আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস-এর তিনটি অণুগল্প
হিয়ার মাঝে
ম্লান মুখ,না আঁচড়ানো মাথার চুল। হাসপাতালের রকে রিক্তা বসে রয়েছে।
রবিন তাকে দেখে কাছে এগিয়ে গেল,”কী করছ,রিক্তা?”
রবিন রিক্তার কলেজের বন্ধু।কিন্তু রবিনের সাথে রিক্তার অনেক দিন কথা নেই।কারণ,রবিন রিক্তাকে একদিন তার সকল বান্ধবীদের সামনে ‘আই লভ ইউ’ বলে পিছন থেকে জাপ্টে ধরেছিল।তার বান্ধবীরা সবাই খুব হাসাহাসি করেছিল।রিক্তা ভীষণ লজ্জা পেয়ে সেদিন থেকে রবিনের সাথে তার আর কথা নেই।
রিক্তা বলল,”মা হাসপাতালে ভর্তি আছে, রক্ত লাগবে।রক্ত কোথায় পাবো তাই বসে বসে চিন্তা করছি।”
“ব্লাড গ্রুপ কী?”
“ও পজেটিভ।”
“তুমি কোন চিন্তা করোনা রিক্তা,আমি রক্ত দেব।আমারও ব্লাড গ্রুপ ‘ও পজেটিভ’।”
রিক্তার হিয়ার মাঝে তারপর বাজতে লাগল—-আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায়….
————
অনিমা দাই
লকডাউনে না মরে কোন রকম ভাবে বেঁচে রয়েছে গরিব মানুষ গুলো। তাদের না আছে হাতে কাজ, না আছে ঘরে খাবার, না আছে পকেটে পয়সা। সুতরাং চরম সমস্যার মধ্যে তাদের দিন কাটছে।
তাদের এহেন অবস্থায় তাদের কথা কেউ না ভাবলেও অনিমা দাই ভাবল। অনিমা দাইয়ের কাজ করে না। তবু গ্রামের মানুষ তাকে অনিমা দাই বলে। কারণ,তার মা এক সময় দাইয়ের কাজ করত। তাতে অনিমার কোন দুঃখ নেই।
অনিমা একটা সাধারণ মেয়ে। তার স্বামী-সংসার নেই। তবে একটা বিয়ে হয়েছিল। স্বামী জোয়ান মরদ ছিল। কিন্তু কপাল দোষে বিয়ের কিছু দিন বাদে স্বামী মারা গেলে পরে সে আর বিয়ে করেনি। যদিও তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে অনেকেই বিয়ে করতে চেয়েছিল।
অনিমার এখন বয়স হয়েছে। সে তার বাবার ভিটাতে থাকে। ভিটাটা তার বাবা তাকে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। যাতে তার এখানে থাকতে কোন অসুবিধা না হয় এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানে সে নির্বিঘ্নে কাটাতে পারে। কেননা,তার দাদা ইন্দ্রজিৎ, ভিটাটা বাদে বাবার অন্যান্য সব বিষয় সম্পত্তি সে জাল করে লিখে নিয়েছে। অনিমার বাবা সেটা জানতে পারার পর অনিমার নামে ভিটাটা লিখে দেন। দাদার সাথে অনিমার কোন সম্পর্ক নেই।
বাবার মৃত্যুর পর অনিমা কিছু দিন খুব কষ্ট পেয়েছিল। খাবারের কষ্ট থেকে শুরু করে পয়সার কষ্ট। তার রোজগেরে দাদা তার জন্য কিছু করেনি। তার প্রিয় গ্রামবাসী ভাইয়েরাই কাজটা তাকে পাইয়ে দেয়। গ্রামের শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে বাচ্চাদের খিচুড়ি রান্না করার কাজটা। ও সেই সাথে তার বিধবা ভাতাটাও চালু করে দেয়। দুটো কাজ এক সাথে পেয়ে অনিমা এখন ভালো আছে। তার একার পক্ষে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু গ্রামের নিরন্ন মানুষগুলো খুব কষ্টে আছে। ফলে অনিমা তাদের কিছু খাদ্য দান করার কথা ভাবল।
অনিমার দাদা যেহেতু তার কোন খবর রাখে না অনিমা তার দিন অ-দিনের জন্য তাই কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছে।কিন্তু মানুষের এই ঘোরতর বিপদে যক্ষের ধনের মতো টাকাটা সে আগলে রাখে কী করে? অতএব অনিমা একদিন গ্রামের নিরন্ন মানুষ গুলোকে খাদ্য দান করল। পরিবার প্রতি পঁচিশ কিলো করে চাল, দু’কিলো করে ডাল আর দশ কিলো করে আলু।
পরিবার গুলো তার এই দান পেয়ে খুবই খুশি হল এবং দু’হাত তুলে ঠাকুরের কাছে তার জন্য মঙ্গল প্রার্থনা করল।
তার এই দান থেকে গ্রামের শেষ প্রান্তে বসবাসকারী দু’জন মুসলিম ঘরামীও বাদ গেল না।
অনিমার এই মহানুভবতার কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। টিভি ও খবরের কাগজের লোকেরা ছুটে এসে তার ছবি তুলল এবং তা খবরে প্রকাশ হলে সেরা সমাজ সেবিকার সে সম্মান পেল। তার সম্মানে গোটা গ্রাম সম্মানিত হল এবং গ্রামের বড়লোক যারা লজ্জায় তারাও এবার কিছু কিছু দান করতে শুরু করল। তাদের এই দানে গ্রামের নিরন্ন মানুষগুলোর খাদ্যাভাব দূর হল। পরে সারা দেশ জুড়ে সরকারের পক্ষ থেকে যখন খাদ্য দান শুরু হল তখন আরো ভালো হল।
হায়!অনিমা দাইয়ের মতো মেয়ে আমাদের দেশের প্রত্যেক গ্রামে যদি একটি করে থাকত, তবে কী ভালো হতো!
———–
অভাগা
ব্যাঙ্কের ঠাণ্ডা ঘরে চেয়ারে জনা দশেক লোক বসে রয়েছে। কাজ হলে তারা প্রত্যেকেই চলে যাবে। এইসময় একটা বুড়ি হাতে একটা কাগজ নিয়ে ভাবে,কাগজটা সে লিখে নেবে কাকে দিয়ে! ভাবতে ভাবতে সে দেখে, লোকগুলোর মধ্যে একজন লোক তার হাতে যে কাগজ রয়েছে ওই রকমই একটা কাগজ লিখছে। বুড়ি কাগজটা লিখে নেবে বলে তার কাছে যায়—-বাবা, আমার কাগজটা একটু লিখে দাও তো!
লোকটা বুড়িকে বলে—-হবেনা। অন্য কাউকে দিয়ে লিখে নাও।
বুড়ি অনুরোধ করে—-একটু লিখে দাও না, বাবা!দিলে কী হবে?”
বুড়ির এই কথা শুনে লোকটা গম্ভীর হয়ে বলে—-অ তুমি বুঝবে না,যেতে বলছি যাও।
বুড়ির মনটা খুবই খারাপ হয়।এরপর পাশের জনকে সে বলে—-বাবা,তুমি লিখে দিবে?
—–আমার কাছে কলম নেই।
—–ও। পরের জনের কাছে গেলে সে বলে—-আমার সময় নেই।
এইভাবে বুড়ি ওখানে যত জন লোক বসে রয়েছে তার হাতের কাগজটা নিয়ে প্রত্যেকের কাছে যায়। কিন্তু নিজ নিজ অসুবিধা দেখিয়ে বুড়ির কাজটা প্রত্যেকে এড়িয়ে যায়। বুড়ির তখন আরো মন খারাপ হয় এবং তার মনে হয়,এ যুগে লেখাপড়া না জানা মানুষের কোন মূল্য নেই। বাড়ি গিয়ে সে তার নাতনির কাছে শেষ বয়সে আবার লেখাপড়া শিখবে। না হলে মরেও যে সে শান্তি পাবেনা। ওখানে গিয়েও যদি কোন কাগজ লিখতে হয়।
একটু দূরে অন্য চেয়ারে একজন লোক বসে রয়েছে। বুড়িকে দেখে সে কাছে এসে বলে—-আপনার কাগজটা আমাকে দিন,আমি লিখে দিচ্ছি।
ওই লোকের চেহারা আর পোশাক দেখে বুড়ির মনে খটকা লাগে। লেখাপড়া জানা মানুষ বলে তাকে বুড়ির মনে হয়না। বুড়ি তাই কাগজটা দেওয়ার আগে তাকে জিজ্ঞেস করে—-তুমি লেখাপড়া জানো?
স্মিত হেসে লোকটা বলে—–দিন, লিখে দিচ্ছি। বুড়ির কাগজটা নিয়ে লিখে দিতেই এবার অন্য রকম একটা লোক এসে বলে—-দাদা,আমার কাগজটাও একটু লিখে দিন তো!
এই লোকটার পরনে ঝকঝকে আর দামি পোশাক রয়েছে। দেখে ওই লোকটা বলে—-আমি লিখে দেব কেন? আপনি লিখুন না!
—–আমার কাছে কলম নেই।
—–আমার কলম নিন!
কিন্তু সে কলম নেয় না। বলে—–আমি লিখতে পারিনা।
তার এই লিখতে না পারার কথা শুনে ওই লোকটা অবাক হয়—-লিখতে পারেন না মানে!
—–লেখাপড়া জানিনা।
অমনি ওই লোকটা বিস্ময়ে হতবাক হয়, হায়! দেশে এরকমও মানুষ আছে! অত:পর কাগজটা লিখে দিয়ে ওই লোকটার মনে হয়, এই লোকটার মতো হয়তো তার টাকা পয়সা নেই। কিন্তু এই লোকটার চাইতে সে গরিব নয়, অভাগা নয়। তার মধ্যে শিক্ষা ধন আছে। লিখতে পড়তে না জানা মানুষগুলো এদিক থেকে সত্যিই অভাগা।
এসএস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান