সিএনজি চালকের বর্ণনা, ফাঁড়িতে নির্যাতন হাসপাতালে মৃত্যু
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে ।। রাত ৩টার পর সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ঢুকানো হয় রায়হানকে। এ সময় সিএনজিচালক বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। ফাঁড়িতে ৩ নম্বর কক্ষে নিয়ে যাওয়ার কিছু সময়ের মধ্যে ভেসে আসে রায়হানের আর্তনাদের শব্দ। এতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিলো রায়হানকে পেটানো হচ্ছে। এ সময় রায়হান চিৎকার করে না মারার অনুরোধ জানাচ্ছিলো। প্রায় ১৫ মিনিট রায়হানের আর্তনাদের চিৎকার শুনেন ওই সিএনজিচালক। এরপর এএসআই আশেক এলাহীসহ টহল দলকে নিয়ে ডিউটিতে চলে যান সিএনজিচালক। সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হানের ওপর চলা ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা এভাবেই সাংবাদিকদের কাছে দিয়েছেন ওই সিএনজিচালক।
তিনি জানিয়েছেন- টহল দলসহ তারা নগরীর মশরাফিয়া হোটেলের কাছাকাছি ছিলেন। এ সময় দুইজন লোক এসে ছিনতাইয়ের কথা বলে। এ কথা শুনে টহল দলের পুলিশ মোবাইলে কথা বলেন বন্দরবাজার ফাঁড়িতে থাকা এসআই আকবরের সঙ্গে। আকবরের নির্দেশে পুলিশ অভিযান চালায় নগরীর কাস্টঘরের সুইপার কলোনিতে। সেখানের একটি কক্ষ থেকে সুস্থ অবস্থায় রায়হানকে আটক করে নিয়ে আসে পুলিশ। এরপর তাকে নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আসা হয়। ফাঁড়ি থেকে টহলে যাওয়ার পর ভোরে আবার ফাঁড়িতেই ফিরেন। তখন দেখেন ফাঁড়িতে ব্যস্ততা। বলা হয়- ‘একজন আসামি অসুস্থ। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’ সিএনজিচালক জানান- এর কিছুক্ষণ পর ফাঁড়ি থেকে বের করা হয় রায়হানকে। সে কথা বলতে পারছিলো না। পুলিশ সদস্যদের কাঁধে ভর করে তাকে সিএনজিতে তোলা হয়। সিএনজিতে তোলার পর তার বুকের শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গিয়েছিলো। বুক উঠা-নামা করছিলো। এ দৃশ্য দেখে তিনি দ্রুত সিএনজি নিয়ে হাসপাতালে যান। যাওয়ার সময় গাড়িতেই দুই পুলিশ সদস্য এ সময় আফসোস করছিলো। বলছিলো- ‘ইস কেউ কী কাউকে এভাবে মারে। স্যার (আকবর) তাকে একাই মেরেছে।’ দুই পুলিশ সদস্যের আফসোস শুনলেও কোনো কথা বলেননি ওই সিএনজিচালক। তিনি জানান- হাসপাতালে ভর্তি করার পর ডাক্তাররা রায়হানের চিকিৎসা শুরু করেন। হাত ভেঙে গিয়েছিলো। বুকে সমস্যা হচ্ছিলো। এজন্য ডাক্তাররা এক্স-রে করাতে পাঠান। কিন্তু সেখান থেকেই খবর আসে মারা গেছে রায়হান। সিএনজিচালক জানান- এ ঘটনা তাকেও তাড়িত করেছে। ধরে নিয়ে আসা হলো সুস্থ রায়হানকে। আর হাসপাতালে নেয়া হলো মৃতপ্রায় রায়হানকে। সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গত শনিবার রাতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় রায়হানকে। পুলিশের পক্ষ থেকে এখনো এ ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া না গেলেও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে উঠে এসেছে এসব তথ্য। তবে- ওই দিন বন্দরবাজার ফাঁড়ির টহলে থাকা এক পুলিশ সদস্য জানিয়েছেন- ফাঁড়ির ভেতরে এসআই আকবর ভুইয়া বেধড়ক মারধর করে রায়হানকে। রায়হান বার বার বাঁচার আকুতি জানিয়ে চিৎকার করছিলো। কিন্তু যতই চিৎকার করছিলো ততই তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলো এসআই আকবর। রায়হানের নখ উপড়ে ফেলা হয়। এ সময় রায়হান অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো। তার মুখে পানি ছিটিয়ে আবার জ্ঞান ফেরানো হয়। বার বার পানি চাচ্ছিলো রায়হান। কিন্তু তাকে একটু পানিও দেয়া হয়নি। রায়হানকে কিছু সময় পিটিয়ে সাদা পোশাকে থাকা আকবর ছুটে আসতো ফাঁড়ির বাইরে। এ সময় অন্যরা রায়হানকে পেটাতো। কিছু সময় পায়চারি করে আবার আকবর গিয়ে তাকে পেটাতো। এভাবে টানা দুই ঘণ্টার অধিক সময় রায়হানকে পেটানো হয়। যখন রায়হানের পিতা ছেলেকে দেখতে ফাঁড়িতে গিয়েছিলেন তখন রায়হান ফাঁড়ির ৩ নম্বর কক্ষে অচেতন হয়ে পড়েছিলো। তার কোনো হুশ ছিল না। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় রায়হান ঘুমে। সকালে আসার কথা বলে রায়হানের সৎ পিতা হাবিব উল্লাহকে বিদায় করে দেয়া হয়। অভিযানে থাকা এক পুলিশ সদস্য জানান- নিহত রায়হানকে জীবিত অবস্থায় ধরা হয়েছিলো কাস্টঘরের সুইপার সুরাইরলালের ঘর থেকে। ওই ঘরে বসা ছিল রায়হান। সেখান থেকে তাকে আটক করে নিয়ে আসা হয়। তার এই বক্তব্যের সত্যতা মিললো কাস্টঘরের বাসিন্দাদের মুখ থেকে। স্থানীয় বাসিন্দা হীরা লাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- কাস্টঘরের নতুন বিল্ডিংয়ের পুলিশ আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাই দরজা বন্ধ করে দেন। এ সময় পুলিশ এসে দরজায় থাপড়ায়। এক সময় সুরাইরলালের ঘরের দরজা খোলা হয়। সেখানে গিয়ে পুলিশ প্রথমে সুরাইরলালকে মারধর করে। পরে রায়হানকে ধরে নিয়ে আসে। পরে কাস্টঘরের সরু গলি দিয়ে তাকে নিয়ে এসে তোলা হয় সিএনজিতে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ডিও: সিলেট বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্মম নির্যাতনে রায়হান হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং সকল অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট ১ আসনের সংসদ সদস্য ড. এ কে আব্দুল মোমেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ডিও লেটার দিয়েছেন। গত বুধবার পাঠানো ডিও লেটারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন- গত রোববার সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নগরীর নেহারীপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান। ৬টা ৪০ মিনিটের সময় গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন বন্দরবাজার ফাঁড়ির এএসআই আশেকে এলাহী। মারা যাওয়ার পর রায়হানের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তার হাতের নখও উপড়ানো ছিল। এ ঘটনার পর পুলিশের বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতন করে রায়হানকে মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে। রায়হানের মৃত্যুর জন্য দায়িত্বহীনতার দায়ে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এ নিয়ে সারা দেশে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ঘটনাটি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বিবৃতি দেন এবং অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
-সূত্রঃ মানবজমিন
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন