বাংলাদেশি মায়া আক্তারের জর্ডানের পোশাক খাতে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতিনিধি হওয়ার গল্প
জর্ডানের পোশাক খাতে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতিনিধি বাংলাদেশের মায়া আক্তারের গল্প প্রকাশিত হয়েছে ইউএন নিউজে। শনিবার (১২ মার্চ) প্রকাশিত প্রতিবেদনে মায়া আক্তারের নিজের বর্ণনায় তার বাংলাদেশ ছেড়ে জর্ডানে একজন সাধারণ পোশাক শ্রমিক হিসেবে যাওয়া এবং ঘটনাচক্রে সেখানকার প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতিনিধি হয়ে ওঠার গল্প বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছেঃ
আমি ছয় বছর আগে জর্ডানের একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি করার জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে আসি। ভবিষ্যতে কী হবে তখন সে ধারণা আমার ছিল না। কিন্তু, আমি একটি অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ নিয়েছিলাম যা আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে। আমার বয়স তখন সবে ১৯। আমার বাবার ঢাকায় একটি ছোট ফলের দোকান ছিল। আমার মা বাড়িতে সেলাই করে কাপড় বিক্রি করতেন। পরিবারে আমরা ছয়জন।
আমরা খুব কমই নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে পারতাম৷ আমি ভেবেছিলাম জর্ডানে কাজ করে পরিবারকে আর্থিকভাবে সমর্থন করতে পারব। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য টাকা বাঁচানোর আশায়ও ছিলাম।
প্রথমবার জর্ডান গিয়ে আমি ইরবিডের একটি কারখানায় রিসিপশনিস্ট হিসেবে কাজ করেছিলাম। চুক্তি শেষ হওয়ার পর আমি যখন বাড়ি ফিরে আসি, তখন আমি জানতে পারি যে আমার বাবার ক্যান্সার হয়েছে এবং আমাদের পরিবারের আর্থিক সমস্যা আরও খারাপ হয়েছে। আমার মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও, আমি হিন্দি এবং ইংরেজিতে সাবলীল ছিলাম। তাই আমি যখন জর্ডানে ফিরে যাই তখন আমি সাহাবের একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে লিয়াজো অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করি। আমি ব্যবস্থাপক এবং কর্মীদের আরও ভালোভাবে যোগাযোগ করতে সহায়তা করতে থাকি।
যেভাবে পুকুর থেকে নদীতে পড়লাম
একদিন জনাব আরশাদের সাথে আমার দেখা হয়। তিনি টেক্সটাইল, গার্মেন্টস এবং পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ‘জেনারেল ট্রেড ইউনিয়ন’ এর সংগঠক ছিলেন। তিনিই আমাকে বুঝালেন, ‘ইউনিয়ন অর্গানাইজার’ এর কাজটা আসলে কী। আমি আরশাদকে বলি যে অন্য কর্মীদের সাহায্য করতে পারলে এবং যারা কথা বলতে পারে না তাদের পক্ষে কথা বলার সুযোগ পাওয়া আমার জন্য হবে স্বপ্নপূরণের মতো একটা ব্যাপার। আমাকে অবাক করে দিয়ে আরশাদ সাহেব কয়েক মাস পর আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন আমি এই কাজ করতে আগ্রহী কিনা। আমি রাজি হয়ে যাই।
এতে আমি মুক্তি পাই। আমার অবস্থা পুকুরে থাকা মাছের নদীতে গিয়ে পড়ার মতো হয়। প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করি। বহুভাষী এবং ভালো যোগাযোগ দক্ষতা থাকার কারণে আমি সে সমস্ত অনেক কর্মীকে প্রতিনিধিত্ব করতে এবং সাহায্য করতে সক্ষম হই যারা কেবল তাদের স্থানীয় ভাষাতেই কথা বলতে পারতো।
শ্রমিক এবং ব্যবস্থাপনার মধ্যে সেতুবন্ধন হয়ে ওঠা
আমি ২০২০ সালের নভেম্বরে ইউনিয়ন সংগঠক হিসেবে কাজ শুরু করি। আমার শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল- প্রবাসী শ্রমিকরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয় সেগুলো চিহ্নিত করা এবং পোশাক কারখানা পরিচালনার সাথে জড়িতদের সাথে খোলামেলাভাবে কথা বলার মাধ্যমে সেসব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা। কর্মীরা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার কারণে তাদের সাথে বৈঠকের ব্যবস্থা করা প্রথমদিকে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেকে এমনকি বাংলাদেশের প্রতিনিধির কাছে মুখ খুলতেও দ্বিধাবোধ করতো। কেউ কেউ আবার তাদের চাকরি হারানোর ভয়ে থাকতো। তাদের পরিচালকরা তাদের ইউনিয়ন অর্গানাইজারদের সহযোগিতা না করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কারণ তারা ভেবেছিলেন আমরা সমস্যা করবো।
কিন্তু, আমি শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর শোনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। আমি তাদের পরিচয় গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এবং তাদের সাথে কর্মক্ষেত্রের বাইরে দেখা করেছিলাম যাতে তারা নিজেকে প্রকাশ করতে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারে। কিছু কর্মী জানতো না যে কিভাবে তাদের অভিযোগ উপস্থাপন করতে হয়। আর, অন্যরা শাস্তির ভয়ে বা চাকরি হারানোর ভয়ে তাদের সমস্যার কথা বলা এড়িয়ে যেতো।
উদাহরণস্বরূপ, কিছু কর্মীকে তাদের চুক্তি শেষ হওয়ার পরও তাদের নিয়োগকর্তারা রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু, তারপর নিজেদের বাড়ি যেতে তারা বিমানের টিকিটও পেতো না অথবা চুক্তি শেষ করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতো। অন্যদের অনেকে আমার কাছে যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা জানায়। কেউ কেউ তাদের বেতন প্রাপ্তিতে বিলম্ব বা তাদের সুপারভাইজারদের সাথে তর্কের কথাও জানায়।
বাংলাদেশে পরিবারকে নিয়মিত টাকা পাঠান মায়া
বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং অন্যান্য দেশের বেশিরভাগ শ্রমিক আরবি বা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারে না বা পড়তে পারে না। তাই, এসব ভাষায় যখন কোনো নোটিশ বা ঘোষণা দেয়া হয় অথবা যখন আর্থিক নথিগুলো এই ভাষায় করা হয়ে থাকে, তখন সেটা কর্মীদের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে, বহুভাষী এবং ভালো যোগাযোগকারী হওয়ার কারণে আমি অনেক কর্মীদের প্রতিনিধিত্ব করতে এবং সাহায্য করতে সক্ষম হয়েছি। আমি তাদের ভাষাগত এ সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করতে পেরে গর্বিত বোধ করি।
আমি ‘বেটার ওয়ার্ক জর্ডান’ দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতেও অংশ নিয়েছি। এসব কর্মসূচিতে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, কার্যকর যোগাযোগ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি, যৌথ দর কষাকষি, কাজের অবস্থা এবং শ্রম আইনের মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। এই প্রশিক্ষণগুলো পেয়ে আমি নারী এবং অভিবাসী কর্মীদের আরও ভালোভাবে সাহায্য করতে সক্ষম হয়েছি। অভিবাসী কর্মীদের সাহায্য এবং ক্ষমতায়ন করতে পারা, আমার জীবনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি।
কোভিড নিষেধাজ্ঞার সময়, আমি কর্মীদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে মিটিং করতে পারিনি। শ্রমিকরা কেমন করছে তা দেখার জন্য তখন টেলিফোনের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। লকডাউন চলাকালীন সময়ে অনেক শ্রমিক তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিমানবন্দর বন্ধ থাকায় তারা ভ্রমণ করতে পারেননি। আমাকে ওই কঠিন পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল এবং সেসব শ্রমিকদের পরামর্শ দিতে হয়েছিল যারা প্রায়শই জর্ডানে আটকা পড়ছিলেন।
সামনের দিনগুলোতে…
অভিবাসী কর্মীদের সাহায্য করা এবং ক্ষমতায়ন করা আমার জীবনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি। তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে পারার মধ্য দিয়ে আমি জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাই এবং তা আমাকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। বাংলাদেশে আমার পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে পেরে এবং অন্যান্য বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে আমি গর্ব বোধ করি। আমি খুশি।
আমি একজন প্রশিক্ষক হওয়ার পরিকল্পনা করছি যাতে আমি প্রবাসী শ্রমিকদের আরও বেশি সাহায্য করতে পারি। মনোবিজ্ঞান বিষয়ে একটি ডিগ্রিও অর্জন করতে চাই, যাতে মানুষকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারি। আমি মনে করি যে, ইউনিয়ন অর্গানাইজার হওয়ার ক্ষেত্রে আমার এই সাফল্য আমাদের সকলের, বিশেষত আমরা যারা জর্ডানে প্রাবাসী শ্রমিক।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান