মানুষের কল্যাণে নজরুল আজীবন নিজেকে উৎসর্গ করেছেন: নিউইয়র্কে নজরুল জয়ন্তী উৎসবে ড. উইনস্টন ল্যাংলি
জ্যামাইকা, নিউ ইয়র্ক: নজরুল একজন পরিপূর্ণ বাঙালি হিসেব যিনি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, রাজনৈতিক হানাহানি, শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। তিনি আজীবন মানুষের কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন নজরুল গবেষক ড. উইনস্টন ল্যাংলী। ১৪ অক্টোবর নিউইয়র্কে জ্যামাইকাস্থ মেরি লুইস একাডেমি মিলনায়তনে নজরুল একাডেমি ইউএসএ’র ১০ বছর পূর্তী উপলক্ষে আয়োজিত নজরুল জয়ন্তী উৎসবের এক আলোচনায় নজরুল গবেষক ড. উইনস্টন ল্যাংলি এই মন্তব্য করনে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. উইনস্টন ল্যাংলী রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইমেরিটাস অধ্যাপক, এবং ম্যাসাচুসেটস বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাককরম্যাক গ্র্যাজুয়েট স্কুলের সিনিয়র ফেলো, যেখানে তিনি ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একাডেমিক বিষয়ের জন্য প্রভোস্ট এবং ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মানবাধিকার, বিশ্বব্যবস্থা, ধর্ম এবং রাজনীতির বিকল্প মডেল নিয়ে ড. উইনস্টন ল্যাংলী আজীবন কাজ করেছেন। তাঁর প্রকাশনাগুলির মধ্যে রয়েছে ‘কাজী নজরুল ইসলাম: দ্যা ভয়েস অফ পোয়েট্রি অ্যান্ড দ্যা স্ট্রাগল ফর হিউম্যান হোলনেস’।
ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ এর সঞ্চালনায় ‘বিশ্বায়নে নজরুল’ বিষয়ক এই আলোচনা সভায় আরো অংশগ্রহন করেন ড. গুলশান আরা কাজী, কাজী বেলাল এবং অধ্যাপক ড. রেচেল ফেল ম্যাকডরমেট। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে কীভাবে নজরুলকে স্মরণ করা হয়, উদযাপন করা হয় এবং ভিন্নভাবে চিন্তা করা হয় তা অন্বেষণ করার বিষয়ে আগ্রহের কথা বর্ণনা করেছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রেচেল ফেল ম্যাকডারমট। নজরুল ছিলেন বিপ্লবী, তাঁর লেখার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে ব্রিটিশ-বিরোধী ও ঔপনিবেশিক বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেছেন। নজরুল সামাজিক অন্যায়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন, বলেন প্রফেসর রেচেল ফেল ম্যাকডারমট। এশিয়ান এবং মধ্য প্রাচ্যের সংস্কৃতি, ও মানবাধিকার বিষয়ের অধ্যাপক রেচেল ফেল ম্যাকডারমট তাঁর গবেষণায় পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের নানা বিষয়ে তুলে এনেছেন। তিনি ভারত উপমহাদেশের হিন্দু-দেবী কেন্দ্রিক ধর্মীয় ঐতিহ্যের উপর ব্যাপকভাবে গবেষণা এবং বই প্রকাশ করেছেন। তৎকালীন ভারতের ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উপর ও গবেষণা করেছেন।
নজরুল ইসলামের ‘ইসলাম ও হিন্দু’ ধর্মের অনুশীলন তার লেখাকে প্রভাবিত করেছে, বলেন রেচেল ফেল ম্যাকডারমট। তাঁর কবিতার মধ্যে হিন্দু এবং মুসলিম চরিত্রের চিত্রায়ন যা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়, যোগ করেন ম্যাকডারমট। ম্যাকডারমট স্বীকার করেছেন যে, নজরুল ইসলামের সাংস্কৃতিক প্রভাবকে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে বেশ আলাদাভাবে স্মরণ করা হয়, যাকে যথাক্রমে মুসলিম পুনর্জন্মের প্রবক্তা এবং ‘একজন ধর্মনিরপেক্ষ আইকন’ হিসাবেও তাঁকে চিত্রিত করা হয়। নজরুল বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুসলিম পুনর্জন্মের পথিকৃৎ হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, নজরুল আজীবন সাম্যের যে গান গেয়েছেন, তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে হবে। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জনে যে পথ রচিত হয়েছিল, তার পেছনে সাম্যের কবি নজরুলের সৃষ্টিশীল রচনা অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
বৈরি আবাহওয়ার মধ্য দিয়ে ডানা ইসলামের সঞ্চালনায় সন্ধ্যা ৬ ঘটিকার সময় ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ স্লোগানে নিউইয়র্কে জ্যামাইকাস্থ মেরি লুইস একাডেমি মিলনায়তনে নজরুল একাডেমি ইউএসএ’র ১০ বছর পূর্তী উপলক্ষে আয়োজিত নজরুল জয়ন্তী উৎসব শুরু হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারন সম্পাদক শাহ আলম দুলাল। এরপর নজরুলের কবিতা, গানে আবৃতি ও নৃত্য পরিবেশন করে নজরুল একাডেমি ইউএসএ’র ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ। এতে অংশগ্রহণ করে নাহরীন ইসলাম, কবির কিরন, রুমানা মাহজাবিন, ফারুক আজম।
অনুষ্ঠানে বিশেষ নৃত্যানুষ্ঠান পরিবেশন করে বাংলাদেশ একাডেমি অব পারফর্মিং আর্টস (বাফা)। ফিরে দেখা নজরুল একাডেমীর ১০ বছর অনুষ্ঠানের আলোচনায় অংশগ্রহন করেনঅধ্যক্ষ আজিজুল হক, এ বি এম সালেহ উদ্দিন এবং মাহমুদ খান তাসের। আলোচনা অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন মোহাম্মদ মালেক। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের পরিবেশনায় নজরুল সঙ্গীত পরিবেশনায় অংশগ্রহন করে শৌভিত রয় চৌধুরী, ঋতুজা ব্যানার্জি, সৃজিতা হিয়া, ঋতিকা ব্যানার্জি। বল বীর, চির উন্নত মম শির বিদ্রোহী কবিতা’র উপর নৃত্য কাব্য পরিবেশনা ছিলেন আবৃতি শিল্পী মেহের কবিরের কবিতায় নৃত্যে পরিবেশন করেন ড. নীলা জারিন।
নজরুল একাডেমীর নিজস্ব শিল্পীদের সমবেত পরিবেশনা ‘ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত’ অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করে নার্গিস রহমান, হাফিজা বেগম, শিরিন আহমেদ, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, রুমা আলম, শৌভিত রয় চৌধুরী, ড. রুমা চৌধুরী, নার্গিস বেগম, ঋতাজা ব্যানার্জি, প্রিয়া প্রিয়াঙ্কা, ফারহানা তুলি, ডানা ইসলাম ও শাহ আলম দুলাল। লিমন চৌধুরীর পরিচালনায় একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন প্রিয়া প্রিয়াঙ্কা, জারিন মাইশা, ফারহানা তুলি ও লিমন চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে ক্রেস্ট প্রদান করা হয় গিয়াস আহমেদ এবং আকাশ রহমানকে। এরপরই মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করেন নজরুল সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ড. নিরুপমা রহমান। নজরুল একাডেমি ইউএসএ ১০ বছর উপলক্ষে ১১০ পাতার একটি ম্যাগাজিন বের করা হয়। ম্যাগাজিনের ডিজাইন এবং অনুষ্ঠানের দৃষ্টিনন্দন ব্যাকড্রপ তৈরি করেন শিল্পী রাগীব আহসান। অনুষ্ঠানের শব্দ ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সায়েম উল্ল্যাহ ও তার সাউন্ড গিয়ার। তবলায় সঙ্গত করেন তপন মোদক, কি-বোর্ড মাসুদ, মন্দিরায় শহীদ উদ্দিন, এবং অক্টোপ্যাডে ছিলেন রাকেশ ব্যানার্জী। সবশেষে সংগঠনের সভাপতি কিউ জামানের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।