ভয় – ২
কাঠ মালতী গাছটা দীর্ঘ ছায়া বিস্তৃত করে নিঃসঙ্গ দাড়িয়ে আছে। একটা স্বল্প ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতির আলো ওর পাতার ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ফুল ঝুরির মতো। সেই স্বল্প আলোককে জীবনের পরম অবলম্বন ভেবে আমি জড়িয়ে ধরি। চরম তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেছে। দীর্ঘ নিশ্বাসে আস্তে আস্তে বিশ্বাস খুঁজে পাই। মস্তিষ্কের হিপোকাম্পাস ততোক্ষণে আমার জীবনের ঘটে যাওয়া স্মৃতির ভাণ্ডার ঘেঁটে আমাগডিলাকে আশ্বস্ত করতে পেরেছে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠা মানুষের মৃত দেহ, কঙ্কাল, মর্মভেদী আর্তনাদ সব অতীতের ঘটনা মাত্র। এর সাথে বাস্তব জীবনের কোন লেন-দেন নেই।
আমি ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে বাসায় ফিরি। দেখা হয় দাদার সাথে। দাদা বলে এতক্ষণ কোথায় ছিলি? আবারো আমার মুখ শুকিয়ে যায় । দাদাকে বলি কোথায় আমাদের সূনু? আমাদের পুকুর পাড়ে সূনুকে সমাধিস্থ করা হয়েছে মাত্র কিছুক্ষণ আগে। আমার মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায় – দাদা আমাকে যে বলল – এইতো আমি এখানে, এগিয়ে আয়। দাদা বলেননি তবে কে বলল সে কথা, কে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল সেই সেই কাঁঠাল গাছটার কাছে? দীর্ঘ দিন পর মাকে বলেছিলেম সেই ভয়ের কথা। মা আমার ভয়কে আরও বাড়িয়ে দেয়। আমাকে যে ভয়ঙ্কর কোন প্রেতাত্মা ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ঐ আদালতের বদ্ধ ভূমিতে সে কথা ভেবে মা চার আনার ছিন্নি কিনে আমায় নিয়ে যায় পীর সাহেবের আখড়ায়।
পীর সাহেব পরম মমতায় আমায় সাড়া শরীরে ফুঁ মেরে দেন। মনের ভীতি কিছুটা চলে গেলেও সেই ডাক – এইতো আমি, এগিয়ে আয় ভুলতে পারিনা। বাবার মুখে শুনা তার এক অতীতের ঘটনার সাথে নিজকে এক করে ফেলি। বাবা তার শৈশবে এক সন্ধ্যায় হাট থেকে ফিরছিলেন তার বাবার হাত ঘরে। হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে কখন তার বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে একাকী হয়ে গেছেন জানতেন না। হঠাৎ করে নিজকে একাকী আবিষ্কার করে প্রচণ্ড ভয়ে ডেকে উঠলেন বাবা বাবা বলে। বাবা ডাক সন্ধ্যার ধূসর দিগন্তের মাঝে হারিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে ডাক ফিরে এলো শতধা হয়ে, প্রলম্বিত বা–বা— হয়ে। বাবা চরম ভীতিতে দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে লাগলেন। পরে বুঝতে পেরেছিলেন এ ছিল প্রতিধ্বনি। গ্রাম্য রাস্তার দুদিকে পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ীর ভগ্ন দেওয়ালে বাবা ডাক বার বার সেদিন প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসেছিল বিকৃত হয়ে। কিন্তু আমার ডাক ফিরে এসেছে উত্তর হয়ে। মনের মাঝে এ প্রশ্নের উত্তর সেদিন খুঁজে পাইনি। আসলে এর উত্তর যে আমার মনের মাঝেই তা জানা ছিল না।
আমরা ছোটবেলা থেকে অনেকেই জ্ঞান বিজ্ঞানের অনেক শাখায়ই স্বচ্ছন্দে বিচরণ করি। বিবর্তনবাদের তত্ত্ব দিয়ে জৈববৈচিত্র, এককোষী জীব থেকে জটিল জীবনের ব্যবচ্ছেদ করি। মহাকাশ বিদ্যা দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান কে জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে আলাদা করে জ্যোতিষীদের বুজরুকীকে অসার প্রমাণ করি। কিন্তু মানুষের মনোজগতের মাঝে ডুব দিয়ে কখনো জানার চেষ্টা করিনা এই যে পরের কষ্ট দেখে মন কেঁদে ওঠে, পরের দুঃখে জীবনের পরম আনন্দ উপভোগ করি, তেলাপোকা দেখে ভয় পাই, অথচ যুদ্ধ করি অকুতোভয়ী হয়ে। একজন কিশোর একজন নিরপরাধ মাকে নির্দয় ভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলেও তার অনুশোচনা হয় না, অথচ আমরা শুনেই আঁতকে উঠি। মানুষের মনোজগৎ কতো বিচিত্র। মানুষের বিরক্তি, ক্রোধ, দুঃখ বেদনা, ভয় কোন কিছুই তার ব্যক্তিগত নয়; সবকিছুই তার মনোজগতের জটিল মিথস্কিয়ার ফলাফল। এই মন যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে পারে ভয়কে জয় করতে, সেই পারে আমাগডিলাকে হাইজ্যাক করে দুঃখকে সুখে, হতাশাকে প্রেরণায় বদলে দিতে। এ মনোজগতের জটিল রসায়নে মানুষ তার চোখের সামনে অস্তিত্বহীন জগতকে দেখতে পায়, কেউ কেউ যাপিত জীবনের পাশাপাশি বিচরণ করে অন্য কোন জগতে …
চলবে…
সুশীল পোদ্দার ওয়াটারলু, কানাডা । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা
সর্বশেষ সংবাদ
কানাডার সংবাদ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন