বাংলার সর্বশেষ পাঠান শাসক খাজা ওসমান খান লোহানী:যার রাজধানী ছিলো কমলগঞ্জের পতনঊষার
ইতিহাস-ঐতিহ্য আর মনোরম ভূ প্রকৃতির কমলগঞ্জ জানা ও অজানা অধ্যায়
বার ভূঁইয়াদের অন্যতম বাংলার সর্বশেষ পাঠান শাসক খাজা ওসমান খান লোহানীর ওসমান রাজ্যের রাজধানী উহার। কমলগঞ্জের পতনঊষার ইউনিয়াধীন শ্রীসূর্য গ্রামের পার্শ্বে এই দুর্ধর্ষ আফগান বীর ১৬০৯সালে রাজধানী গড়ে তোলেন যেটির স্থায়িত্ব ছিলো ১৬১২সাল পর্যন্ত।
ওসমান রাজ্যের পরিধি উত্তরে সুরমা নদী ,দক্ষিণে সরাইল ,পূর্বে ত্রিপুরা এবং পশ্চিমে ঢাকা ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত ছিলো বিস্তৃত।
ওসমান খান লোহানী পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে উড়িষ্যার এক বিস্তীর্ন এলাকা শাসন করতেন। ভাগ্য বিড়ম্বিত এই পাঠান নরপতি একের পর এক মোগল আক্রমনের শিকার হন। সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সাথে ফতেহবাদে জায়গীর লাভের শর্তে সমঝোতা করে তিনি পূর্ব দিকে সরে আসেন।
ঈসা খান মসনদে আলা মোগলদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুললে মানসিংহ ওসমানকে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন।
ময়মনসিংহ এলাকায় গড়ে উঠা ওসমান রাজ্যটিও মোগলদের আক্রমনের স্বীকার হয়।
এক পর্যায়ে ওসমান আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হন। তরফ অধিপতি সৈয়দ মুসা তাঁর বৈশ্যতা স্বীকার করেন। ইটার সুবিদ নারায়ন পরাজিত হন।
তরফ ,ইটা ,চুয়াল্লিশসহ বিরাট এলাকা ওসমানের অধীনস্থ হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস রচনার উৎস বাহারিস্তান-ই-গায়বী, তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী এবং আকবরনামার মতো বিখ্যাত গ্রন্থে খাজা ওসমান খান লোহানীর জীবনী লিপিবদ্ধ আছে।
ওসমান রাজ্যের ক্ৰমবৰ্ধমান বিস্তার মোগলদের সহ্য হয়নি।১৬১২ সালের মার্চ মাসে মোগল ও ওসমান বাহিনী দৌলম্বপুর নামক একটি গ্রামে মুখোমুখি হয়। শুরুতেই মোগল বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মোগল সেনাপতি ইফতিখার খান তুর্কমেন এবং শেখ আচ্ছা উভয়কেই হত্যা করা হয়। সুজাত খানের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় বাহিনীও পরাজিত হয তবে সুজাত পালিয়ে বন্দিত্ব এড়াতে সক্ষম হন , মোগলদের পরাজয় যখন নিশ্চিত ঠিক তখনই ইফতিখার খানের অনুগত সৈনিক শেখ আবদুল জলিল তার ঘোড়ায় চড়ে ওসমানের দিকে যাত্রা করেন। আবদুল জলিল ওসমানের দিকে লক্ষ্য করে তীর ছোড়েন। তীরটি তাঁর বাম চোখ ভেদ করে মাথার মগজে ঢুকে যায়। অসীম সাহসী ওসমান তীরটি নিজ হাতে বের করতে গেলে তাঁর ডান চোখটিও বের হয়ে আসে। অন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি এক হস্তী-আরোহীকে তাঁর ভাই সুজাত খানকে খুঁজে বের করে আক্রমণ করার জন্য ইশারা করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই উসমান বাকশক্তি হারান এবং তারপর মারা যান।
ওসমানকে পাঠানরা উহারে ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং দুটি পাহাড়ের মাঝখানে অজ্ঞাত স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সারতে আফগানরা ৪৯টি হাতি এবং প্রচুর পরিমাণ রত্নালঙ্কার মোগল সম্রাটকে উপহার দেয়।
ওসমান রাজ্যের পতনের পর তাঁর বিশ হাজার পাঠান সৈন্য দিক বেদিক পালিয়ে যায়। অনেকেই মোগলদের হাতে নিহত হন। অনেক পাঠান পাহাড়ি এলাকায় লুকিয়ে দিনাতিপাত করেন।
খাজা ওসমান খান লোহানীর পতনের মাধ্যমে বাংলায় পাঠান শাসনের অবসান ঘটে আর বাংলার পূর্বাংশ সহ আসামের বিস্তীর্ন এলাকা সুবাহবাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়।
কমলগঞ্জের উত্তরাঞ্চলে খান বংশজাত বেশ কিছু পরিবার বিদ্যমান। এদের অনেকেই পাঠান বংশীয় বলে নিজেদের দাবি করেন,অবশ্য সুবিদ নারায়নের চার পুত্র ইন্দ্র নারায়ণ,চন্দ্র নারায়ণ ,কৃষ্ণ নারায়ণ ও শিব নারায়ণ খাজা ওসমানের হাতে ধৃত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে নাম ধারণ করেন জামাল খান ,কামাল খান ,হাজী খান ও ঈসা খান।
রাজধানী উহারকে মোগলরা ছিন্নভিন্ন করে। এক সময় এলাকাটি মানুষের নিকট পতন উহার নামে পরিচিত হয়। খাজা ওসমানের রাজধানী পতন উহার এলাকাটাই কালক্রমে শব্দের বিবর্তনের মাধ্যমে নাম ধারণ করে আজকের পতন ঊষার।
অনেকে রাজা সুবিদ নারায়নের পুত্র সূর্য নারায়নের পত্নী ঊষারাণীর নামে পতন ঊষার নাম হয়েছে বলে দাবী করেন। ঊষা রাণীর নামে নামকরণ হলে জায়গাটির নাম পতনঊষা হতো পতনঊষার নয়।
ঊষা রাণী খাজা ওসমান খান লোহানীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন। পরাজিত কারো নামে স্থানের নাম করনের নজির নেই বলে নামকরনের এই ইতিহাস খন্ডন করেন এই সময়ের অনেক বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদ।
নাম করনের কারন যাই হোক পতনঊষার ঐতিহাসিক স্থান,শেষ পাঠান সুলতানের রাজধানী।
মোগল আর ইংরেজ আমলে এই পাঠান নরপতির সকল স্মৃতি চিহ্ন মুছে দেওয়া হলেও ইতিহাস মুছে দেওয়া যায়নি।
বাংলার ইতিহাস লালন করছে বারভূঁইয়াদের অন্যতম খাজা ওসমান খান লোহানীর শৌর্য ,বীর্য আর সাহসের উপখ্যান।এই উপখ্যান জাগ্রত থাকবে যুগের পর যুগ হয়তো অনন্তকাল।