ঝমঝম ঝমঝম, ঝমঝম ঝমঝম বৃষ্টিতে ভিজে চলেছে
প্রাচীন এক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ;
যেখানে লুকিয়ে থাকে পূর্বপুরুষের অজানা অজস্র
ইতিকথার নিদর্শন;
বর্ষার গভীর রাতে একা এক মেয়ে সেখানেই
আশ্রয় নিয়েছে বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে তার গর্ভের সন্তানকে;
রাত দেখেছে রাতের অন্ধকার, মুখোশ …
পলেস্তরা খসিয়ে যে বট গাছ জন্ম নিয়ে ছিল
সে এখন দখল করে নিয়েছে পুরো শরীর;
সভ্যতার শরীর, অবলুপ্ত প্রায় এক শরীর …
ভাস্কর্য এক;
মেয়েটা, সেই বট গাছটাকে চেনে;
চেনে বৃষ্টির শব্দ …
দধিচির হাড় দিয়ে বজ্র সৃষ্টি হলে,
আকাশের কিছু করার থাকে না;
সে তখন অসহায় এক নাবালক;
একের পর এক বিদ্যুৎ খেলে যায় বুকের উপর দিয়ে;
বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছা নিয়ে যারা ঘর থেকে
বেরিয়ে এসে ছিল,
তারা আর কোনও দিনের জন্য বৃষ্টির নামতা
মুখস্থ করেনি ;
কেবলমাত্র পড়ে থাকে ঝরে পরা হলুদ পাতা গুলো;
রাত গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে ;
ছড়িয়ে পড়ে জোনাকির আলো বাকলে বাকলে;
গর্ভবতী মায়ের মতো তারাও আশ্রয়স্থল খুঁজে নিয়েছে;
ঝিঁঝি পোকারা অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে;
বৃষ্টির জলে ধুয়ে যেতে থাকে অতীতের পদচিহ্ন;
কবে সেই ছেলেবেলায় ঠাকুমা শুনিয়ে ছিল
অচিনপুরের গল্প;
সে গুলো আজ এক এক করে মনে পড়ে;
মনে পড়ে রাজকন্যা উদ্ধারের গল্প …
হাটে-বাজারে ঘুরে বেড়ানো পাগলী মেয়েটা
দেখেছে
সকাল, দুপুর, রাত …
রাতের অন্ধকারে ডুবে থাকা সকালের মুখোশ;
হয়ে উঠছে মা …
এক এক করে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়;
আরেক সভ্যতা জন্ম নেয়;
কিন্তু মা আঁচলে ঢেকে রাখে সন্তান, ভবিষ্যৎ .…
শেষ হয়ে আসা মনুষত্ব গুলো নতুন করে
বেঁচে উঠতে চাইছে নিজেদেরই কাছে;
দু হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইছে চেনা অধ্যায়,
অচেনা নিজেরই অস্তিত্ব;
জেগে থাকতে চায় ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার বুকে একটা বট গাছ হয়ে;
জাগছে বোধ …
যে সকল জেলে মাঝি খাঁড়ি পথে জাল পেতে রেখেছে,
তারাও অপেক্ষায় থাকে রুপালি মাছের,
একটা সকালের;
নোনা বাতাসের বাতাসে ভেসে বেড়ায় দক্ষিণরায়ের গল্প, গঙ্গারিডি সভ্যতার ঘ্রাণ;
নতুন দ্বীপভূমিটি জেগে উঠলে হয়তো,
সেখানেই গড়ে উঠবে বসতি, জীবন সংগ্রাম;
বিকালের কনেদেখা আলো মেখে আটপৌরে প্রেমিক যুগল স্বপ্ন বুনে যাবে;
জেলে-মাঝি বুনে যাবে ভাটিয়ালি সুর …
জোনাকির মায়াবী আলোতে গর্ভবতী মা হয়ে ওঠে অলৌকিক এক নারী ,
ভবিষ্যতের মা, মা …
জলের স্রোত বাড়ছে;
বাড়ছে নদীর ঢেউ …
অথচ , ধ্বংসস্তূপের উপর জেগে থাকে বট গাছটা
একটা গোটা দেশ হয়ে পাতা গুলো মেলে ধেরেছে;
শিকড় তার মাটির অনেক গভীরে;
যেখান থেকে সে তুলে নিয়ে আসে মাটির অমৃত;
জলজ নুড়ি-পাথর , শ্যাওলা বৃষ্টির জলে ভুলে যায় অভিমান;
কেবল মেতে ওঠে আনন্দে, আনন্দ উৎসবে;
স্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষ গুলো জানে না
তারা কোথায় গিয়ে ঠেকবে;
তবুও তো স্রোতের অভিমুখে ভেসে চলে;
ভেসে চলে মৃত চৈতন্য …
চেতনাতে কেবলই করুণ দৈনতা;
ঝমঝম ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে নেচে উঠছে
অস্পষ্ট এক সুর;
সেই সুরের সঙ্গে সঙ্গে নেচে চলে অলৌকিক এক আলো ;
সে গুলোকে কোনও দিনের জন্য ধরা যায় না,
ছোঁয়া যায় না,
কেবলমাত্র সযত্নে লালন করতে হয় বুকের মধ্যে;
আর সেটাই হলেই বুকের মধ্যে জন্ম নেয়
লালন সাঁই;
লালন যে শুধুই মানুষ খোঁজে;
গোঁসাইয়ের আখড়া ভেসে গেছে নদীর বুকে
বহু যুগ আগে;
নদী যে তার গোপন অভিসার …
নদীতে আজও ভাসে লখিন্দরের কলার মান্দাস,
বেহুলার নূপুর;
এ সবের কিছুই জানে না আমার পাগলী মা,
কালো কালো মেঘ;
বট গাছটার শিকড়, বট গাছটার ঝুরি সব জানে, সব …
সব কিছুরই ইতিহাস মাটির গভীরে থেকে তুলে এনে
সাজিয়ে রাখে তার ফলের ভিতর;
এক সময় সে গুলো ধূসর পাখিদের দিয়ে ছড়িয়ে দেয় দিকে দিকে, দিগন্তে;
জন্ম নেয় অজস্র বট,
অতীত কথার ধারক, বাহক …
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে, ভিজতে ভিজতে
জন্ম নেয়া ভবিষ্যৎ প্রজন্ম;
গোটা একটা ভূখন্ড, নতুন আরেক চরাচর ভূমি ।
এসএস/সিএ