন্ধু কখনও ছিলেন না; গৌরবউজ্জল ইতিহাসের ফ্রেমে বরণীয় আর আদৃত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে  

আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু কোন দলের নয়, বঙ্গবন্ধু সবার গর্বের বস্তু বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একটি অবিচ্ছেদ্য নাম কেউ মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশকে স্বীকার করলে তাকে অবশ্যই   বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ত্যাগ ও অবদানকে স্বীকার করতেই হবেকিন্তু স্বাধীনতার ৫২বছর পর রাজনৈতিক মতদ্বৈধতার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এখন আর বাংলাদেশশের জাতির জনক ননসম্প্রতি বাংলাদেশে তথাকথিত গনঅভ্যুত্থানে  শেখ হাসিনার পতনের পর সেদেশে কোথাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোন অস্তিত্ব নেইদু;খজনক হলেও সত্যি অসংখ্য ম্যুরাল ভাস্কর্য স্মৃতি চিহ্ন সব ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘর এবং আক্রান্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সমৃতিবিজড়িত ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীঅথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার  মহান স্থপতি, গণসংগ্রামে সর্বদা আপসহীন   জাতির জনক। একই সাথে ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এম, এ আজীজ, জিললুর রহমান, সৈয়দা জোহরা তাজউদদিন,  মতিয়া চৌধুরী ও আবদুর রাজ্জাক মত ত্যাগী নেতৃবৃন্দ ও  তাদের করা  রাজনৈতিক দল  আওয়ামী লীগের মত  ৭৫ বছরের পূরাতন একটি ঐতিহ্যবাহী, গণসংগ্রামে সর্বদা আপসহীন ও সংগ্রামী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার দাবী জানাচ্ছেন যেসব ছাএ ও দল,  তাদেরকে আবেগপ্র্রবণ ও ভাবাবেগে বশবর্তী না হয়ে  ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের অনুরোধ করছি। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার এহেন  হটকারী ও ভূল দাবী থেকে সরে আসার অনুরোধ করছি। আমরা স্বীকার করি, আওয়ামী লীগের কিছু লোভী ও Highbred নেতাও মন্ত্রীর  দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির জন্য আওয়াামী লীগের এমন পরিনতি হয়েছে। অধিকন্তু, আওয়ামী লীীগ সরকার বৈসম্যবিরোধী ছাএ আন্দোলনকারীদের উপর দমননীতি চালিয়ে বড় ধরনের ভূল করেছেন- যার ফলশ্রুতিতে ছাএদের দ্বারা গনঅভ্যুথ্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। বর্তমান মাননীয় সরাষ্ট্র উপদেষ্টা বিগ্রডিয়ার অব: সাখাওয়াত হোসেন  ঠিকই বলেছেন, আওয়ামী লীগের অনেক অবদান আছে-এটা স্বীকার করতেই হবে। কিছুসংখক মানুষের ভূলের জন্য একটি ঐতিহ্যবাহী দলকে ছাএদের চাপে নিষিদ্ধ করা বড় ভূল সিদ্ধান্ত হবে। আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও গনতান্ত্রিক মানুষ আবার বঙ্গবনধুর আওয়ামী লীগকে ঘুরে দাড়াতে সহযোগীতা করবে এবং ভূল সিদ্ধান্ত   নিতে সতর্ক থাকতে হবে।

এটা ভূলে গেলে চলবেনা,  ১৯৭১ সালের মার্চ রমনার রেসকোর্সের জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে পুরো বাঙালী জাতি মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বজ্রকনটে ঘোষনা করেছেনএবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর এই তেজদিপ্তবজ্রকন্ঠের ঘোষণার মধ্যেই মূলত নিহিত ছিল আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের কালো রাতে বিশ্বাসঘাতক পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী সব মূল্যবোধ ন্যায়নীতি লঙ্ঘন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র নিরপরাধ বাঙালীর ওপর সেদিনযার যা আছে তাই নিয়েবাংলাদেশের কৃষক,শ্রমিক ছাএ জনতা আমাদের প্রানপিয় মাতৃভূমিকে রক্ষাকরার বলিষঠ চেতনায় উদবুদধ হয়ে স্বাধীনতার মশাল অস্ত্র হাতে নিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভারতের সাহায্য সহযোগীতায় দীর্ঘ নয় মাসের নিরন্তর মুক্তির লড়াইয়ের পর বিজয়ী হয় বাঙালী জাতি আমরা ছিনিয়ে এনেছি অামাদের মহান স্বাধীনতা, আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশসেদিনের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি রাজাকার ও আলবদর বাহিনী সহ উগ্র মৌলবাদী জামাত শিবির পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশে সংখালঘু হত্যা নির্যাতনসহ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবি হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগীতা করেছিল।  রক্তলিপসু পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল তাঁর এই ভাষণকে বিশ্বের ইতিহাসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের মধ্যে একটি অন্যতম ভাষণ বলে গণ্য করা হয় 

বঙ্গবন্ধু মানেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, স্বাধীন পতাকা ১৭৫৭ খ্রী: ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার দীর্ঘ ২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের  নির্দেশে ভারতের সহষোগীতায় দীর্ঘ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে দাষত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙালী জাতি যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনেন লালসবুজের রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা জাতীয় শোক দিবসে বাঙালী জাতি গভীর শোক শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে  ১৫ আগষ্ট  যেমন শোকার্ত হওয়ার দিন, তেমনি শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টার শপথ গ্রহণেরও দিন  বীরত্ব, সাহস তেজস্বীতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  ছিলেন এক আলোকিত ভাস্বর স্বাধীনতার মহান স্থপতি হিসাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংগালী জাতির জন্য সম্ভাবনার অসীম দিগন্ত উন্মোচন করিয়া গিয়াছেন কিন্তু আজ বঙ্গবন্ধু নেই তার সপ্ন এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আজ আংশিকভাবে পূরণ হয়েছে বর্তমান জাতীয় বিশ্বপরিস্থিতিতে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সুগভীর দেশপ্রেম মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহিত চেতনাই হতে পারে আগামী দিনে বাংলাদেশ বাঙ্গালি জাতির অগ্রগামিতার মহৎ প্রেরণা এগিয়ে চলার মহামন্ত্র বাংলাদেশে আইনের শাসন, অসাম্প্রদায়িক চেতনান্যায়বিচার, দূনীতি দমন সুশাসনের পথে এগোতে পারলেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় জাগরূক থাকবেন বলে আমরা মনে করি। 

 ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা রেডিও সার্ভিসের পক্ষ থেকে সারা বিশ্বে যে জরিপ চালানো হয়, তাতে মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হন।

জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি
এই শোকাহত দিনে আমরা পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এই মহান নেতাকে স্মরণ করি তাঁর কাজ, তাঁর অবদান, তার চেতনা তাঁর আদর্শকে

অশ্রুসজল নয়নে কানে বারংরার যেন বেঝে উঠছে:
যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা যমুনা বহমান,
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান

বিদ্যুৎ ভৌমিক: কলামিষ্ট, লেখক ও সিবিএনএ এর উপদেষ্টা। মন্ট্র্রিয়ল. ক্যানাডা । ১৫ আগষ্ট, ২০২৪ খ্রী: 

এসএস/সিএ
সংবাদটি শেয়ার করুন