বিশ্ব

বৈশ্বিক মহামারির আশঙ্কা

বৈশ্বিক মহামারির আশঙ্কা
কোলাহলমুখর বেইজিংয়ে যেন এখন সুনসান নীরবতা। করোনাভাইরাস আতঙ্কে দোকানপাট বন্ধ, রাস্তা ফাঁকা। ছবিটি গতকালের। ছবি : এএফপি

বৈশ্বিক মহামারির আশঙ্কা

করোনাভাইরাসে চীনে এক দিনেই ৬৪ জনের মৃত্যু

এক সপ্তাহের ব্যবধানে চীনে নভেল করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে চার গুণ হয়েছে। ক্রমেই বৈশ্বিক মহামারির দিকে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা জাগানো এই ভাইরাসে দেশটিতে এক দিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে গত সোমবার। এ নিয়ে চীনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২৫ জনে। আর আক্রান্তের সংখ্যা এরই মধ্যে ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। চীনের বাইরে এই ভাইরাসে একজন করে মৃতের তালিকায় ফিলিপাইনের সঙ্গে যোগ হলো হংকংয়ের নামও।

এদিকে নতুন এই ভাইরাস মোকাবেলায় নিজেদের ‘ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার’ কথা স্বীকার করেছে চীন। সংকট মোকাবেলায় আরো দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিওএইচও) সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, করোনাভাইরাসের মহামারি ঠেকাতে বৈশ্বিক প্রস্তুতিতে মারাত্মক রকমের ঘাটতি রয়েছে। আর বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, যে হারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে অচিরেই ‘বৈশ্বিক মহামারি’ ঘোষণা করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু : গত মঙ্গলবার করোনাভাইরাসে চীনে মৃতের সংখ্যা ছিল ১০৬। আক্রান্তের সংখ্যা ছিল চার হাজার ৫১৫। কিন্তু গত সাত দিনে মৃতের সংখ্যা প্রায় চার গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২৫ জনে। এর মধ্যে সোমবারই মৃত্যু হয়েছে ৬৪ জনের। গত ডিসেম্বরে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর এক দিনে এটাই সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। বেশির ভাগ মৃত্যুই হয়েছে হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। এক দিনে নতুন করে তিন হাজার ১৯৫ জনের সংক্রমণের মধ্য দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৪৩৮।

৮০ শতাংশই ষাটোর্ধ্ব : হুবেই প্রদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের উপপরিচালক জিয়াউ ইয়াহুই গতকাল সংবাদ সম্মেলনে জানান, করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার ২.১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার উহানে, ৩.১ শতাংশ। চীনে এ পর্যন্ত যে ৪২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ৯৭ শতাংশই হুবেই প্রদেশের বাসিন্দা। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের বেশি এবং ৭৫ শতাংশ ব্যক্তির দীর্ঘস্থায়ী কোনো রোগ ছিল। এ ছাড়া মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই পুরুষ।

‘ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা’ স্বীকার : ১০ দিনের মধ্যে এক হাজার শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করে ফেললেও করোনাভাইরাস মোকাবেলায় নিজেদের ‘ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার’ কথা স্বীকার করেছে চীন। দেশটির দ্য পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটি বলেছে, ‘করোনাভাইরাসে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের ভুলত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা চোখে পড়েছে। জাতীয় জরুরি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি আরো উন্নত করতে হবে। জরুরি বিপজ্জনক কাজগুলো মোকাবেলায় আরো দক্ষতা অর্জন করতে হবে।’

এ ছাড়া বন্য প্রাণীর বাজারে বড় ধরনের অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছে কমিটি। ধারণা করা হচ্ছে, উহান শহরের বন্য প্রাণীর একটি মার্কেট থেকেই গত ডিসেম্বরে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।

হংকংয়ে একজনের মৃত্যু : করোনাভাইরাসের সংক্রমণে গতকাল সকালে হংকংয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ৩৯ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি গত মাসে উহান ভ্রমণে গিয়েছিলেন। হংকংয়ে ফেরেন গত ২৩ জানুয়ারি। হংকং দুটি বাদে চীনের সঙ্গে সব সীমান্ত বন্ধ ঘোষণার এক দিন পর সেখানে একজনের মৃত্যু হলো। গতকাল পর্যন্ত হংকংয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৫। আর এ নিয়ে চীনের বাইরে এই ভাইরাসে দ্বিতীয় ব্যক্তির মৃত্যু হলো। গত সোমবার ফিলিপাইনে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এ ছাড়া চীনের বাইরে গতকাল পর্যন্ত ২৪টি দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর খোঁজ মিলেছে।

বৈশ্বিক মহামারির আশঙ্কা : একের পর এক দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় গত সপ্তাহে জনস্বাস্থ্যে ‘বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে ডাব্লিওএইচও। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, অচিরেই করোনাভাইরাসকে ‘বৈশ্বিক মহামারি’ ঘোষণা করতে হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস’-এর পরিচালক অ্যান্থনি ফাউসি বলেন, ‘করোনাভাইরাস খুবই ছোঁয়াচে। এটা নিশ্চিতভাবেই বৈশ্বিক মহামারির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রোগ নিরাময়কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক থমাস ফ্রিয়েডেন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে মনে হয় না এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।’

স্টুয়ার্ট জুডে চিলড্রেনস রিসার্চ হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ রবার্ট ওয়েবস্টার বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমার কাছে মনে হয়েছে, করোনাভাইরাস মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে।’

‘বিশ্ব অপ্রস্তুত’ : ডাব্লিউএইচওর মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানোম গেব্রেইয়েসাস বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করলে তা মোকাবেলায় বিশ্ব এখন পর্যন্ত একেবারে অপ্রস্তুত। গত সোমবার কার্যনির্বাহী বোর্ডের সভায় তিনি সংস্থার ১৯৬ সদস্য রাষ্ট্রকে করোনাভাইরাস মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে আরো অর্থ বিনিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলা আর আতঙ্ক তৈরি করার মধ্য দিয়ে বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে। কোনো রোগ মহামারি আকার ধারণ করলে আমরা বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালি। কিন্তু বিপদ কেটে গেলে আমরা তা ভুলে যাই এবং পরবর্তী মহামারি প্রতিরোধে কিছুই করি না।’ তিনি বিশ্বকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘যদি আমরা প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হই, তাহলে এর মানে দাঁড়ায়, আমরা ব্যর্থ হওয়ারই প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

অর্থনীতিতে মন্দাভাব তীব্র হচ্ছে : মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যার আনুপাতিক হারেই চীনে তীব্র হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দাভাব। গত সোমবার সপ্তাহের প্রথম দিনে সাংহাই স্টক মার্কেটে সূচক ছিল আগের দিনের চেয়ে ৮ শতাংশ কম। বাণিজ্যিক শহর হিসেবে পরিচিত উহান রূপ নিয়েছে ভূতুড়ে শহর হিসেবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বন্ধ রয়েছে বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। চীনের দক্ষিণ উপকূলের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ম্যাকাও জানিয়েছে, তারা সব ক্যাসিনো বন্ধ রাখবে। দক্ষিণ কোরিয়ার সবেচেয়ে বড় অটোমেকার প্রতিষ্ঠান হুন্দাই জানিয়েছে, তারা চলতি সপ্তাহে সব ধরনের উৎপাদন বন্ধ রাখবে। চীন থেকে যন্ত্রাংশ আনতে না পেরে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

অন্য দেশগুলোর ভূমিকা : জি-৭ভুক্ত দেশগুলোর (যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স ও ইতালি) স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা গত সোমবার বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা ভ্রমণ বিধিনিষেধ, ভাইরাল গবেষণা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়ে একমত হয়েছেন।

অনেক দেশ চীনের আক্রান্ত এলাকা থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিয়েছে। নিজের নাগরিকদের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও চীন একে অতিরিক্ত আখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভীতি ছড়ানোর অভিযোগ করেছে।

চীনে ইস্যু করা সব ভিসা বাতিল করেছে ভারত : প্রতিবেশী দেশ চীনে ইস্যু করা সব ভারতীয় ভিসা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। এই নজিরবিহীন পদক্ষেপের অর্থ হলো, কোনো চীনা নাগরিক বা চীনে বাস করা অন্য কোনো দেশের নাগরিক, যাদের কাছে ভারতীয় ভিসা ছিল, তারা এখন আর সেই ভিসায় ভারতে ঢুকতে পারবে না।

বেইজিংয়ে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস গতকাল সকালে এক টুইটে জানিয়েছে, ‘আমরা এটা স্পষ্ট করে দিতে চাই যে আগে থেকে জারি করা ভিসা আর বৈধ বলে গণ্য হবে না।’

এমনকি যেসব চীনা নাগরিক ১৫ জানুয়ারির পর ভারতে ঢুকেছে, তাদেরও ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি হটলাইন নম্বরে জরুরি ভিত্তিতে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। তবে তাদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তা জানানো হয়নি। সূত্র : এএফপি, নিউ ইয়র্ক টাইমস।

আরও পড়ুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ                                 

কানাডার সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com 

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten − seven =