স্মৃতিতে আমার সহকর্মী দিব্যেন্দুদা || সিদ্ধার্থ সিংহ
পাশে বসা লোকটা প্রায় ঝুঁকে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে অবিন্যস্ত গলায় বললেন, সিদ্ধার্থ, কেমন আছ?
কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেল। ওবেরয় বলরুম। একটু পরেই শুরু হবে আনন্দ পুরস্কারের অনুষ্ঠান। কবি লেখকদের ঠাসাঠাসি ভিড়। এ পাশে নীরেনদা। ও পাশে শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সেলিনা হোসেন। সামনে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, জগন্নাথ বসু, ঊর্মিমালা বসু। কে নেই? শ’য়ে শ’য়ে ক্যামেরা। মিডিয়া।
তখনও অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। হঠাৎ দেখি দু’জন লোক একজনকে ধরে ধরে কোনও রকমে নিয়ে আসছেন। আমি বসেছিলাম দরজার মুখোমুখি। মনে হল, লোকটা বুঝি এখানে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তাঁকে বসতে দেওয়ার জন্য আমি সঙ্গে সঙ্গে ধারের চেয়ারটা ছেড়ে পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম।
ইনিই তো তিনি! কিন্তু ইনি কে! ভাল করে তাঁর মুখের দিকে তাকাতেই আমি চমকে উঠলাম, দিব্যেন্দুদা! হ্যাঁ, দিব্যেন্দুদা। মানে দিব্যেন্দু পালিত।
যিনি মাত্র ষোলো বছর বয়সে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে ‘ছন্দপতন’ লিখে পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। যাঁর দ্বিতীয় গল্প ‘নিয়ম’ প্রকাশিত হয়েছিল দেশ পত্রিকায়। যিনি ছিলেন গান পাগল, নাটকঅন্ত প্রাণ।
যিনি মাত্র একুশ বছর বয়সে ‘সিন্ধু বারোয়াঁ’ উপন্যাস দিয়ে শুরু করে একের পর এক লিখেছেন— রাজার বাড়ি অনেক দূর, কিছু স্মৃতি কিছু অপমান, মুন্নির সঙ্গে কিছুক্ষণ, রজতজয়ন্তী, উড়োচিঠি,
তাঁর ‘মুকাভিনয়’ উপন্যাস নিয়ে বিজয় তেন্ডুলকর নাটক করে পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। শ্যামানন্দ জালান তৈরি করেছিলেন— ঈশ্বর মাইম কোম্পানি, যেটা ডারবান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল।
যাঁর কাহিনি নিয়ে তাক লাগানো এক–একটা সিনেমা বানিয়েছেন তপন সিংহ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো স্বনামধন্য চিত্রপরিচালকেরা।
যিনি জন্মগ্রহন করেন বিহারের ভাগলপুরে ১৯৩৯ সালের ৫ মার্চ। যাঁর বাবার নাম বগলাচরণ পালিত।
মায়ের নাম নীহারবালা দেবী। যাঁর পড়াশোনার সূত্রপাত ওখানকারই দুর্গাচরণ উচ্চবিদ্যালয়ে। পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।
যিনি চাকরি করেছেন ক্লারিয়ন, ম্যাকন অ্যাডভার্টাইজিং সার্ভিসেস, স্টেটসম্যান, হিন্দু
যিনি শুধু কবি, গল্পকার বা ঔপন্যাসিকই ছিলেন না, ছিলেন প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক এবং দক্ষ সম্পাদকও।
এই লেখালিখির জন্যই যিনি পেয়েছেন— বঙ্কিম, সাহিত্য আকাদেমি, ভুয়ালকা, বনফুল, তারাশঙ্কর, উল্টোরথ, আনন্দ–সহ অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা।
যিনি এত বড় একজন সাহিত্যিক হয়েও তরুণ কবি–লেখকদের লেখা শুধু মন দিয়ে পড়তেনই না, উৎসৎও দিতেন। আনন্দবাজার থেকে অবসরের পর যিনি বেশ কিছু দিন দৈনিক ‘সকালবেলা’ পত্রিকার সাহিত্যের পাতা দেখাশোনা করতেন। আমার লেখা যে তিনি শুধু ছাপতেনই, তা নয়, আমার বকলমে সই করে সম্মানদক্ষিণাটা পর্যন্ত নিয়ে আসতেন আমার জন্য। যখন গড়িয়াহাটায় ওঁর মেঘমল্লারের ফ্ল্যাটে যেতাম, উনি মনে করে আমাকে খামটা দিয়ে দিতেন।
তখন ক্যাসেটের যুগ। রিভিউয়ের জন্য প্রচুর ক্যাসেট জমা পড়ত ওঁর কাছে। ভাল কিছু পেলেই আমাকে দিয়ে দিতেন। কত নাটক যে দু’জনে মিলে দেখেছি!
এরবার ওঁরই কাহিনি নিয়ে রমাপ্রসাদ বণিক ‘ত্রাতা’ নামে একটি নাটক করেছিলেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য বারবার জোর করেছিলেন। কিন্তু আমি যেতে পারিনি।
একবার কথায় কথায় দিব্যেন্দুদাকে দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাট আর রাসবিহারী মোড়ের মাঝখানে দেশপ্রিয় পার্কের উল্টো দিকের বিখ্যাত ‘সুতৃপ্তি‘র চায়ের দোকানের কথা বলতেই, সে দিন তিনি মুখে কিছু বলেননি ঠিকই, কিন্তু তার কয়েক দিন পরেই দিব্যেন্দুদা অফিস ছুটির পরে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন পার্ক স্ট্রিটে। এশিয়াটিক সোসাইটির ফুটপাথ ধরে খানিকটা এগোলেই পার্ক হোটেল। তার পাশেই অক্সফোর্ড বুক শপ। তারই দোতলায়।
ওখানে গিয়ে দেখেছিলাম এক আশ্চর্য— ‘চা বার’। নামটা কেন ‘চা বার’ হয়েছে, সেটা বুঝেছিলাম চায়ের মেনু কার্ড দেখেই। একশোরও বেশি ধরনের চা পাওয়া যায় সেখানে! যাঁরা দুধ–চা ভালবাসেন, তাঁদের জন্যে রয়েছে বেশ কয়েক রকম স্বাদের চা। আর যাঁরা সত্যি সত্যিই চা পানের ক্ষেত্রে শৌখিন, তাঁদের জন্য আদর্শ জায়গা হল ওই চা–বার।
অসমের প্রথম শ্রেণির পাঁচ–ছ‘টি টি–এস্টেটের চা পাওয়া যায় সেখানে। প্রতিটি চায়ের স্বাদ আলাদা। বুদলাবেটা, হাপজান, খোবং… দার্জিলিং চায়ের বাহার আরও বেশি— ফার্স্ট ফ্লাশ, সেকন্ড ফ্লাশ, মকাইবাড়ি, দার্জিলিং গোল্ড, দার্জিলিং গ্রিন হ্যান্ড রোল্ড, দার্জিলিং কুইন’স চয়েশ এবং আরও কত কী…
চায়ের রকমারি দেখে আমার তো ধাঁধাঁ লেগে যাওয়ার জোগাড়, তখনও দিব্যেন্দুদা শুধু আমাকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে যাচ্ছিলেন। আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন চা বারের কর্মীরাই।
সে দিন দিব্যেন্দুদা আমাকে তিন দফায় তিন রকমের চা খাইয়েছিলেন। এবং তার বিল মেটাতে গিয়ে দিব্যেন্দুদার পার্স যে অনেকটাই হালকা হয়ে গিয়েছিল, তা আমি বেশ টের পেয়েছিলাম। পরে বুঝেছিলাম এই চা খাওয়ানোর কারণ। আসলে, সুতৃপ্তির থেকেও ভাল চা যে পাওয়া যায় এই শহরেই এবং সেই আস্থানাটা যে তিনি চেনেন, সেটা প্রমাণ করার জন্যই উনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওখানে। এই হচ্ছেন দিব্যেন্দু পালিত।
সে দিন গ্র্যান্ড হোটেলে উনি যখন জানতে চাইলেন, সিদ্ধার্থ, কেমন আছ? আমি তখন একবারও বলতে পারিনি, কী করে ভাল থাকব? আপনারা ভাল না থাকলে যে, আমিও ভাল থাকতে পারি না।
আমরা চার জন এক ঘরে বসতাম, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দিব্যেন্দু পালিত আর আমি। একে একে তিন জনই যখন চলে গেলেন, আমার তখন প্রথমেই মনে হয়েছিল, তা হলে কি এ বার আমার পালা!
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান