নাজমুন নেসা পিয়ারির একুশে পদক এবং কবি রইজ উদ্দিনের স্বাধীনতা পদক পাওয়া নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে
স্বাধীনতা ও একুশে পদক নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠেছে দেশে-বিদেশে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদক-২০২০ নিয়ে দেশের বিশিষ্টজনরা প্রশ্ন তুলেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। শুধু স্বাধীনতা পদক নয়, এবারের একুশে পদকও বিতর্কমুক্ত হতে পারেনি। পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় এমন কিছু ব্যক্তির নাম আছে, যাঁদের ঠিক কী কারণে, কী অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, তা কেউ বুঝতে পারছেন না। বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে উঠেছে প্রতিবাদ। এতে শামিল হয়েছেন এর আগে একুশে ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তরাও। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও প্রখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ রয়েছেন এঁদের মধ্যে। মতামত জানিয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য ড. নূহ-উল আলম লেনিন এবার স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীতদের মধ্যে দুজনকে কেন স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে তার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন।
এ দুজনের একজন হচ্ছেন সাহিত্যের জন্য মনোনীত এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ, অন্যজন সংস্কৃতিতে মনোনীত কালীপদ দাস। রইজ উদ্দিন আহম্মদের পরিচয়ের সঙ্গে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি যুক্ত রয়েছে। কিন্তু তিনি আসলেই মুক্তিযোদ্ধা কি না তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। রইজ উদ্দিন আহম্মদের দুটি কবিতা ‘চলে গেলে’ আর ‘নড়েআল হতে নড়াইল’ কবিতা (!) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। ১৩ লাইনের ‘চলে গেলে’ কবিতায় সাতটি বানান ভুল। এগুলোকে কবিতা বলতেও অনেকের আপত্তি।
স্বাধীনতা ও একুশে পদক নিয়ে সমালোচনার ঝড় সঠিক বলে অেনেকেই মনে করেন। চলমান বিতর্কে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান করার পরও শর্ষিনার পীর আবু জাফর মো, সালেহকে দেওয়া স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহার করার দাবিও উঠেছে। আবু জাফর মো, সালেহকে ১৯৮০ সালে শিক্ষার জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ইউএনডিপির দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক ড. সেলিম জাহান তাঁর ফেসবুকে গতকাল সোমবার লিখেছেন, “নিম্নে উদ্ধৃত ‘চলে গেলে’ এ বছর সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এস এম রইজ উদ্দীন আহম্মদের একটি কবিতা। তাঁর এ কাব্যকর্মটি মন্তব্যযোগ্য নয়। সুতরাং সেটা আমি করবো না। আমার জিজ্ঞাস্য, কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ এ ব্যক্তিটিকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পদকের জন্যে মনোনীত করেছেন? স্বাধীনতা পদক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক। বাংলাদেশের একজন নাগরিকের জন্যে এ এক অনন্য স্বীকৃতি। এর অবমাননা করার অধিকার আমাদের কারোরই নেই।”
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক এবং স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত গবেষক শামসুজ্জামান খান গত ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁর ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘এবার সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন রইজ উদ্দিন, ইনি কে? চিনি না তো। কালীপদ দাসই বা কে! হায় স্বাধীনতা পুরস্কার!’
এর আগে একুশে পদক ঘোষণার পর গত ৭ ফেব্রুয়ারি এই পদক নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে ফেসবুকে পোস্ট দেন শামসুজ্জামান খান। পোস্টে তিনি লেখেন, ‘এবার একুশে পদক বড়ই হতাশাব্যঞ্জক হয়েছে। যাঁরা এ পুরস্কার কমিটিতে ছিলেন তাঁদের সাহিত্য সংস্কৃতি সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই। তিন-চারটি ছাড়া অন্যগুলো হাস্যকর। কে সাহিত্যিক, কে মুক্তিযোদ্ধা, কে একেবারেই এ পুরস্কার পেতে পারেন না, সে সম্পর্কে বিচারক/বাছাইকারীদের অজ্ঞতা পর্বতপ্রমাণ। এতে সরকারের বদনাম হয়। সরকারকে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।’
শামসুজ্জামান খান গতকাল বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমার অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি।’
একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রখ্যাত জাদুশিল্লী জুয়েল আইচ গতকাল নিজের ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘একাত্তরের ভয়াবহ পিশাচ শর্ষিনার ‘পীর’ আবু সালেহকে দেওয়া স্বাধীনতা ও একুশে পদক আর ২০২০-এর ‘মহাকবি’ রইজ উদ্দিনদের দেওয়া জাতীয় পদক কেড়ে নিতেই হবে। জাতীয় পাপস্খলনের এটাই সময়। এর কোনো বিকল্প নেই।’
জুয়েল আইচ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রইজ উদ্দিনের তিনটি কবিতা পড়েছি। এতে কাব্য ও ছন্দ নেই। ভাষা ও বানানেও ভুল। এসব কবিতার ভিত্তিতে যদি তাঁকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়ে থাকে, তাতে কবিদের অপমান করা হবে। এর মনোনয়ন বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গে শর্ষিনার পীরের পদকটিও প্রত্যাহার করা যেতে পারে।’
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সব সময়ই চাই স্বাধীনতা পুরস্কার বা একুশে পদক তাঁদের দেওয়া হোক যাঁরা সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন। সবচেয়ে ত্যাগী, অবদানে এগিয়ে থাকা ও সেই সঙ্গে চরিত্রবান, আদর্শবান ব্যক্তিকে এ ধরনের পুরস্কার দেওয়া উচিত। কারণ এ ধরনের পুরস্কার পাওয়া ব্যক্তিরা তরুণদের জন্য যেন অনুসরণকারী হন সেটা তো বিবেচনায় থাকতে হবে। কোনো পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে ব্যক্তি নির্বাচন করতে হবে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে। এখানে বিবেচ্য থাকবে তরুণরা যেন এসব ব্যক্তিকে অনুসরণ করে নিজেকে ও দেশকে এগিয়ে নিতে পারে।’
ড. নূহ-উল আলম লেনিন এবারের ঘোষিত স্বাধীনতা পদকে মনোনীতদের মধ্যে দুজনের পদক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তিনি তাঁর ফেসবুকে দুই দফায় পৃথক স্ট্যাটাস দিয়ে সাহিত্যে এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের মনোনয়ন এবং সংস্কৃতিতে কালীপদ দাসের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এই দুজনকে কেন স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে তার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘স্বাধীনতা পুরস্কার কোনো তামাশা নয়।’
নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, ‘এ ধরনের কাজের জন্য সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। একজন নাগরিক হিসেবে এই প্রতিবাদ জানানো অনেকেরই উচিত। আমি বিবেকের তাড়নায় প্রতিবাদ জানিয়ে রাখলাম।’
কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার সমালোচনা ছাড়াও নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এ বছর ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক দেওয়া হয়েছে ড. নুরুন নবী ও নাজমুন নেসা পিয়ারিকে। জনাব নুরুন নবী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখক, গবেষক। তাঁকে গবেষণা বা মুক্তিযুদ্ধ ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত করা যেত। ভাষা ও সাহিত্যে দিয়েছে, তবু মানা গেল। কিন্তু নাজমুন নেসা পিয়ারিকে কেন কবিতায় একুশে পদক দেওয়া হলো? কবিতায় তাঁর কী অবদান?’
অন্যদিকে রইজ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমি প্রচারবিমুখ, আমার প্রচারের জন্য গাংচিল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ আছে। এর শাখা দেশের সব জেলায় আছে, বিদেশে আছে। আমি এটার কেন্দ্রীয় সভাপতি। হাজার হাজার তৃণমূল পর্যায়ের কবি আমাকে ভালো জানে, আমিও তাদের জানি। রাজধানীর যাঁরা কৌলীন্যের দাবিদার, সেখানে আমি খুব একটা পরিচিত না।’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গতকাল সন্ধ্যায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একুশে পদকের জন্য প্রতিবছর অন্তত ২০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম মনোনয়ন দেওয়া হয়। তারপর চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই করে উচ্চপর্যায়ের কেবিনেট বিভাগ। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সভাপতিত্বে বিশেষ সভায় একুশে পদকের জন্য তালিকা চূড়ান্ত করা হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘একুশে পদক নিয়ে বিতর্ক করার অবকাশ নেই। যোগ্য ও গুণী ব্যক্তিকে এ পদক দেওয়া হয়। তার পরও আমরা মনে করি, তালিকা চূড়ান্তের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হওয়া উচিত।’
এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল রাতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়ার জন্য ব্যক্তি মনোনয়নে যে গুরুত্ব দেওয়া দরকার তা দেওয়া হয় না বলে আমার মনে হয়।’
গত ২০ ফেব্রুয়ারি সরকারের পক্ষ থেকে ৯ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আগামী ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে এ পুরস্কার সংশ্লিষ্টদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে।
এর আগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গত ২০ ফেব্রুয়ারি দেশের ২০ জন বিশিষ্ট নাগরিক ও একটি প্রতিষ্ঠানকে ‘একুশে পদক-২০২০’ দেওয়া হয়।
পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণপদক, পুরস্কারের অর্থ এবং একটি সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বর্ণপদকে ভুল ও জোড়াতালির বানান এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আরও পড়ুনঃ