-বিচিত্র কুমার-এর ছয়টি রোমান্টিক প্রেমের কবিতা
(০১)
তুমি, আমি ও সময়
তুমি আসলে হঠাৎ— যেমন সন্ধ্যার মুখে এক বুনো হাঁস নদী ছুঁয়ে যায় নিঃশব্দে,
আমি তাকাই— যেমন প্রাচীন গ্রন্থে কেউ খোঁজে ভালোবাসার হারিয়ে যাওয়া নীল অক্ষর।
আমাদের মাঝে সময় দাঁড়িয়ে ছিল— তপ্ত চায়ের কাপে ধোঁয়ার মতো, কিছুটা অস্পষ্ট।
সে বলে না কিছু— শুধু ঝরে পড়ে মনের পাতা থেকে প্রাচীন একটি হলুদ স্মৃতি।
তোমার চোখে ছিল নীল নক্ষত্রের মতো এক দুর্বলতা— যা আলো নয়, কাঁপন হয়ে থাকে।
আমার ঠোঁটে জড়ানো ছিল পুরোনো কোনো গান— যা ভোর হলে ফিরে যায় মাঠের ঘাসে।
রেললাইনের পাশ দিয়ে হেঁটেছিলে যেদিন, আমি গুনেছিলাম প্রতিটি কাঁকড়-পাথর,
হেমন্তের বাতাসে ওড়ানো স্কার্ফের মতো ছুঁয়ে গিয়েছিলে, আবার হারিয়ে গিয়েছিলে দিগন্তে।
তখন সময় ছিল এক পিপাসার জল, যা আমরা মুখে তুলিনি— শুধু তাকিয়ে ছিলাম দূর থেকে।
তুমি বলেছিলে, ভালোবাসা জলের মতো— ধরা যায় না, কিন্তু পিপাসা নিবারণ করে।
আমি বুঝিনি সেদিন, আজ বুঝি— সময়ের কাঁধে মাথা রাখলে ঘুম আসে না, আসে অভিমান।
তুমি, আমি ছুটেছি দুই আলাদা শহরের দিকে— যেমন ঘোড়ার গাড়ি চলে বিপরীত রাস্তায়।
আবার কোনো এক ভোরে হয়তো দেখা হবে— যেমন হঠাৎ কুয়াশার ভেতর থেকে উদয় হয় সূর্য,
তুমি বলবে— ‘কেমন আছ?’ আমি বলব— ‘ভালো’— মুখে রেখে দেব এক বোবা ফুলের হাসি।
আমরা ফিরব না— তবু সেই মুহূর্তটুকু হয়ে থাকবে চিরকাল— একটি মুদ্রার মতো হৃদয়ে,
যার এক পিঠে তুমি, এক পিঠে আমি— আর মাঝখানে সময় দাঁড়িয়ে, চোখে সোনালি নীরবতা।
হয়তো আমরা আবার ভালোবাসব, কিন্তু কখনোই সেইরকম নয়— যেমন প্রথমবার হয়েছিল।
তবুও এই স্মৃতিকে রাখি বুকের ভেতর— জলের নিচে জমে থাকা চাঁদের আলোর মতো।
(০২)
তুমি, আমি ও নৈঃশব্দ্য
একদিন আমাদের কথা থেমে গিয়েছিল— যেমন হঠাৎ নদীর বুকে থেমে যায় কুয়াশার ভেলা,
তুমি বলোনি কিছু— শুধু চোখে রেখেছিলে এক অনন্ত প্রশ্নের নীলছায়া।
আমি বুঝিনি, উত্তর ছিল কিনা— নাকি নৈঃশব্দ্যই ছিল আমাদের শেষ স্বাক্ষর।
বৃষ্টিভেজা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তুমি যেন একটি কবিতা হয়ে গিয়েছিলে,
যা আমি পড়িনি— কেবল তাকিয়ে ছিলাম, যেমন নিঃশব্দে পড়ে যায় পাতা শরতের।
সেদিন সময়ও চুপ ছিল— ঘড়ির কাঁটা ঘুরেছিল ঠিকই, কিন্তু শব্দ ছিল না।
তোমার অভিমানের পাশে আমি রেখে দিয়েছিলাম একটি মৌন পাথর,
যা তুমিও তুলোনি— শুধু চলে গিয়েছিলে, বাতাসে গলে যাওয়া ফুলের গন্ধের মতো।
আমাদের ঘর ছিল, অথচ সে ঘরে ছিল না কোনো জানালা— কেবল নিঃশ্বাসের দেয়াল।
ভালোবাসা কীভাবে শব্দ হারায়, তা আমি শিখেছিলাম তোমার মৌনতায়।
তুমি বলেছিলে, ‘চুপ থাকা মানেই ভোলা নয়’— আমি শুনেছিলাম, কিন্তু বুঝিনি।
আজ বুঝি— নৈঃশব্দ্যই সবচেয়ে গভীর ভাষা, যেখানে একেকটা নিঃশ্বাস হয়ে যায় কবিতা।
তুমি, আমি, আর নৈঃশব্দ্য— আজও একই পথে হাঁটি, কিন্তু কেউ কারও পাশে নেই।
শুধু পথটা রয়ে গেছে— যেমন এক পুরোনো বাঁশির সুর পড়ে থাকে গ্রামের বাতাসে।
আমি আজও খুঁজি সেই নিঃশব্দ দুপুর, যেখানে একবার স্পর্শ করেছিলে আমার ছায়া।
তুমি ফিরো না— তবু জানি, নৈঃশব্দ্যই সবচেয়ে বেশি বলে ফেলে, যখন আমরা শুনতে পারি।
হয়তো কোনোদিন, অন্য কোনো জন্মে, শব্দেরা আবার জেগে উঠবে আমাদের মুখে।
ততদিন নিঃশব্দ থাক— তুমি, আমি, আর সেই অসমাপ্ত ভালোবাসার বাতাস।
(০৩)
তুমি, আমি ও চাঁদ
চাঁদ উঠেছিল সেদিন, অথচ আমরা তাকাইনি—
তুমি কাঁধ ঘেঁষে বসে থেকেও ছিলে দূরের মতো—
যেমন জোছনায় ভিজে না সব পাথর, কিছু পাথর থেকে যায় শুষ্ক, নিঃসঙ্গ।
আমি বলতে চেয়েছিলাম, ‘চাঁদটা আজ কেমন একা দেখাচ্ছে’,
তুমি বলোনি কিছু— কেবল অশ্রুজলে আড়াল করে রেখেছিলে তোমার হাত।
সময় ছিল থেমে— গলির বাতিগুলো যেন আলো নয়, শুধু দীর্ঘশ্বাস জ্বালাচ্ছিল।
তুমি বলেছিলে, চাঁদ মানে শুধু রূপ নয়, চাঁদ মানে পিছুটান—
যেমন নদী বারবার ফিরে চায় তার উৎসকে,
ভালোবাসাও কি তেমনই ছিল?— বারবার ফিরে চাওয়ার এক ক্লান্তি?
চাঁদের নিচে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের হারিয়েছি,
তুমি খুঁজেছিলে নিজেকে আমার চোখে,
আর আমি চেয়েছিলাম হারিয়ে যেতে তোমার নীরব চাহনিতে।
আজও চাঁদ ওঠে— কিন্তু আমরা আর একসঙ্গে থাকি না,
তুমি আছ অন্য শহরে, আমি অন্য ব্যস্ততায়—
কেবল চাঁদটা রয়ে গেছে, আমাদের মাঝখানে এক নির্বাক সেতুর মতো।
যখন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙে,
আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি—
চাঁদের আলো এখনো পড়ে আছে সেই পুরোনো কফির কাপের পাশে।
তুমি জানো না— কিন্তু আমি জানি,
এই আলোতে আজও আমরা পাশাপাশি বসে থাকি— নীরব, অথচ স্পষ্ট।
(০৪)
তুমি, আমি ও ভুলে যাওয়া
ভুলে যাওয়া বড় সহজ— যেমন মরা পাতার মতো ঝরে পড়ে কিছু নাম, কিছু তারিখ,
তোমার কণ্ঠস্বর একসময় ঘিরে থাকত সন্ধ্যার ঘর— আজ তা কেবল বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
আমার ডায়েরির ভাঁজে তোমার লেখা একটি লাল শব্দ এখন বিবর্ণ,
যেন পুরোনো চিঠির গায়ে লেগে থাকা হালকা আতর— যা আর সুর দেয় না।
তুমি বলেছিলে— ‘ভুলে যেও না’— আমি বলেছিলাম, ‘ভোলা কি এত সহজ?’
কিন্তু মানুষ ভুলে যায়— এমনকি নিজেকেও, দিনের ক্লান্ত ঘোরে, রাতের জ্যোৎস্নার ভেতর।
তুমি ছিলে সেই নদী— যার দিকে আমি প্রতিদিন ফিরে চাইতাম,
আজ সেই নদী শুকিয়ে গেছে— কেবল নুড়ি-পাথর পড়ে থাকে তার তলদেশে।
ভুলে যাওয়া শুরু হয় এক সন্ধ্যায়— যখন আর দরকার পড়ে না কারও খোঁজ নেওয়ার।
তুমি হয়তো এখন হাসো, অন্য কারও পাশে, অন্য কোনো ফুলের ঘ্রাণে,
আমি এখনো তাকাই সেই বারান্দার দিকে— যেখানে একদিন তুমি বলেছিলে, ‘থেকে যেও।’
কিন্তু থাকিনি— আর তুমিও থাকোনি, শুধু সময় ছিল, স্মৃতির মতো ঘন নীরব।
ভুলে যাওয়া মানে সব ফুরিয়ে যাওয়া নয়— অনেকটা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া আগুনের মতো,
যার নিচে এখনও কিছুটা উত্তাপ লুকিয়ে থাকে ভেতরের ছাইয়ের স্তরে।
তোমাকে ভুলে গেছি— বলি ঠিকই, কিন্তু হঠাৎ একটি নাম, একটি গন্ধ, একটি গান…
তাকে আবার ফিরিয়ে আনে— যেমন মরা নদীর বুকে হঠাৎ নামে শ্রাবণের জোয়ার।
আমরা দুজনেই ভুলে যেতে চেয়েছিলাম— কিন্তু কিছু ভুলে যাওয়া চিরকাল থেকে যায়,
যেমন ট্রেন চলে যায়— অথচ প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকে দুটি ছেঁড়া টিকিট, পাশাপাশি।
(০৫)
তুমি, আমি ও অপেক্ষা
অপেক্ষা কখনো শেষ হয় না— কেবল রূপ পাল্টায়,
তুমি ছিলে সেই স্টেশনের মানুষ— যে ট্রেন ধরেনি, তবু চলে গেছে অচেনা গন্তব্যে।
আমি ছিলাম বেঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঘড়ির কাঁটার মতো— নড়ি, কিন্তু কোথাও যাই না।
আমাদের মাঝখানে সময় ছিল— একটি সিগনালের মতো, সবুজ আর লাল আলোয় বিভ্রান্ত।
তুমি তাকিয়ে ছিলে, কিন্তু বলোনি— আমি ডাকতে চেয়েও থেমে গিয়েছিলাম হঠাৎ।
সেদিন বৃষ্টি হয়নি— অথচ বুকের ভেতর জমে উঠেছিল একশো বছরের নীরব জলধারা।
তুমি বলেছিলে, ‘অপেক্ষা কষ্ট দেয় না, দেয় ব্যথাহীন বিস্মৃতি’,
আমি বিশ্বাস করিনি, এখন করি— যেমন কেউ ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে ওঠে চেনা শহরে।
তুমি একদিন ফিরবে— এই বিশ্বাস নিয়ে আমি বহু ঋতুর রোদে পুড়েছি, জোছনায় ভিজেছি।
প্রতিটি দিন গুনেছি— যেমন ছায়া গোনে একটি নীরব পাখি শীতের মাঠে দাঁড়িয়ে।
তুমি ফেরোনি— কিন্তু আমি অপেক্ষা থামাইনি,
যেমন শুকনো গাছে পাতার আশায় বসে থাকে বসন্ত, জানে— সে আর ফিরবে না।
আজও সন্ধ্যায় সেই পথ ধরে হেঁটে যাই— যেখানে তুমি বলেছিলে, ‘আসব ঠিক ফিরে’,
আমি হাসি— কিন্তু সে হাসির নিচে চাপা থাকে একটি দীর্ঘশ্বাসের দীর্ঘ কবিতা।
মানুষ ফিরে না— তবু তার প্রতিধ্বনি থেকে যায়— জানালার পর্দায়, বাতাসের রেখায়।
তুমি নেই— অথচ আমি আজও শুনি, তোমার কণ্ঠস্বর সন্ধ্যার শালিকের ডাকে।
অপেক্ষা কখনো শেষ হয় না— কেবল অভ্যেসে পরিণত হয়,
যেমন পুরোনো দরজার কড়া— প্রতিদিন বাজে, অথচ কেউ আর খোলে না।
(০৬)
তুমি, আমি ও বিষণ্ণ শহর
তুমি, আমি, আর এই বিষণ্ণ শহর—
ক্লান্ত ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা একটুকরো চাহনি,
জলকুয়াশায় ঢেকে থাকা ঠোঁটের দিকে ঝুঁকে থাকা নিঃশ্বাস,
অথবা খুব ধীরে চোখ ফেরানো স্নিগ্ধ সন্ধ্যা।
এই শহর জানে,
কীভাবে দু’জন মানুষ একে অপরের চোখে চেয়ে
হঠাৎ ঘড়ির কাঁটার মতো দূরে সরে যায়,
তবু বুকের গভীরে জমে থাকে অনেক না বলা সংলাপ।
একদিন আমরা হেঁটেছিলাম—
বৃষ্টির জলে ভেজা পথ ধরে,
ছাতার নিচে দুটি হাত পাশাপাশি,
ভেজা বাতাসে ওড়ে তোমার চুল,
আর আমার বুকের মধ্যে ওড়ে একটা অস্থির পাখি।
কখনো ভেবেছো?
এই শহরের প্রতিটি অলিতে গোপনে লুকিয়ে আছে আমাদের ছায়া,
স্ট্রিট ল্যাম্পের নিচে দাঁড়িয়ে
তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল যে ছেলেটা, সে এখন
কেবল ট্রামলাইনের মতো দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেঁচে আছে।
তুমি আছো কোথায় এখন?
নতুন শহর? নতুন গল্প?
আমার শহর কিন্তু এখনও তোমার নামেই বিষণ্ণ হয়,
জানালা খুললেই হঠাৎ তোমার গন্ধ আসে—
নাকি আমি ভুল বলছি?
দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।




