জনপ্রতিনিধিরা কি মর্যাদা হারাচ্ছেন? | মোঃ মাহমুদ হাসান
একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতিবিদ তথা জন-প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রের আইন-কানুন, নীতিকৌশল আর উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করবেন, আর জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে জনপ্রশাসনের সদস্যরা জন প্রতিনিধিদের পরামর্শ ও মতামত কে বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নয়নকে নিশ্চিত করবেন-এটিই তো প্রত্যাশিত। একটি সরকার কাঠামোতে রাজনীতিবিদ জনপ্রতিনিধি আর আমলাতন্ত্রের সদস্যরা কোনভাবেই একে অন্যের প্রতিপক্ষ নয় বরং পরিপূরক। তাহলে জাতীয় সংসদসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সংসদ সদস্যদের পদমর্যাদা আর আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা নিয়ে এতো হৈচৈ কেন? অর্থনীতির ভারসাম্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলেন, সম্পদ হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কেউ গরীব আবার কেউবা ধনী হয়। অর্থনীতির এই ভারসাম্য নীতিটি কি কোনভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে? জন প্রতিনিধি আর রাজনীতিবিদরা কি এমন কিছু হারাচ্ছেন যা আমলাতন্ত্রকে অতিমাত্রায় শক্তিশালী করে তুলছে! একটি শক্তিশালী দক্ষ আমলাতন্ত্র কি উন্নয়নের অন্তরায়?
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতা হারাচ্ছেন আর আমলারা ক্ষমতা অর্জন করছেন, এমন ঘটনার স্বপক্ষে আমার কাছে কোন দালিলিক প্রমাণ বা পরিসংখ্যান নেই তবে নিবিড় কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। একজন ইউপি চেয়ারম্যান কিছুদিন আগে তার উপজেলার ইউএনও বা জেলার ডিসি মহোদয়ের সাথে আমার কোন সংযোগ আছে কিনা জানতে চাইলেন। এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে সরকারী এই কর্মকর্তাদের অনুরোধ করার জন্য সহযোগিতা চাইলেন। প্রত্যুত্তরে উপজেলা চেয়ারম্যান বা সংসদ সদস্য মহোদয়ের সাথে যোগাযোগের প্রস্তাব দিলে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আমার প্রস্তাবনাকে নাকচ করে দিলেন। স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘ এরা ক্ষমতাহীন, ডিসি, ইউএনও কে বলতে না পারলে কোন কাজ হবে না’। আবার এক সংসদ সদস্যের সাথে আলাপ হলে তিনি বললেন, ‘কোন রকম মান সম্মান নিয়ে বেঁচে আছি, দেখো কোনভাবে ইউএনও বা ডিসি সাহেব কে বলা যায় কিনা!!’ এক উপজেলা চেয়ারম্যানের অভিমত, ‘আমরা তো নিয়ম রক্ষার পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউএনও সাহেব রাজি না হলে কাজ হবে না।’ এসব ঘটনাবলী কি প্রমাণ করে না গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তে আমলারাই অতিমাত্রায় শক্তিশালী হয়ে উঠছেন?
কিংবদন্তি বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্টারিয়ান জননেতা তোফায়েল আহমেদ সংসদে দাঁড়িয়ে জেলায় জেলায় সচিবদের দায়িত্ব পালন নিয়ে যে আবেগঘন বক্তব্য রাখলেন তা কোনভাবেই কি কোন গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকারের চিত্র হতে পারে? জনগণের সাথে সদা সম্পৃক্ত, এলাকার সমস্যা, সুবিধা অসুবিধা আর সুখ দুঃখের সাথী জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে সচিব আর প্রশাসনের আমলারাই যে উন্নয়ন আর থোক বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন- তোফায়েলের আহমেদের আহাকারে সেটি তো অত্যন্ত স্পষ্ট। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য মাহবুবুল আলম হানিফ নিউজ২৪ টিভির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জনগণের দূর্যোগে, বিপদে আপদে রাজনীতিবিদরাই কাছে থাকেন,সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জনপ্রিতিনিধিদের সহযোগীতা করা, কোনভাবেই উন্নয়ন বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ নয়।’ হানিফের বক্তব্যেও আমলাদের ভুমিকা নিয়ে অসন্তোষের চিত্রই ফুটে উঠেছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ক্ষমতাশীন দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারাও যদি আমলাদের ভুমিকাকে অযাচিত মনে করেন তাহলে আমলারা কি কোন অনৈতিক দৈবিক ক্ষমতা উপভোগ করছেন? একটি শক্তিশালী দক্ষ আমলাতন্ত্র তো রাষ্ট্রের অপরিহার্য অনুসঙ্গ, এটিকে যথাযথ উপায়ে ব্যবহার করতে রাজনীতিকরা কি ব্যর্থ হচ্ছে? রাজনীতিকদের কোন অজ্ঞাত দূর্বলতা কি আমলাতন্ত্রকেও অনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তুলছে?
মাত্র অর্ধ শতাব্দীর বাংলাদেশে অর্ধেকেরও বেশি সময় দেশটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক স্বৈরাচারদের মাধ্যমে শাসিত হয়েছে। একনায়ক এরশাদের আমলে এদেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু হয়েছিল। সৌভাগ্যজনকভাবে এই একনায়কের আমলের উপজেলা পদ্ধতিকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। সেই সময়ে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের কাছে উপজেলার কর্মকর্তাদের কাজের জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা ছিল। পরিষদের সভায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুধুমাত্র সাচিবিক দায়িত্ব পালন করতেন। জনপ্রতিনিধি উপজেলা পরিষদের সদস্যরা মাসিক সভায় সামনের কাতারে আর কর্মকর্তারা পেছনের সারিতে বসতেন। কর্মকর্তারা উপজেলার মাসিক সভায় হাজির হওয়ার আগে জনপ্রিতিনিধিদের প্রশ্নবাণে জর্জড়িত হওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকতেন, অপেক্ষাকৃত দূর্বল নৈতিকতার অধিকারী কর্মকর্তারা তাৎক্ষনিক নাজেহালের ভয়ে আতংকে সময়ের হিসাব কষতেন। আর হাল আমলের চিত্রটি পুরোপুরিই উল্টো। জন প্রতিনিধিরা তটস্থ থাকেন, কর্মকর্তাদের উচ্চ কন্ঠের ভয়ে চেয়ারম্যান সাহেবরা করুণা অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকেন, উপজেলা চেয়ারম্যান সভাপতির চেয়ারে বসলেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সন্তুষ্ট করাই যেন উপস্থিত সদস্যদের একমাত্র কর্তব্য হয়ে উঠে। কোনভাবে নির্বাহী কর্মকর্তার চক্ষুশূল হলে বাজেট বরাদ্দ কাটছাটের ভয়ে জনপ্রতিনিধির হ্রদয় কেঁপে উঠে। আর থানার ওসি সাহেবরা অনেক ক্ষেত্রে অধস্তন কোন এসআই, এএসআই কে পাঠিয়ে কর্তব্য কর্মটি সেরে নেন। সামরিক স্বৈরাচারের আমলেও যে জনপ্রতিনিধা বুক ফুলিয়ে উপজেলার মাসিক সভায় হাজির হয়ে কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতে বাধ্য করতেন, বঙ্গবন্ধু কন্যার গনতান্ত্রিক সরকারের আমলে এমন উল্টো চিত্র কিসের ইঙ্গিত বহন করে? তাহলে কি আমরা এখন আমলাতান্ত্রিক গনতন্ত্র নামে কোন অদ্ভুত প্রজাতন্ত্রে বসবাস করছি?
উনসত্তুরের গন অভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ সাম্প্রতিক সংসদ অধিবেশনে জেলায় জেলায় সচিবদের দায়িত্ব পালন আর সংসদ সদস্যদের পদমর্যাদা নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার পরদিন ফেসবুকে এক সদ্য সাবেক আমলার বক্তব্য আমার গোচরীভূত হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার সহ মাঠ প্রশাসনের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী এই কর্মকর্তার সততা আর সদাচার সর্বমহলেই প্রশংসিত। তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তার অভিমত, ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের পদমর্যাদা সচিবদের উপরে মানে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে বসার জন্য অন্যকিছুর জন্য নয়।’ একজন দক্ষ আমলা যখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পদ মর্যাদা নিয়ে এমন ধারণা পোষণ করেন, তখন গনতন্ত্রের মর্যাদা আর সৌন্দর্য নিয়ে সংশয় জাগলে আমার মতো আমজনতার দোষ কোথায়? এরশাদ আমলে সকালের মন্ত্রী বিকেলে হতেন আমজনতা, গনতন্ত্রের চরম দুষ্কালেও জন প্রতিনিধির মর্যাদায় এমন আকাল দেখিনি। এই দুঃসময়ের জন্য কি রাজনীতিকদের কোন দায় নেই?
ক’দিন আগে প্রশাসনের মধ্যম সারির পদোন্নতি বঞ্চিত এক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বললেন, ‘মাঠ প্রশাসনে দায়িত্ব পালনের সময় দুটো সংসদ নির্বাচনে কত ঝুঁকি নিয়ে জেতানোর ব্যবস্থা করলাম, আর আজ আমারই প্রমোশন হয় না’। প্রিয় পাঠক, ভেবে দেখুন, আমাদের প্রজাতন্ত্রের সেবকরা কোনটিকে এখন তাদের যোগ্যতার মাপকাঠি মনে করে!! ২০১৪ আর ২০১৮ সালে বিরোধী দলীয় হটকারী সিদ্ধান্তে নির্বাচন বর্জন, গনতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার আনুষ্ঠানিকতাই রাজনীতিকদের পদমর্যাদাকে কলুষিত করেছে। প্রশাসনের আনুকূল্য না পেলে ২০১৪ আর ২০১৮ সালের আনুষ্ঠানিকতার নির্বাচন যেমন সম্ভব হতো না, তেমনি আজকের বহু পতাকাবাহী হয়তোবা আমজনতার সারিতেই থাকতেন। শুধুমাত্র অর্থ বিত্ত আর কৃপাধন্য হয়ে যারা মার্কা পেয়েছিলেন তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে যে প্রশাসন ভুমিকা রেখেছিল, সেই একই প্রশাসন যদি আপনাদের মর্যাদা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে তাতে আহাজারির কি আছে?
গণতন্ত্রের সংকটে যেমন রাজনীতিকরাই ভরসা, তেমনি জনপ্রতিনিধারাই আমজনতার সুখ দুঃখের আশ্রয়স্থল। পাইকপেয়াদা সমৃদ্ধ আমাদের আমলাতন্ত্রের যে ধারকরা এখনো ভাই আর আপা সম্বোধনে বিব্রত বোধ করেন, বিনা অনুমতিতে দপ্তর প্রবেশকে আইনত দন্ডনীয় বলেই বিশ্বাস করেন,খাস কামরায় প্রবেশধিকার দিতে ক্ষমতা আর কূলিণতাকেই প্রাধান্য দেন, সেই আমলাতন্ত্র কখনো রাজনীতি আর গনতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার পরিপূরক হতে পারে না। প্রশাসনের নির্ভরতাকে শুন্যে নামিয়ে জনতার রায়ের গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে, কাগুজে মর্যাদা নিয়ে যতই হাহাকার হোক, সত্যিকারের পদমর্যাদা দুরাশা-ই থেকে যাবে। উন্নয়নের নামে আমলাতান্ত্রিক গনতন্ত্র জনবিচ্ছিন্নতার পথকেই করবে আরও দীর্ঘায়িত।
লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান