দেশের সংবাদ

পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে অসহায় নারীদের সঙ্গে প্রতারণা

পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে অসহায় নারীদের সঙ্গে প্রতারণা

শুভ্র দেব । বাংলাদেশ/১৬ মার্চ ২০২১ । চাকরিজীবী পাত্র। বয়স ৪৭। স্ত্রী মৃত। সন্তান নাই। বাচ্চাসহ গ্রহণ করা হবে। যেকোনো জেলার নামাজি পাত্রীগণ সরাসরি যোগাযোগ করুন-০১৭৬০….। পত্রিকায় এমন বিজ্ঞাপন দেখে ডিভোর্সি দুই সন্তানের জননী পারভীন বেগম (ছদ্মনাম) যোগাযোগ করেন। পাত্র নিজেকে শিল্প মন্ত্রণালয়ে চাকরি করে বলে পরিচয় দেন।

পরিবারের সদস্যরা দেশের বাইরে থাকেন বলে জানান। অপরদিকে পাত্রী একটি হাসপাতালে ছোট চাকরি করেন। উভয়পক্ষের পরিচয় পর্ব শেষ হলে পারভীন ওই পাত্রকে তার অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু না, পাত্র এখনই অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন না। ছোটবেলায় অসুস্থ হলে পরিবার একটি মানত করেছিলেন। যাকে বিয়ে করবেন তার টাকায় হযরত শাহ্‌জালালের মাজারে একটি গরু দেবেন। পারভীনের সেই সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও পাত্রের আবদারে ৪০ হাজার টাকা দেন। টাকা নেয়ার পর থেকেই পাত্রকে আর খুঁজে পাননি পারভীন। শুধু পারভীন বেগম নন, এ রকম প্রতারণার শিকার আরো অনেকে। এ ধরনের অভিযোগে রোববার বিকালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কামরুজ্জামান কামরুল (৬২) নামে এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। ওই প্রতারক দীর্ঘদিন ধরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অন্তত অর্ধশতাধিক নারীর সঙ্গে বিয়ে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। উত্তরা পশ্চিম থানায় এক ভুক্তভোগীর করা মামলায় গতকাল তাকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড আবেদন করেছেন ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা।

ভুক্তভোগী পারভীন আক্তার  বলেন, আমার স্বামী নেই। দুই সন্তানের জননী আমি। হাসপাতালে চাকরি করে সংসার চালাই। সন্তানদের কথা চিন্তা করেই দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখেই বিশ্বাস হয়েছিল। তাই ফোন করেছিলাম। বিয়ের জন্য অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলতেই কামরুজ্জামান মাজারে মানতের কথা বলে। আমি টাকা দিতে অপারগতা দেখাই। বলেছিলাম বিয়ের পর অভিভাবকরাই সেই ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু ওনি আমাকে এমন কিছু কষ্টের কথা বললেন সেটি শুনে আমি টাকা দিতে রাজি হই। দুই বারে মোট ৪০ হাজার টাকা দেই। টাকা নেয়ার পর বিয়ের বিষয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। আমার ভাই এক সপ্তাহ পরে তাদের বাসায় যাওয়ার কথা জানান। এরপর আমার সঙ্গে ৪-৫দিন কথা হয়। পরে আমি ওই মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে তাকে আর পাইনি।

ভুক্তভোগী আরেক নারী সালমা বেগম। তিনি একটি বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে নিজের মামাত বোনের বিয়ের জন্য যোগাযোগ করেন। সালমা নিজেই কামরুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলেন। পাত্র নিজেকে একটি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অফিসার হিসেবে পরিচয় দেয়। ৫বার হজ করেছেন। প্রতিবার জামাতে নামাজ পড়েন। কিছুদিন কথাবলার একপর্যায়ে পাত্র তাকে জানায় মন্ত্রণালয়ে চতুর্থ শ্রেণির চাকরির বিজ্ঞপ্তি হয়েছে। তার কোনো প্রার্থী থাকলে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। সালমা তখন তার ভাগ্নে-ভাগ্নির চাকরির জন্য দু’টি সিভি পাঠান। পরে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন খরচ বাবত টাকা নেয়া শুরু করেন। বিশ্বাস করে সালমা দু’জনের চাকরির জন্য ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক, বিকাশে বিভিন্ন সময়ে ৫ লাখ টাকা পাঠান। টাকা নেয়ার পর ওই ব্যক্তি আর সালমার ফোন রিসিভ করেননি। রিসিভ করলেও চাকরি এবং টাকার কথা বললে নানারকম ভয়-ভীতি দেখান। কারো কাছে এসব বিষয়ে বললে হত্যা ও গুম করার হুমকি দেন। সালমা বেগম মানবজমিনকে বলেন, ৫ বার হজ করেছে। নামাজ পড়ে। এসব দেখে আমার ভালো মানুষ মনে হয়েছে। তাই বোনের জন্য যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি এ রকম প্রতারণা করবে।

ভুক্তভোগী আরেক নারী বলেন, আমিও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করেছিলাম। কামরুজ্জামান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চাকরি করে বলে জানান। তার পারিবারিক ইতিহাস শুনে আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি হইনি। একপর্যায়ে তার বিভিন্ন ধরনের ইমোশনাল কথায় রাজি হই। তারপর তিনি আমার কাছে প্রথমে মাজারে মানতের কথা বলে টাকা নেন। পরে গত বছরে আমাকে ১০ লাখ টাকা কাবিনে বিয়ে করেন। বিয়ের পরে গ্রামে স্বর্ণ আনতে গিয়ে মিথ্যা দুর্ঘটনার নাটক সাজান। এক লোক ফোন করে আমাকে তার দুর্ঘটনা ও হাসপাতালের ভর্তির বিষয়ে জানিয়েছিল। আমি বিশ্বাস করে তাকে তখন আরো ১ লাখ টাকা দিয়েছি। সব মিলিয়ে আমার কাছ থেকে ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা নিয়েছেন।

ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্র্মকর্তারা জানিয়েছেন, আসামি মো. কামরুজ্জামান কামরুল প্রায় তিন বছর ধরে এ রকম প্রতারণা করে আসছে। এর আগে সে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছে। একবার অসুস্থ হওয়ার পর তার ফরিদপুরের বাড়িতে চলে যায়। বাড়িতে স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। এলাকা ও পরিবারের মানুষ তার এসব কর্মকাণ্ড জানতো না। বয়স ও মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে ঢাকায় আলমগীর নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে এসব বিজ্ঞাপন দিতো। অনেক বছর আগে এ রকম একটি বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করে প্রতারণার এই কৌশল সে আয়ত্ত করেছে। তারপর থেকে নিজেই প্রতারণা শুরু করেছে। মাজারে মানত, ধর্মীয় অনুভূতি, হাসপাতালের বিলসহ নানা স্পর্শকাতর কথা বলে অসহায় নারীদের টাকা হাতিয়ে নিতো।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি’র) উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. কায়সার রিজভী কোরায়েশী মানবজমিনকে বলেন, দুই হাজার টাকা করে প্রতি সপ্তাহে দেশের শীর্ষ দু’টি পত্রিকায় পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিতো। একটি মোবাইল নম্বর একটি বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করতো। তার কাছ থেকে অনেক সিম উদ্ধার করা হয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে অসহায়, স্বামী পরিত্যক্তা, ডিভোর্সি নারীরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেই বিভিন্ন কৌশলে সে টাকা আদায় করতো। টাকা নেয়া শেষ হলেও সিম বন্ধ করে রাখতো। এভাবে বহু নারীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কামরুজ্জামানের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ফরিদপুরের সালথা থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া, টাকা আদায়সহ যাবতীয় কাজ করতো।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি’র) উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার কাজী শফিকুল আলম মানবজমিনকে বলেন, আমরা তার ব্যবহৃত বিকাশ নম্বর থেকে ১ বছরে ২০ লাখ টাকার মতো লেনদেনের তথ্য পেয়েছি। এর বাইরে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আরো টাকা নিয়েছে। সে নানা রকম স্পর্শকাতর কথা বলে অসহায় নারীদের কাছ থেকে টাকা নিতো। এখন পর্যন্ত অনেক ভুক্তভোগী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমরা তাদেরকে মামলা করার পরামর্শ দিচ্ছি। কিন্তু অনেকেই মামলা করতে রাজি হচ্ছেন না। আবার কেউ কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে আমাদের কাছে আসছেন। রিমান্ডে এনে তাকে আমরা আরো জিজ্ঞাসাবাদ করবো। -মানবজমিন থেকে

সংবাদটি শেয়ার করুন