বসন্তের রঙে ভালোবাসার সুর
জাকিয়া আহমেদ ।। ‘হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্র-সঙ্গীতে যতো আছে,/ হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে/ বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি/ তবুও ফুটেছে জবা,- দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে,/ তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্তপথিক ।…/ আমি তাই লঘুচালে বন্দিলাম স্বরূপ তাহার, সহজ অক্ষরবৃত্তে বাঙলার বসন্ত বাহার।’
পাতা ঝরার গান শেষে গাছে গাছে শোভা ছড়াচ্ছে সবুজ পাতার দল। পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার সেই সবুজের ঝাঁকে আগুনরাঙা ফুলের মেলা। শীতের হিমেল হাওয়ার বদলে বইতে শুরু করেছে দখিনা হাওয়া, তাতে ভেসে আসছে কোকিলের ডাক। প্রকৃতিতে ঋতুরাজ বসন্তের আবির্ভাবের চিত্রই ‘বসন্ত বন্দনা’ কবিতায় লিখেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। ১৪২৯ বঙ্গাব্দে সেই বসন্তের প্রথম দিন আজ। পহেলা ফাল্গুন। সেই ফাল্গুনি হাওয়ায় নতুন সাজে সেজে ওঠা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনেও যে ভালোবাসার সঞ্চার হয়, বর্ষপঞ্জি সংস্কারের পর ঠিক এই দিনটি সেই ভালোবাসারও দিন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
বছর দুয়েক আগেও উদযাপনটা হতো পরপর দুদিন। ১৩ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন, পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস। ঢাকায় চারুকলা থেকে বটতলা, অমর একুশের বইমেলা থেকে শুরু করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর থেকে হাতিরঝিল- দিন দুটো হয়ে উঠত বর্ণিল। সংশোধিত বর্ষপঞ্জিতে দুই বছর হলো বসন্তে মিশে গেছে ভালোবাসার রং। একই দিনে পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসে উদযাপনের আনন্দ হয়েছে দ্বিগুণ।
বাঙালি জীবনে অবশ্য বসন্ত আর আন্দোলন পাশাপাশি হাত ধরে চলেছে। বসন্তের আগমন বার্তা ১৯৫২ সালের ৮ ফাল্গুনে দ্রোহ ঘোষণা করেছিল বাঙালি, জেগে উঠেছিল ভাষার অধিকারের দাবিতে। সেই ফাল্গুন মনে করিয়ে দেয় ভাষার দাবিতে শাসকের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক-জব্বাসহ বাংলার তরুণরা। স্বাধীন দেশেও এই বসন্তেই স্বৈরাচারের শাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিক্ষার অধিকারের লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন দিপালী-কাঞ্চনরা। এই বসন্তের প্রাক্কালেই ১০ বছর আগে শাহবাগ চত্বরে এ দেশের জন্মের বিরোধিতা করে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে জেগে উঠেছিল তরুণ প্রজন্ম। সে বারুদ স্ফুলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।
সে তুলনায় ভালোবাসা দিবসের উদযাপনের ইতিহাস এ দেশে খুব পুরোনো নয়। নতুন শতাব্দী শুরুর আগে আগে বিশ্বায়নের ঢেউয়ে ভালোবাসা দিবসের আয়োজন ছড়ায় দেশে। এখন সে দিবসটিও হয়ে পড়েছে সর্বজনীন। এ দিনটিকে ভালোবাসার রঙে রাঙাতে তাই অপেক্ষায় থাকেন সবাই।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত দুই বছর বসন্তবরণ আর ভালোবাসা দিবসের আয়োজনে ছিল ভাটা। এবার প্রায় স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তাই এ উৎসব বাড়তি রং ছড়াবে বলেই প্রত্যাশা সবার। দেশের প্রধান প্রধান ফুলের বাজারের তথ্যও বলছে সে কথাই।
যশোরের গদখালীতে যেমন গত এক সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ৩০ কোটি টাকার ফুল। ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারের বিরুলিয়ার বিখ্যাত গোলাপ গ্রাম থেকে এ বছর ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির প্রত্যাশা করছেন ফুলচাষিরা। এরই মধ্যে রাজধানীর স্থায়ী ফুলের বাজারসহ অলিগলিতেও দুদিনের জন্য গড়ে ওঠা ফুলের দোকানগুলো বলছে, বসন্তবরণ আর ভালোবাসা দিবসের আয়োজনের জন্য প্রস্তুত সবাই।
বসন্তবরণে শিল্পকলা একাডেমিতে থাকছে বসন্ত উৎসব। একাডেমির নন্দনমঞ্চে এ আয়োজনে থাকছে বরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে সংগীত, কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, নৃত্য, বসন্তের পোশাক প্রদর্শনী ও কোরিওগ্রাফির নান্দনিক প্রদর্শনী। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ ১০ জনকে পুরস্কৃতও করবে একাডেমি।
জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদও মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে রেখেছে বৈচিত্র্যময় আয়োজন। উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের বরীন্দ্র সরণিতে বঙ্গবন্ধু মুক্তমঞ্চ ও পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্কেও থাকছে তাদের অনুষ্ঠান। এ ছাড়া বসন্তবরণের আয়োজন থাকছে রাজধানীর আরও বিভিন্ন স্থানে।
করোনার প্রভাব কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকা পৃথিবীতে এসব আয়োজনে নিশ্চিতভাবেই নামবে তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সী মানুষের ঢল। সবার অংশগ্রহণে বসন্তের রং ছুঁয়ে নেমে আসুক ভালোবাসার কোমলতা। শুভ বসন্ত, শুভ ভালোবাসা দিবস।
সূত্র: দৈনিক বাংলা