ছবি সংগৃহিত
এমরান হোসাইনঃ লন্ডন প্রবাসী সিলেটের মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসতে চলেছেন রোকসানা (ছদ্মনাম) নামে এক গৃহবধূ। দুবাই প্রবাসী স্বামীকে রেখে এক সন্তানসহ লন্ডন প্রবাসীর হাত ধরে সুখের সন্ধানে পাড়ি জমালেও তার কপালে সুখের ছোঁয়া লাগেনি। দীর্ঘ ১১ বছরের বিবাহিত জীবনে নানারকম অত্যাচার, অপমান আর মানসিক-শারীরিক নির্যাতনে কেটেছে তার দিনগুলো।
ঘটনার শুরু ২০০৮ সালে। রাজধানীর একটি শপিংমলে পরিচয় হয় ৫৪ বছর বয়সী লন্ডন প্রবাসী সিলেট উপশহরের বাসিন্দা মৃত সায়েস্তা মিয়ার ছেলে তিন সন্তানের জনক মতিউর রহমানের সঙ্গে। তার মন ভোলানো মিষ্টি কথা, বিলাসী জীবন আর মিথ্যার ফাঁদে পা দিয়ে ওই বছরের আগস্টে ৫০ হাজার টাকার কাবিননামায় পরিবারের অমতে বিয়ে করেন ৩৭ বছর বয়সী গৃহবধূ। শুরুতেই কাবিননামায় চতুরতার সঙ্গে ২৫ হাজার টাকা ওয়াসিল হিসেবে দেখান বর মতিউর।
বিয়ের প্রথম কয়েক মাস রামপুরার ভাড়া বাসায় সংসার জীবন সুখে কাটলেও কাল হয়ে দাঁড়ায় স্ত্রী ও আগের সন্তানের নামে থাকা কেরানীগঞ্জের ১৩ শতক জমি। কৌশলে স্ত্রীর নামে থাকা ৮ শতাংশ জমি বিক্রি করিয়ে ঢাকার উত্তরায় গরিবে নেওয়াজ রোডে নিজ নামে ফ্ল্যাট কেনেন মতিউর। পরবর্তী সময়ে আগের সন্তানের নামে থাকা ৫ শতাংশ জমিও বিক্রি করিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন বলে জানান ওই গৃহবধূ।
নির্যাতিত গৃহবধূ জানান, দ্বিতীয় বিয়েতে যাতে অমত না থাকে, তাই স্বামীর কথায় প্রথম স্ত্রী এবং তার তিন সন্তানকে সন্তুষ্ট রাখতে মতিউরের নামে ফ্ল্যাট কিনতে তিনি সম্মতি দেন। ফ্ল্যাট নিজের নামে নেয়ার পর থেকে বের হয়ে আসে মতিউরের আসল চেহারা। বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে যৌতুকের নামে আরও ৫ লাখ টাকা চেয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী রোকসানার ওপর চালান শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
এরই ধারাবাহিকতায় বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় ২০১৩ সালে ওই গৃহবধূকে তালাক দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে গৃহবধূর আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয়দের মধ্যস্থতায় তালাকের তিন মাসের মধ্যেই পাঁচ লাখ টাকার কাবিননামা ও স্ত্রীর নামে ৫ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর) রাখার শর্তে আপসনামা দিয়ে পুনরায় বিয়ে করেন। ওই সময় উত্তরার সেই ফ্ল্যাটটি রোকসানার নামে উইল করে দেন। এর কিছুদিন পরেই এফডিআরের সেই টাকা স্ত্রী রোকসানাকে দিয়ে তুলে নেন মতিউর।
কয়েক বছর সংসার করার পর আবারও যৌতুকের টাকার দাবিতে রোকসানাকে শারীরিক নির্যাতন শুরু করেন। অবশেষে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি আবারও তাকে তালাক দেন মতিউর। এ ঘটনায় নির্যাতিত গৃহবধূ ওই বছরই ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করলে আদালত মামলাটি তেজগাঁও থানায় এজাহারের (এফআইআর) নির্দেশ দেন। মামলায় গ্রেফতার এড়াতে এখানেও প্রতারণার ফাঁদ পাতেন মতিউর। মামলা চলাকালীন ওই বছরেই গৃহবধূকে কৌশলে ম্যানেজ করে ১ লাখ টাকা কাবিননামায় পুনরায় বিয়ে করেন। পরে তেজগাঁও থানায় উভয়ে মিলে আপসনামা জমা দিলে থানা পুলিশ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) আদালতে জমা দেন। এর কয়েক মাস পরই চলতি বছর ফের শুরু হয় স্ত্রীর ওপর শারীরিক ও অমানুষিক নির্যাতন।
নির্যাতিতা জানান, এমন নির্যাতনের মুখে তিনি চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে আবারও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি আদালত আমলে নিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় এজাহার (এফআইআর) হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ওসিকে নির্দেশ দেন।
মামলার বাদী গৃহবধূ দাবি করেন, ওসি থানায় মামলাটি ৮ সেপ্টেম্বর পেয়েও এজাহার হিসেবে গ্রহণ না করে কালক্ষেপণ করে তাদের হয়রানি করেন। বাদী মামলা সম্পর্কে ১১ সেপ্টেম্বর থানায় খোঁজ নিতে গেলে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা মামলার আসামি মতিউরের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার রুমে জোর করে আপস-মীমাংসার ব্যবস্থা করেন। এ সময় থানায় বাইরের লোক নিয়ে কাজী ডেকে খোলা তালাক ও ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে ২ লাখ টাকার বিনিময়ে আপস-মীমাংসার জন্য স্বাক্ষর করান। পরে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মামলাটি ১৭ সেপ্টেম্বর থানায় এজাহারভুক্ত করেন।
জোর করে আপস-নিষ্পত্তি ও তালাকের ঘটনায় নির্যাতিত গৃহবধূ দ্বিতীয় সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে আপসনামা বাতিলের ঘোষণামূলক মামলা দায়ের করেন। সংশ্লিষ্ট মামলার কপি, তিনটি কাবিননামাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যুগান্তরের হাতে রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা যুগান্তরকে বলেন, আমি থানায় বসে কোনো আপস-মীমাংসা করাইনি। মামলাটি বর্তমানে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রয়েছে। কোর্টের বিষয়ে আমি কেন মামলা আপস করাতে যাব। বাদী অভিযোগ দিতে পারে, এ বিষয়ে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মামলার বাদী গৃহবধূ বলেন, মামলার আসামি মতিউর রহমান ২৮ অক্টোবর উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন নিয়ে চলতি মাসের ২ তারিখে আমার ও আমার ছোট ভাই ঝিকুর নামে উত্তরা পশ্চিম থানায় বাসা থেকে ফ্রিজ চুরির মামলা করে। জামিনের পর সে আমাকে ও আমার ভাইকে বিভিন্ন হুমকিধমকি দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এরপর মামলার আসামি মতিউর থানা পুলিশের সহযোগিতায় কয়েকবার উত্তরার গরিবে নেওয়াজ সড়কের ফ্ল্যাট থেকে আমাকে দরজা ভেঙে বের করার চেষ্টা করেন। পরে বাড়িটির অন্য ফ্ল্যাট মালিকদের সহযোগিতায় তিনি রক্ষা পান। বিষয়টি নিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ ওই বাসায় মামলার আসামিকে গ্রেফতার করতে গিয়েছিল, কাউকে বাসা থেকে বের করতে নয়।
নির্যাতিতার এসব অভিযোগের বিষয়ে মামলার আসামি মতিউর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট। আমি লন্ডন প্রবাসী। আমি বিদেশ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার নিয়ে এসেছি। তবে অভিযুক্ত মতিউরের বিরুদ্ধে মামলা থাকার পরও কীভাবে থানায় বসে আপস-মীমাংসা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমি এ বিষয়ে বলতে চাচ্ছি না। আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে পরে জানাব।