মরণনেশা এলএসডির নেটওয়ার্ক দেশেই
ভয়াবহতার বিচারে এটিকে বলা হয়ে থাকে লাস্ট স্টেজ অব ড্রাগ অনলাইনে বিক্রি, নেদারল্যান্ডস থেকে কেনার পর আসে কুরিয়ারে । এটি সেবনে মনের ভেতর এক অলীক মায়াজাল সৃষ্টি হয় বলে পশ্চিমা বিশ্বের মাদকসেবীদের কাছে পরিচিত ‘হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগ’ হিসেবে। ভয়াবহতার বিচারে এটিকে বলা হয়ে থাকে ‘লাস্ট স্টেজ অব ড্রাগ’। হ্যাঁ, বলা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে ক্রমে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী মাদক এলএসডি বা লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইডের কথা। দুঃখজনক ও ভয়াবহ উদ্বেগের সংবাদ হলেও সত্যি- হেরোইন, কোকেন, খাট, আইস, এনপিএস, ইয়াবার পর এলএসডি নামের এ মরণনেশা এসে গেছে বাংলাদেশেও।
দেশের অবৈধ মাদকের বাজারে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে এলএসডি। ফেসবুকে গ্রুপ ও আইডি খুলে পশ্চিমের ভয়ঙ্কর এ মাদকের বিকিকিনি চলছে বাংলাদেশে যা এতদিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ধারণার বাইরে ছিল বলে ছিল নজরেরও বাইরে। কিন্তু এ মাদক এখন সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের আত্মহনন কাণ্ডের পর।
গত ১৫ মে রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ধারালো দা নিয়ে নিজের গলা গভীরভাবে কেটে ফেলে আত্মঘাতী হন হাফিজুর। কেন তিনি এভাবে আত্মঘাতী হলেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে এলএসডি মাদক কারবারের গোপন নেটওয়ার্কের হদিস পান। এ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয় অনলাইনে। আর মাদকটি নেদারল্যান্ডস থেকে আসে কুরিয়ার সার্ভিসে।
গোয়েন্দারা জানতে পারেন- ঢাকার বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি এবং গাঁজা পাতার নির্যাস দিয়ে কেক তৈরি করে তা ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে বিক্রি করছে। যার পেমেন্ট নেওয়া হচ্ছে অনলাইনে। এলএসডি মাদক মানবদেহের সাধারণ চিন্তা ও অনুভূতিকে পাল্টে দেয়; মাদক গ্রহণকারীর ভেতরে অলীক বা কাল্পনিক ভাবনা বা অনুভবের সৃষ্টি করে। মাদকটি গ্রহণের পর সেবীরা মনে মনে ভাবতে থাকেন, যেন আকাশে উড়ছেন! ঢাবি শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর পেছনে এই এলএসডি দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে গত বুধবার রাতে ৬ লাখ টাকা মূল্যের ২০০ ব্লট এলএসডি মাদক জব্দ করেছে ডিবি পুলিশের রমনা বিভাগ। এগুলোর প্রতিটি ব্লটের মূল্য ৩-৪ হাজার টাকা। এলএসডি বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় নিহত হাফিজুরের বন্ধু নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র সাদমান সাকিব ওরফে রূপল (২৫) ও আসহাব ওয়াদুদ ওরফে তুর্জ এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব আশরাফকে (২৩)।
হাফিজুরের মৃত্যুর বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, গত বুধবার বাংলাদেশে প্রথম আমরা এলএসডি উদ্ধার করেছি। এ ঘটনায় ৩ তরুণকে গ্রেপ্তার করার পর তাদের কাছ থেকে গাঁজার কেক তৈরি ও বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়। জানা গেছে, ‘বেটার ব্রাওরি অ্যান্ড বেয়ন্ড’ নামে দুটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে সেখানে গাঁজা পাতার নির্যাস দিয়ে কেক তৈরি করে মাদক হিসেবে বিক্রি করতেন তারা। এ গ্রুপে প্রায় এক হাজার সদস্য। তবে কেক মাদক উদ্ধার করা যায়নি।
সাদমান সাকিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর বহিষ্কৃত ছাত্র। বর্তমানে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ (শেষ বর্ষ) পড়াশোনা করছেন। তিনিই মূলত বছরখানেক আগে টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের এক নাগরিকের কাছে এ মাদক অর্ডার করেন। নেদারল্যান্ডস থেকে ই-মেইল ও চিঠির মাধ্যমে আসা ডাকটিকিটের মতো দেখতে এ মাদকের প্রতিটি ব্লট ৮০০ ও এক হাজার টাকায় কেনা হয়। কুরিয়ার সার্ভিস পার্সেলের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় এটি। ‘আপনার আব্বা’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে সাদমানসহ তাদের তিন বন্ধু সেখান থেকে এলএসডি বিক্রি করতেন।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আরও বলেন, এলএসডি মাদকের ছদ্মনাম এমডিএমএ, এন, এম-ডাইমথাইলিটিপেনিয়া, সিলোসাইবিন মাশরুমসহ এলএসডি-২৫, অ্যাসিড, ডেলিসিড ইত্যাদি নামে ডাকে সেবীরা। মাদকটি ব্লট আকারে পাওয়া যায়। যা খুব ছোট একটি কাগজের টুকরা সদৃশ মাদকমিশ্রিত বস্তু। তিন ছাত্রের কাছ থেকে উদ্ধার এলএসডিগুলো দেখতে স্ট্যাম্পের মতো। এগুলো যে মাদক তা দেখে বুঝার উপায় নেই। এলএসডি সেবকরা ঠোঁটের নিচে এ এলএসডি রেখে দিত। মাদকগুলো সাধারণত মানবদেহের চিন্তা, অনুভূতি এবং পারিপার্শ্বিক চেতনাকে পরিবর্তন করে। সেবনকারীর দৃষ্টি ও শ্রুতির মধ্যে হ্যালুসিনেশন তৈরি হয়। এটি সেবন করলে চোখের মণির বিকৃতি ঘটে, শরীরের রক্তচাপ ও তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এলএসডি শুধু ক্ষতিকারকই নয়, ব্যয়বহুলও।
ডিবির এ কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রেপ্তারকৃত সাদমান, আসহাব ওয়াদুদ ও আদিব আশরাফ এ তিনজন একত্রে এ ফেসবুক আইডি ও গ্রুপের মাধ্যমে মাদকটি বিক্রি করতেন। এটি নতুন ও দামি মাদক হওয়ায় গ্রেপ্তারকৃতরা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতেন। তিনি আরও বলেন, উন্নত দেশগুলোতে এটি নিষিদ্ধ মাদক। এমনকি এর ক্রয়-বিক্রয় বাংলাদেশের প্রচলিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ এলএসডি মাদকসহ অন্য মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে আদালতে সোপর্দ করা হবে। যারা নেদারল্যান্ডস থেকে এ মাদক বাংলাদেশে পাঠিয়েছে, তাদের শনাক্তের জন্য পুলিশ সদরদপ্তরের এনসিবি বিভাগে চিঠি দিয়ে খোঁজ নিতে বলা হবে। নতুন ভয়ঙ্কর এ ড্রাগের যাতে বিস্তার লাভ করতে না পারে সে লক্ষ্যে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সর্বসাধারণের এ ড্রাগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান পুলিশ কর্মকর্তা একেএম হাফিজ আক্তার।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও এলএসডির ইতিহাস ঘেঁটে ডিবি জানতে পারে, এলএসডিসেবীরা নিজেকে অনেক শক্তিশালী ভাবেন। সেবনকারী চিন্তা করেন তিনি বুঝি পরির মতো উড়তেও পারবেন। তার স্মৃতি চলে আসে মানসপটে, ভেসে বেড়ায়। এটি সেবনের পর কারও কারও এমন অস্বাভাবিক মানসিকতা হয় যে, মনে করেন তিনি বুঝি ট্রেন পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে থামিয়ে দিতে পারবেন। এটি ব্যবহারে যে কারও মাথা ভার হয়ে যাবে। হেলোজেনিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। কেউ যদি গান শোনেন, তার সামনে গানের মিউজিকগুলো বিভিন্ন রঙের মতো ঘুরতে থাকে। এগুলো স্রেফ মায়াজাল, এক ধরনের কাল্পনিক বিভ্রম। এলএসডি সেবনকারী অত্যন্ত হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক আচরণ করে। একটি এলএসডি ব্লট সেবন করলে ৮-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া থাকে। অতিরিক্ত সেবনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্তও প্রতিক্রিয়া হয়।
ঢাবি শিক্ষার্থী হাফিজুরের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পেছনে এলএসডি সম্পৃক্ত কি-না? প্রশ্ন রাখা হলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, সম্প্রতি হাফিজুর রহমান নামে ঢাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় ডিবি তদন্ত শুরু করে। হাফিজের বন্ধুরা বলেছে, হাফিজ একটি নতুন ও অদ্ভুত মাদকে আসক্ত ছিল। এর পরই এলএসডির বিষয়ে তথ্য পেয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, হাফিজুরের মৃত্যুর পেছনে এলএসডির সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে আত্মহত্যা করা হাফিজুরের মরদেহের ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পর বলা যাবে, তিনি এলএসডিতে আসক্ত ছিল কিনা?
ডিবি সূত্র জানায়, সাদমান সাকিব বছরখানেক আগে টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডস থেকে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম এ মাদক অর্ডার করেন। মাদকের জন্য তারা অনলাইনভিত্তিক অর্থ লেনদেন (পেমেন্ট) ব্যবস্থা পে-প্যালে টাকা পরিশোধ করলে পার্সেলের মাধ্যমে এই মাদক আসে। সুইডেন থেকেও এলএসডি মাদক আমদানি করা হয়। গত ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় তার তিন বন্ধু (গ্রেপ্তার) এলএসডি সেবন করান। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তিনি শুধু একটি শর্টস পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এর পর ঢামেক হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ভ্যানে রাখা দা নিয়ে তিনি নিজের গলায় আঘাত করেন। গলার রগ ছিড়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লেও আহত হাফিজুরের কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। একটু টালমাটাল অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চলতে দেখা যায় তাকে।
খবর পেয়ে পুলিশ এসে অনেক বুঝিয়ে তাকে একটি রিকশাযোগে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে। সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাত ৯টা ৪০ মিনিটে অজ্ঞাতনামা হিসেবে মৃত্যু হয় হাফিজুরের। লাশ শনাক্তের পর তার চিকিৎসা এবং অজ্ঞাতনামা হিসেবে ঢামেক মর্গে তার লাশ আট দিন পড়ে থাকার ঘটনার তদন্ত দাবি করে আসছেন হাফিজুরের সহপাঠীরা।
-ইউসুফ সোহেল, আমাদের সময়
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান