ধর্ম-কর্ম ফিচার্ড

রোজা ভঙ্গের কারণ কি কি? রোজা নিয়ে আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর

রোজা-ভঙ্গের-কারণ-কি-কি

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ হলো কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত। সুতরাং রোজা ইসলাম ধর্ম পালনকারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঈবাদত। রোজার আরবি হলো সিয়াম। সিয়াম শব্দের শাব্দিক অর্থ বিরত থাকা। অর্থ্যাৎ সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ ও সবল মুমিনের জন্য রোজা রাখা আবশ্যক। তবে এই সিয়াম পালনের রয়েছে বেশ কিছু নিয়ম, এসব নিয়মের হের-ফের হলে তা রোজা ভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার রোজা নিয়ে কিছু কিছু ভুল ধারণাও প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে। আসুন জেনে নেই, রোজা ভঙ্গের কারণ কি কি? এবং রোজা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা ও কিছু অজানা প্রশ্নের উত্তরঃ

 

রোজা ভঙ্গের কারণ কি কি?

ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, রোজা ভাঙ্গার মূল কারণ আসলে পাঁচটি। সেগুলো হলো—

১। ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার খেলে
২। ইচ্ছাকৃতভাবে পান করলে
৩। শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়লে
৪। মুখ ভর্তি বমি হলে
৫ রোজা রাখা অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে

 

রোজা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ হিসেবে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণাসমূহঃ

উপরোক্ত পাঁচ কারণের বাইরে আরও কিছু বিষয়কে রোজা ভাঙ্গার কারণ হিসেবে সমাজে প্রচলিত আছে। কিন্তু ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে এগুলো ভুল ধারণা। সমাজে প্রচিলত থাকার কারণে রোজাদাররা সেগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। এতে রোজাদার ব্যক্তির সিয়াম সাধনার কষ্ট বেড়ে যায়, সেইসাথে তার চারপাশের মানুষকেও বিড়ম্বনায় ফেলেন। তাই, রোজা সম্বন্ধে প্রচলিত তেমনই কিছু ভুল ধারণা সম্বন্ধে জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

 

ভুল করে খেয়ে ফেললে কি রোজা ভাঙ্গে?

অনেকসময় এমন হয় যে কেউ রোজা আছেন কিন্তু হঠাৎ মনের ভুলে হয়ত খাবার খেয়ে ফেলে বা পানি পান করে। সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার পর ঐ রোজাদার ভাবেন তার রোজা হয়তো সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে গেছে এবং তখন সে পরিপূর্ণ খাবার খান।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম বলেন, “মনের ভুলে ভরপেট খাবার খেলেও রোজা ভেঙ্গে যাওয়ার কথা ইসলামে বলা হয়নি। এতে রোজা মাকরূহ হতে পারে। রোজা ভেঙ্গে যাবে, যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছা করে পানাহার করে। মুখে খাবার নেওয়ার পর যখনই মনে আসবে, তখন ফেলে দিতে হবে। আর গেলা যাবে না।”

মাকরূহ অর্থকে তিনি ব্যাখ্যা করেন, “মাকরূহ মানে অপছন্দনীয়। মাকরূহ মানে— রোজা হয়ে যাবে, কিন্তু রোজার সৌন্দর্যবোধটা শতভাগ হলো না।”

 

রোজা রেখে রান্নার সময় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করা যাবে?

যিনি রান্না করেন তাকে অনেকসময় রান্নার স্বাদ যেমন লবণ, ঝাল ইত্যাদি বোঝার জন্য কিছুটা খাবার পরখ করে দেখতে হয়। কিন্তু অনেকে বলেন, রোজা রেখে খাবারের স্বাদ গ্রহণ করলে রোজা মাকরূহ হয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে ঢাবি ইসলামি স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলম বলেন, “খাবারের স্বাদ নেয়া যাবে। লবণ, ঝাল বা স্বাদ বোঝার জন্য জিহ্বায় লাগানো যায়, এরপর ফেলে দিতে হবে। রান্নাবান্না থেকে তো আর দূরে থাকা যাবে না। তবে, ঘরে যদি কম বয়সী বা রোজা রাখেনি, এমন কেউ থাকে; তাদেরকে দিয়ে খাবারের স্বাদ টেস্ট করালে সবচেয়ে ভালো হয়”।

 

রোজা রেখে ঔষধ খাওয়া যাবে কি?

রোজা রেখে ঔষধ সেবন করা যাবে কি না এ ব্যাপারে ঢাবি অধ্যাপক আলম বলেন, “যে ঔষধ পেটে যায়, মানে ক্ষুধা কমায়, সেগুলা নিষেধ। কিন্তু নাকে বা চোখে কোনও ড্রপ দিলে, সেটাতে কোনও সমস্যা নাই। ইনসুলিন ইফতারর আগ মুহূর্তে নিতে হবে। তবে ইমার্জেন্সি হলে সব বৈধ। মৃত্যুর আশঙ্কা থাকলে, স্বাস্থ্যের অবনতির আশঙ্কা থাকলে ইসলামে সব বৈধ”। যেসব ওষুধ গিলে খেতে হবে, সেগুলো ইফতারের পরে বা সেহরির আগে খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

 

রোজা রেখে ধূমপান করা যাবে কি?

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, অনেকেই মনে করেন সিগারেট তো কোনও খাবার বা মাদক না, তাই রোজা অবস্থায় ধূমপান করলে রোজা ভেঙ্গে যাওয়ার কোনও বিষয় নেই।

এ বিষয়ে অধ্যাপক আলমের বক্তব্য হচ্ছে, “ধূমপান শুধু রোজা থাকা অবস্থায় না, রোজা ছাড়াও হারাম। মাদকদ্রব্য শুধু সেবনকারীর ক্ষতি করে না, এটি অন্যেরও ক্ষতি করে। তারপরও মাদকদ্রব্য হারাম। এটি বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এটা রোজায় না কেবল, রোজা ছাড়াও খাওয়া ঠিক না। আর যে ধূমপান করছে, সে তো এটা খেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছে। অনেকে ভাতের পরিবর্তে সিগারেট খায়। তাই, এটি খেলে রোজা ভেঙ্গে যাবে।”

 

মুখের লালা গিলে ফেললে কি রোজা ভেঙ্গে যায়?

মুখের লালা পেটে চলে গেলে রোজা ভেঙ্গে যাবে; এটি রোজা ভাঙ্গার একটি বহুল চর্চিত কারণ। এই প্রচলিত ধারণার কারণে অনেক রোজাদার যেখানে সেখানে থু থু ফেলেন।

অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম বলেন, “মুখের লালা গিলে ফেললে কিচ্ছু হয় না রোজার। এ বিষয়ে ধর্মে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই অর্থাৎ, ইন্টার্নাল কিছু পেটে ঢুকলে রোজা ভেঙ্গে যাবে না।” তবে অন্য কারও মুখের লালা যদি নিজের মুখে যায়, তাহলে রোজা থাকবে না। অর্থাৎ, রোজা পালন করা অবস্থায় স্ত্রীকে এমনভাবে চুমু খাওয়া যাবে না যাতে একে অপরের মুখের লালা একে অপরের মুখে চলে যায়।

 

রোজা রেখে দাঁত ব্রাশ করা যাবে?

অনেকে বলেন, রোজা রাখা অবস্থায় দাঁত ব্রাশ করা যাবে না। কিন্তু দীর্ঘ সময় দাঁত ব্রাশ না করার কারণে মুখে দুর্গন্ধ তৈরি হয় এবং তাতে কথা বলার সময় চারপাশে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. আলম বলেন, “দাঁত ব্রাশ করলে রোজার কিচ্ছু হবে না। তবে পেস্ট আছে তো, ভুলে গলায় চলেও যেতে পারে। পেস্ট গলায় গেলে রোজা মাকরূহ হবে। সেজন্য এটা সাহরী খাওয়ার আগে করাই ভালো”।

 

রোজা রেখে নখ এবং চুল-দাড়ি কাটা যাবে?

রোজা রাখা অবস্থায় কিছুতেই নখ ও চুল-দাড়ি কাটা যাবে না, এরকম প্রচলিত আরেকটা ধারণা আছে আমাদের সমাজে। ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, রোজা অবস্থা হাত-পায়ের নখ বা চুল-দাড়ি কাটলে রোজা ভঙ্গ হয়না। তবে যেহেতু, এই কাজগুলো করতে রক্ত বের হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাই রোজা অবস্থায় এই কাজগুলো থেকে বিরত থাকায় ভালো।

 

রমজানে যৌন সম্পর্ক করা যাবে?

অনেকে মনে করেন, পুরো রমজান মাসে স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু শুধুমাত্র রোজা থাকা অবস্থায় যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিধিনিষেধ রয়েছে। তাই, রোজা শুরু ও শেষ এর মধ্যবর্তী সময় অর্থাৎ ইফতারের পর থেকে সুবহে সাদিকের আগে পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে কোনও বাধা নেই। তবে, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পর অবশ্যয় ফরজ গোসলের মাধ্যমে পবিত্র হতে হবে।

 

রোজা রেখে সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে কি?

“রোজা রেখে সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না”, মানুষের মনে গেঁথে থাকা এই ধারণাকে ভিত্তিহীন বলে জানান অধ্যাপক শামছুল আলম। তিনি বলেন, “সুগন্ধি বলতে আতর ব্যবহার করা যাবে, এটা তো নবীর সুন্নত। যুগে যুগে নবী রাসূলরা আতর ব্যবহার করে গেছেন। এটা ব্যবহারে কোনও নিষেধ নেই। তবে পারফিউম ব্যবহারের বিষয়ে এক ধরনের ‘সতর্কতা’ আছে। কারণ পারফিউম তৈরিতে নাকি চর্বি ব্যবহৃত হয়। এটা তো আমরা জানি না। তাই এটা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকলেই বেশি ভালো হয়, শুধু আতর ব্যবহার করা ভালো।”

 

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা

ডেস্ক রিপোর্ট (এফ/এইচ, বিডি)

সংবাদটি শেয়ার করুন