দেশের সংবাদ ফিচার্ড

‘যেখানেই ওদের পাবে, গুলি করবে’- হাসিনার ফোনালাপের সত্যতা পেয়েছে বিবিসি

hasina-phone-alap-fas

ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান দমনে সরাসরি গুলি চালানোর হুকুম দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপ থেকে উঠে এসেছে এই তথ্য। যার সত্যতা যাচাই করেছে বিবিসি আই।

‘এক্স-বাংলাদেশ লিডার অথরাইজড ডেডলি ক্র্যাকডাউন, লিকড অডিও সাজেস্ট’ শিরোনামের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। সেখানে বলা হয়েছে, ওই অডিওতে হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। বলেন- যেখানেই ওদের পাবে, গুলি করবে।

হাসিনার অনুপস্থিতিতেই বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার শুরু হয়েছে। সেই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে রেকর্ডটি উপস্থাপন করতে চায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের গণঅভ্যুত্থানে প্রায় ১,৪০০ মানুষ প্রাণ হারান। যদিও ভারতে পালিয়ে থাকা হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দলটির একজন মুখপাত্র দাবি করেছেন, অডিওটি ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কোনো বেআইনি উদ্দেশ্য’ প্রমাণ করে না।

ওই ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে একটি অজ্ঞাত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে শোনা যায়। এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ যে, তিনি সরাসরি আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর হুকুম দিয়েছেন। তিনি এমন আন্দোলনে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন যেখানে তার বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন।

সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য কোটা বাতিলের দাবিতে ওই আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। যা একপর্যায়ে গণবিক্ষোভে রূপ নেয়। ফলে হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের পতন হয়। ১৯৭১ সালের পর এটিই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে রক্তাক্ত রাজনৈতিক আন্দোলন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্তাক্ত ছিল ৫ আগস্ট। সেদিন হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান হাসিনা। সেসময় প্রধানমন্ত্রীর গণভবন ঘিরে ফেলে জনতা।

বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অনুসন্ধানে ঢাকায় পুলিশি সহিংসতার বেশ কিছু অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যার মধ্যে রয়েছে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা। যা আগে জানা যায়নি। ফাঁস হওয়া ফোনকলটি গত বছরের ১৮ জুলাইয়ের। তখন হাসিনা গণভবনে অবস্থান করেছেন। তার ফোনকলের পরপরই আন্দোলন ভয়াবহতার দিকে রূপ নেয়। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভকারীদের নিহত হওয়ার ভিডিও ঘিরে জনমনে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়। এরপরের কয়েকদিনেই রাজধানীজুড়ে সামরিক অস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়। যে বিষয়টি পুলিশের নথিতেও উঠে এসেছে।

এই কলটি রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। অডিওটি মার্চ মাসে অনলাইনে ফাঁস হয়। যদিও কারা ফাঁস করেছে তা এখনো অজানা। তবে অডিওটি যে হাসিনার তা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। তারা জানিয়েছে, এটি তার কণ্ঠই। বিবিসিও আলাদাভাবে ইয়ারশট নামের এক অডিও ফরেনসিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে এটি যাচাই করেছে।

ইয়ারশটের বিশ্লেষণে দেখা যায়, অডিওটি এডিট করা হয়নি, কৃত্রিমভাবে তৈরি বা পরিবর্তনও করা হয়নি। অডিওতে বিদ্যুৎ লাইনের ফ্রিকোয়েন্সি (ইএনএফ), ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড, কণ্ঠের ছন্দ, শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ- সব কিছুই প্রমাণ করে এটি অরিজিনাল রেকর্ড। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পরামর্শদাতা বৃটিশ মানবাধিকার আইনজীবী টোবি ক্যাডম্যান বলেন,
এই রেকর্ডগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো পরিষ্কার ও যথাযথভাবে যাচাই করা হয়েছে। আর অন্যান্য প্রমাণের সঙ্গেও এর মিল আছে।

তবে আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, আমরা নিশ্চিত নই বিবিসির উল্লিখিত রেকর্ডটি আসল কি না।

শেখ হাসিনার পাশাপাশি সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও বিক্ষোভকারীদের হত্যার অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এখন পর্যন্ত মোট ২০৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে। এর মধ্যে ৭৩ জন বর্তমানে আটক রয়েছেন।

বিবিসি আই ৩৬ দিনের বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের হামলার শত শত ভিডিও, ছবি ও নথিপত্র বিশ্লেষণ ও যাচাই করেছে। তদন্তে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার ব্যস্ত এলাকা যাত্রাবাড়ীতে একটি ঘটনায় কমপক্ষে ৫২ জনকে পুলিশ হত্যা করে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে পুলিশি সহিংসতার অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

তখনকার প্রাথমিক প্রতিবেদনে ৩০ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। চোখের দেখা ভিডিও, সিসিটিভি ফুটেজ ও ড্রোন ইমেজ বিশ্লেষণ করে বিবিসি আই নিশ্চিত করেছে, সেনাবাহিনীর সদস্যরা যারা শুরুতে বিক্ষোভকারীদের থেকে পুলিশকে আলাদা করে রেখেছিল, তারা স্থান ত্যাগ করার পরপরই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে পুলিশ পালিয়ে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের পেছনে গুলি চালায়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা গলিপথ ও মহাসড়ক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। পরে পুলিশ সদস্যরা কাছের একটি স্থানে আশ্রয় নেয়।

ঘণ্টা কয়েক পর বিক্ষোভকারীরা পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে যাত্রাবাড়ী থানায় আগুন ধরিয়ে দিলে ৬ জন পুলিশ সদস্যও নিহত হন ।

বাংলাদেশ পুলিশের এক মুখপাত্র বিবিসিকে জানান, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে সংঘটিত সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের দ্বারা দুঃখজনকভাবে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ পুলিশ এই ঘটনায় নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করেছে।

এএফপির একটি ছবিতে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট ঢাকায় বিক্ষোভকারীদের আগুন ধরানো যাত্রাবাড়ী থানা দেখতে লোকজন ভিড় করছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার গত মাসে শুরু হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যার আদেশ দেওয়া, বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সহিংসতা, উসকানি, ষড়যন্ত্র ও গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থতাসহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও ভারত এখনো শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠায়নি। ব্যারিস্টার টবি ক্যাডম্যান বলেন, হাসিনা স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে বিচারপ্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন বলে মনে হয় না।

আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ দলটির কোনো সিনিয়র নেতা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা পরিচালনার দায়ে দায়ী নন।

এক মুখপাত্র বলেন, তৎকালীন সিদ্ধান্তগুলো ছিল সঙ্গতিপূর্ণ, সদিচ্ছার ভিত্তিতে নেওয়া এবং প্রাণহানি কমানোর লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছিল। তারা জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করেছেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পদক্ষেপগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে।

বিবিসি মন্তব্যের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

শেখ হাসিনার পতনের পর, বাংলাদেশ এখন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে চলছে। তার সরকার জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এখনো পরিষ্কার নয় যে, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হবে কিনা।

সূত্র: মানবজমিন

এফএইচ/বিডি


CBNA24  রকমারি সংবাদের সমাহার দেখতে হলে
আমাদের ফেসবুক পেজে ভিজিট করতে ক্লিক করুন।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল ভিজিট করতে পোস্ট করুন।

সংবাদটি শেয়ার করুন