বাচনিক-এর দশম বার্ষিকী পরিবেশনা : সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান
দেলওয়ার এলাহী : গত ৫ নভেম্বর, ২০২২, শনিবার টরন্টোর জনপ্রিয় আবৃত্তি সংগঠন বাচনিক – ‘সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান’ শিরোনামে তাদের দশম বার্ষিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় নন্দন টিভির মিলনায়তনে। একই স্থানে আগের রাতে অনুষ্ঠিত হয় টরন্টোর আরেক আবৃত্তি শিল্পী দিলারা নাহার বাবুর একক আবৃত্তির অনুষ্ঠান – শুধু কবিতার জন্য। পরপর দু’রাত শুধু কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে জনসমাবেশের উপস্থিতি নিয়ে কিছুটা হলেও সন্দেহ বা আশংকা কাজ করতে পারে। কিন্তু এই শহরের মানুষ যে, কবিতা আবৃত্তিকে কতটুকু ভালোবাসেন তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ বাবু’র -‘শুধু কবিতার জন্য’ এবং পরদিন বাচনিকের -‘সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে মানুষের স্বতস্ফুর্ত উপস্থিতি, সমর্থন ও তন্ময় হয়ে শিল্পীদের পরিবেশনা উপভোগ করা।
বাচনিক প্রতি বছর বিষয়ভিত্তিক কবিতা আবৃত্তির বিশাল ও নান্দনিক আয়োজন করে এই শহরের মানুষের কাছে যেমন নিজেদেরকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন, তেমনি দর্শক-শ্রোতারাও বাচনিকের পরিবেশিত ভাবনায় নিজেদের চেতনায় ঢেউ অনুভব করেছেন। নিজেদের মানবিকতা, সহনশীলতা ও অসা¤প্রদায়িকতার বোধকে জাগ্রত করছেন। ক্ষেত্রবিশেষে ঋদ্ধ হচ্ছেন। আবৃত্তি সংগঠন হিসেবে বাচনিকের এই দায়বদ্ধ ও শিল্পীর দায়কে দর্শকশ্রোতা স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের ভালোবাসা, সহযোগিতা ও সমর্থনে বাচনিকও নিজেদের দায়িত্বকে আরো গুরুত্ব দিয়েছে। শিল্পচর্চার মাধ্যমে সমগ্র মানুষের ভাবনাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। পরিবেশনায়, উচ্চারণে, স্বর প্রক্ষেপণে সামান্য কিছু ভুল থাকলেও বাচনিকের এই দায়বদ্ধ নীতিগত ভাবনা দর্শকশ্রোতার কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে। সারাবিশ্বের আবৃত্তি প্রেমিদের কাছে আজ বাচনিক একটি জনপ্রিয় নাম। ভালোলাগা ও ভালোবাসার সংগঠন। দশম বার্ষিকীর আয়োজনে সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান শিরোনামের পরিবেশনায়ও বাচনিক তার প্রমাণ রেখেছেন।
বাৎসরিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তির পাশাপাশি, বাচনিক–এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক – কবিতা বা আবৃত্তি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, এরকম ব্যক্তিবর্গের একজনকে সম্মাননা প্রদান করা। বাচনিক সম্মাননাও ইতোমধ্যে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। এ বছর বাচনিক ‘সম্মাননা– ২০২২’ সম্মানিত হয়েছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের নানা মাধ্যমে বিশেষ অবদান রাখা সংস্কৃতিজন মিথুন আহমেদ। বাচনিক সম্মাননা–২০২২ গ্রহণ করে বাচনিককে সম্মান দেখাতে নিউইয়র্ক থেকে ছুটে এসেছেন মিথুন আহমেদ।
গতকাল সন্ধ্যা ঠিক সাড়ে ছয়টায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে শুরু হয় বাচনিকের অনুষ্ঠান। তারপর বাচনিকের দলগত পরিবেশনার উচ্চারণ – অন্তরমম বিকশিত করো, অন্তরতর হে। দলীয় পরিবেশনার পরপরই অনুষ্ঠিত হয় বাচনিক সম্মাননা প্রদান পর্ব। এই পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ওন্টারিও প্রাদেশিক সংসদের মাননীয় সদস্য ডলি বেগম। বাচনিক উপদেষ্টা রাশেদা মুনীর- এর সঞ্চালনায় শুরু হয় সম্মাননা পর্ব। এই পর্বে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বাচনিক সম্মাননায় ভূষিত মিথুন আহমেদ, এমপিপি ডলি বেগম, উপদেষ্টা রুমানা চৌধুরী, দেলওয়ার এলাহী ও বাচনিক আহ্বায়ক মেরী রাশেদীন।
সম্মাননাপত্র পাঠ করেন বাচনিক উপদেষ্টা কবি ও কথাসাহিত্যিক রুমানা চৌধুরী। মিথুন আহমেদকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন বাচনিক উপদেষ্টা দেলওয়ার এলাহী। এমপিপি ডলি বেগমকে ফুলের তোড়া দিয়ে বাচনিকের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানা মেরী রাশেদীন।
এমপিপি ডলি বেগম মিথুন আহমেদের হাতে বাচনিক সম্মাননার ক্রেস্ট তুলে দেন। মিথুন আহমেদকে অভিনন্দন ও বাচনিকের দশম বার্ষিকী অনুষ্ঠানের আয়োজনে জন্য বাচনিকের সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান। ডলি তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন – দশম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাচনিকের বন্ধুদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই। বাচনিক বাংলা কবিতা থেকে আবৃত্তি করে এই শহরে কবিতা ও আবৃত্তিকে জনপ্রিয় করে তুলছেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে বাংলা কবিতার ধ্বনি পৌঁছে দিচ্ছেন। মূল বাংলায় কবিতার যে ধ্বনিমাধুর্য তা তো অনুবাদে সম্ভব নয় কখনোই, নতুন প্রজন্মের কাছে এই ধ্বনির অনুভব নিশ্চয়ই অন্যরকম। দর্শকশ্রোতাদের উদ্দেশ্যে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে ডলি বলেন – আপনাদের প্রেরণা, সহযোগিতা ও আগ্রহের কারণেই আমাদের এই শহর সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে দিনদিন। ডলি বেগমের বক্তব্যের পর মিথুন আহমেদকে বাচনিকের পক্ষ থেকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন দেলওয়ার এলাহী। এরপর মিথুন আহমেদকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান বাচনিক আহ্বায়ক মেরী রাশেদীন।
সম্মাননা গ্রহণ করার পর নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে মিথুন আহমেদ বলেন – সেই অনেক বছর আগে ঢাকায় বাচনিক নামে আবৃত্তি ও আবৃত্তি প্রশিক্ষণের একটা সংগঠন ছিল। মেরী ছিলেন সেই সংগঠনের প্রথম দিককার একজন শিক্ষার্থী। মেরী বাচনিক নামে একটা আবৃত্তি সংগঠন করার আগ্রহ করে ‘বাচনিক’ নামটি ব্যবহার করার অনুমতি চাইলে আমি সানন্দে সম্মতি জানিয়েছিলাম। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত টরন্টোয় বাচনিক আবৃত্তি নিয়ে যে কাজ করে যাচ্ছে, তাতে আমার অনেক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক ভালো ভালো কাজ করছেন বাচনিকের বন্ধুরা।
আমি জানি বাচনিকের সঙ্গে যুক্ত আছেন অনেক গুণীজন। যদিও পুরস্কার, সংবর্ধনা বা সম্মাননায় আমার নিজের কোন আগ্রহ নেই, কিন্তু প্রিয় মেরী যখন বাচনিকের পক্ষ থেকে আমাকে সম্মাননা জানানোর অনুমতি চেয়ে অনুরোধ করলেন – আমি তাকে না বলতে পারিনি। কেননা, কবিতা আবৃত্তি নিয়ে মেরীর সঙ্গে যে আত্মার সম্পর্ক, তাতে আমার না করার কোন সুযোগ নেই। মেরীর ডাকে, বাচনিকের বন্ধুদের ডাকে ও আপনাদের ডাকে আমি আজ এখানে এসেছি। আমার মাকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। তিনি এখানেই দর্শক সারিতে আপনাদের সঙ্গে বসে আছেন। সত্যিই আমি আজ সম্মানিত বোধ করছি। আপনারা আমার কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও অভিবাদন গ্রহণ করুন। সম্মাননা পর্ব শেষ হলে মিথুন আহমেদ কবি আসাদ চৌধুরী ও কবি শহীদ কাদরীর কবিতা থেকে তিনটি কবিতা আবৃত্তি করে উপস্থিত সবাইকে মোহিত করেন। এরপর শুরু হয় বাচনিকের বন্ধুদের পরিবেশনায় সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান শিরোনামের আবৃত্তির অনুষ্ঠান। মিলনায়তন ভরা দর্শক–শ্রোতারা বাচনিকের পরিবেশনা আগ্রহ ভরে উপভোগ করেন।
সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান শিরোনামের বাচনিকের রিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন নাজমা কাজী, তন্ময় রহমান, শাপলা শালুক, সাবরিনা নূর , ডটি শারমিন, আরিয়ান হক, শাহনাজ স্মৃতি, সুমি রহমান, কামরুন নাহার হিরা, সম্পূর্ণা সাহা, শিখা আখতারী আহমাদ, ইরা নাসরিন, লীনা এগনেস ডি কস্টা, হোসনে আরা জেমী, ফারহানা আহমদ, ফ্লোরা নাসরিন ইভা, কাজী হেলাল, মেরী রাশেদীন ও কামরান করিম। দুটি কবিতার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন অরুনা হায়দার ও নাজিয়া হক। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রদীপ প্রজ্বলনে অংশগ্রহণ করেন এঞ্জেলিনা ডি কস্টা ও অনুরাগ আহমেদ। শব্দ নিয়ন্ত্রণ রশীদ এম ডি মামুনুর, আলোক নিয়ন্ত্রণ করেন জনি ফ্রান্সিস গোমেজ।
বাচনিকের দশম বার্ষিকীর আয়োজন ‘সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান’ শিরোনামটি দেন জামিল বিন খলিল। পুরো অনুষ্ঠানের আবহসঙ্গীত আয়োজনের যন্ত্রানুসঙ্গে ছিলেন কীবোর্ডে জাহিদ হোসেন, তবলায় রনি পালমার, গীটারে মোহাইবিন আজিম অপূর্ব। উপস্থাপনা করেন মেরী রাশেদীন ও কামরান করিম। নির্দেশনায় মেরী রাশেদীন। গ্রন্থনা করেন জামিল বিন খলিল ও দেলওয়ার এলাহী।