প্রবাসের সংবাদ

বার্মিংহামে আজিজুর রহমান স্মরণে শোক সভা অনুষ্ঠিত


বার্মিংহামে আজিজুর রহমান স্মরণে শোক সভা অনুষ্ঠিত

সৈয়দ মাসুম, বার্মিংহাম থেকে।।  প্রয়াত রাজনীতিবিদ মৌলভীবাজার জেলার চেয়ারম্যান ,সাবেক হুইপ ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান স্মরণে এক শোক সভা আজ ২রা সেপ্টেম্বর ২০২০ ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর শিল্প শহর বার্মিংহামের এক রেষ্টুরেন্টে অনুষ্ঠিত হয়।

বার্মিংহামে আজিজুর রহমান স্মরণে শোক সভা অনুষ্ঠিত সভায় বার্মিংহাম আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ আজির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভার সঞ্চালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন বার্মিংহামের প্রবীণ কমিউনিটি নেতা ও আজিজুর রহমানের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহচর কমরেড মসুদ আহমেদ।

আজিজুর রহমান ও ৪নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল সি আর দত্ত বীরোত্তমের মৃত্যুতে এক মিনিট নিরবতা পালনের মাধ্যমে সভার কার্যক্রম শুরু হয়।

প্রথমেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন আয়োজকদের পক্ষ থেকে জনাব মিছবাউর রহমান মিছবা।

সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন নর্থ আমেরিকার বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ নেতা কানাডা আওয়ামীলীগের সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ মাহমুদ মিয়া।

সভার শুরুতেই ‘বরেণ্য রাজনীতিবিদ আজিজুর রহমান :জীবন ও কর্ম ’শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন কবি ,প্রাবন্ধিক ও গবেষক জনাব সৈয়দ মাসুম।

বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা ফয়জুর রহমান চৌধুরী এম বি ই, মৌলভীবাজার জনসেবা সংস্থার সভাপতি ডক্টর এম জি মৌলা মিয়া সি আই পি ,কামরুল হাসান চুনু ,নিজাম উদ্দিন ,রাজু আহমেদ পারভেজ,হবিগঞ্জ সোসাইটির সেক্রেটারী মোহাম্মদ মোন্তাকিম ,রুহুল আমিন খান ,তোফাজ্জল চৌধুরী ,আব্দুস শহীদ ও কয়ছর আহমেদ প্রমুখ।

সভায় প্রত্যেকেই আজিজুর রহমানের সততা,জন সম্পৃক্ততা আর একনিষ্ঠতার পাশাপাশি এই বরেণ্য রাজনীতিবিদের কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে স্মৃতি চারণ করেন।

মৌলানা রশীদ আহমদের দোয়ার মাধ্যমে সভার কার্যক্রম শেষ হয়।

সভা শেষ আয়োজকদের পক্ষ থেকে এক ভুরিভোজের আয়োজন করা হয়।

বৈশ্বিক মহামারী জনিত কারনে নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে শোক সভায় আমন্ত্রণ করা হয়।

মধ্য বিলেতের সামাজিক ,সাংস্কৃতিক আর রাজনৈতিক বলয়ের প্রায় অর্ধ শতাধিক মানুষের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে এই শোক সমাবেশ।

 

 

বরেণ্য রাজনীতিবিদ আজিজুর রহমান : জীবন, কর্ম ও পরিচয় —সৈয়দ মাসুম

আজিজুর রহমান ১৯৪৩ সালে তৎকালীন দক্ষিন সিলেট মহকুমাধীন মৌলভীবাজার শহরের উপকন্ঠে চাঁদনী ঘাট ইউনিয়নের গুজরাই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল সাত্তার আর মাতা কাঞ্চন বিবি। জনাব আজিজ শ্রীনাথ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করার পর ১৯৫৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারী হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স ও ১৯৬২ সালে মৌলভী বাজার সরকারী কলেজ থেকে আই কম এবং পরবর্তীতে সরকারী বৃন্দাবন কলেজ ,হবিগঞ্জ থেকে বি কম পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ন হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম কম অধ্যয়ন কালে আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ায় সেটি আর সম্পন্ন করা সম্ভবপর হয়নি। জনাব আজিজুর রহমান তরুণ বয়সে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে অতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

একজন প্রতিভাবান নাট্য অভিনেতা হিসাবে মৌলভীবাজার শহরে তাঁর যথেষ্ট নামডাক ছিলো। প্রচন্ড মেধাবী ও প্রখর ধী সম্পন্ন এই মানুষটির ছাত্র জীবনে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমেই রাজনীতির হাতেখড়ি। ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন আর ৬৯এর আয়ুবীয় স্বৈর শাসন বিরোধী সংগ্রামে তিনি ছিলেন মৌলভীবাজারের সম্মুখ সমরের এক অকুতোভয় সৈনিক। দেশ ও জাতির মুক্তি অর্জনে নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটি জাতির বৃহ্ত্তর প্রয়োজনে সত্তরের নির্বাচন পূর্ব সময়ে মৌলভীবাজার জেলার আরেক কৃতি সন্তান পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের আজীবন সভাপতি মোহাম্মদ ইলিয়াসের সাথে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন। ১৯৭০সালের নির্বাচনে আজিজুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সেই সময়ে প্রাদেশিক পরিষদের তিনি ছিলেন নির্বাচিত সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য।

স্বাধীন বাংলাদেশে গণ পরিষদের সদস্য হিসাবে বাংলাদেশের সংবিধাব প্রণয়নেও রয়েছে তাঁর অনন্য অবদান। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা লগ্নেই পাক বাহিনী কর্তৃক জনাব আজিজ ধৃত হন। সামরিক জান্তা মৌলভীবাজার থেকে তাঁকে সিলেটে স্থানান্তর করে। ৭ই এপ্রিল মুক্তি বাহিনীর এক বিশেষ ইউনিট সিলেট সেন্ট্রাল জেলে অতর্কিত হামলা চালায় এবং আজিজুর রহমান সহ শতাধিক আওয়ামীলীগ নেতাকে মুক্ত করে নিয়ে আসে। ২রা মে পাক বাহিনী কর্তৃক মৌলভীবাজার শহর আক্রান্ত হলে জনাব রহমান ত্রিপুরা চলে যান এবং মুক্তি বাহিনী গঠনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখেন। মুজিব নগর সরকারের আহবানে ভারতের দার্জিলিং জেলার বাগডুগায় বাংলাদেশের পার্লামেন্ট অধিবেশন বসলে তিনি সেখানেও যোগদান করেন।

ভারতে তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাকাল ৪নং সেক্টরের রাজনৈতিক কোঅর্ডিনেটর ও কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। জনাব আজিজের নেতৃত্বেই ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার শহরে মুক্তি বাহিনী আক্রমন করে পাক বাহিনীকে পুরোদমে পর্যুদস্থ করে দেয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানী মিলিটারি বহর সেরপুরের দিকে পালিয়ে গেলে মৌলভীবাজার হানাদার মুক্ত হয়। ঐ দিনই জনাব আজিজ মৌলভীবাজার মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। দেশ স্বাধীনের আট দিন আগেই স্বাধীনতার আস্বাদ পায় মৌলভীবাজার। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই বলিষ্ঠ রাজনীতিবিদ বাংলাদেশে একাধিকবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর বিচক্ষণতা ,দক্ষতা আর জন সম্পৃক্ততার কারণে তিনি প্রতিপক্ষ হেভিওয়েট রাজনীতিবিদ মৌলভীবাজার তথা সিলেট অঞ্চলের উন্নয়নের রূপকার সাবেক অর্থ মন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকেও ভোট যুদ্ধে ধরাশয়ী করতে হয়েছেন সক্ষম। জনাব আজিজ সততা ,অসাম্প্রদায়িকতা আর অহিংসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মৌলভীবাজার জেলায়।আত্ম অহমিকার চেয়ে আত্ম প্রত্যয় আর আত্ম সমালোচনাকেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন।

তাঁর সহযোদ্ধা ও সহকর্মী মৌলভীবাজার জেলার কিংবদন্তিতুল্য রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ ইলিয়াস ও তিনি মৌলভীবাজার জেলায় আওয়ামীলীগের এমন এক গণ ভিত্তি তৈরী করেছেন যে ,বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান টুঙ্গি পাড়ার পর মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ -শ্রীমঙ্গলে স্বাধীনতা উত্তর সময়ে একবারও পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়নি। ১৯৭১সালে দেশ স্বাধীনের পর সবাই যখন লুটপাটে ব্যস্ত তখন এই দেশ বরেণ্য রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ ইলিয়াসের নেতৃত্বে বিহারীদের প্রত্যার্পিত ২৮টি চা বাগানের মালিকানা তোলে দেন বঙ্গবন্ধুর হাতে। বর্তমানে ন্যাশনাল টি কোম্পানীর অধীনস্ত এই ২৮ টি চা বাগান ইচ্ছে করলে মোহাম্মদ ইলিয়াস ও আজিজুর রহমান নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোরা করে নিতে পারতেন।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও বেশ কয়েকবার করা বরণ করতে হয় আজিজুর রহমানকে। ৯৬এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জনাব আজিজ শুধু মৌলভীবাজার তথা সিলেটেই নয় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে সারা বাংলাদেশে রাখেন এক দুর্দান্ত দুর্দমনীয় ভূমিকা। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের দুইবার সাধারণ সম্পাদক ,দুইবার সভাপতি ,বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের হুইপ ,২০১১সালে মৌলভীবাজারের প্রশাসক ও ২০১৬ সাল থেকে আমৃত্যু মৌলভীবাজার জেলার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এই বরেণ্য রাজনীতিবিদ। মৌলভীবাজার জেলা রেড ক্রিসেন্টের সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।

যুদ্ধাহত এই অকুতোভয় মুক্তিযুদ্ধাকে দেশ ও জাতির কল্যানে অপরিসীম ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০২০সালে বাংলাদেশ সরকার দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরুস্কার স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্য জনিত কারনে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ৫ই আগস্ট তাঁর শরীরের করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। আগস্টের মাঝামাঝি তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনত হয়। ১৮ই আগষ্ট ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে জীবনাবসান ঘটে এই রাজনীতিবিদের। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মৌলভীবাজারেই সমাহিত হন বীর মুক্তিযুদ্ধা,সফল রাজনীতিবিদ মৌলভীবাজার বাসীর হৃদয়ের স্পন্দন মোহাম্মদ আজিজুর রহমান। মৌলভীবাজার হারায় তাঁর অন্যতম এক অবিভাবক।

সৈয়দ মাসুম, সাংবাদিক, কবি, লেখক ও গবেষক

 

সিএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন