গার্ড অব অনার নিয়ে ধূম্রজাল কেন? | মোঃ মাহমুদ হাসান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা কারো দয়া দাক্ষিণ্যের ফসল নয়। কারো হুইসেলে একদিনে ঝাপিয়ে পড়া সংগ্রামেও আমাদের স্বাধীনতা আসেনি। সুদীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম আর নিখুঁত পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই অবিসংবাদিত জাতীয়তাবাদী নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দু,লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল একটি সুখী সমৃদ্ধ অর্থনীতির সোনার বাংলাদেশ। ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ এ বাংলার মাটিতে ফিরে স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু সে লক্ষ্যেই কাজ শুরু করেছিলেন কিন্তু পরাজিত হায়েনা আর তাদের এদেশীয় দোসরদের প্রতিশোধ স্পৃহায় ১৫ আগষ্টের বিয়োগান্তক ঘটনার মধ্যদিয়ে যে উল্টো পথের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সাল অবধি কখনো সামরিক একনায়ক আর কখনো বা মেকি গনতন্ত্রের আদলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেই ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছিল। ১৯৭১এ যারা ধর্মের দোয়াই দিয়ে মুক্তিকামী দামাল ছেলেদের বুকে গুলি চালিয়েছিল, গনিমতের মাল আখ্যায়িত করে মা-বোনদেরকে হায়েনাদের হাতে তুলে দিয়েছিল, দূর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীন দেশের মাটিতে এই ঘৃণিতরাই আবার লাল সবুজের পতাকা নিয়ে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, এমনকি রাষ্ট্রপতি পদটিকেও কলংকিত করেছিল।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন, সোনার বাংলার পথে এক জলন্ত মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেল হত্যা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে শাপমোচনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তারই সোনালী সংযোজন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানজনক আর্থিক ভাতা আর মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। রাষ্ট্রীয় আচারের অংশ হিসেবে কোন মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরন করলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। আর রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের প্রধান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অথবা জেলা প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধার শেষ বিদায়ে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এই গার্ড অব অনার কোনভাবেই ধর্মীয় বিধি-বিধান বা রীতিনীতির পরিপূরক বা প্রতিপক্ষ নয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় অতি সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে একজন সংসদ সদস্য জানাজার সাথে তুলনা করে গার্ড অব অনারের নেতৃত্ব থেকে নারী কর্মকর্তাদের বাদ দেয়ার দাবি জানালেন। রাত বিরাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের চলাচলে সমস্যার কথাও তুলে ধরলেন। তার এই দাবির সাথে সহমত পোষণ করে সংসদীয় কমিটি বিষয়টি পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বিশ্বাস করি আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনাটি নাকচ হবে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সংসদীয় কমিটির বৈঠকেই বিষয়টি নাকচ হলো না কেন? সম্মানিত সংসদ সদস্যরা কি রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় আচারের পার্থক্য জানেন না? একটি রাষ্ট্রীয় আচার কে ধর্মীয় আচার বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট করলে ধর্মভীরু মুসলমানদের প্রতিক্রিয়াটি কি হতে পারে তা অনুধাবন করতে কি তারা অক্ষম? নাকি ধর্মীয় জুজুর ভয় আর নারী ইস্যুটি সামনে এনে মহোদয়রা রাষ্ট্রীয় আচারের দায়িত্বটি নিজেদের কাঁধেই তুলে নিতে চান?
যে দেশে প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, আপিল বিভাগের বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের মতো দায়িত্ব পালন করছেন নারী, অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সাথে প্রশাসনের শতাধিক নারী সদস্য জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন, সেই দেশে রাত বিরাতের নিরাপত্তার অজুহাতে নারীদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত করার প্রস্তাবনা কিসের ইঙ্গিত বহন করে? তারা কি বুঝাতে চান পরিস্থিতি মোকাবিলায় নারীদের চেয়ে পুরুষরাই শ্রেষ্ঠ? যদি তাই হয় কিছুদিন আগেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য আর মোদি ইস্যুতে সারা বাংলা যখন উন্মাতাল হয়ে উঠেছিল, আপনাদের মতো দক্ষ পুরুষরা কি সেদিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পেরেছিলেন? নাকি সরকার আর আওয়ামী লীগকে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ভয়াবহ আস্ফালন থেকে রক্ষায় নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছেন? যদি উত্তরটি ‘হ্যাঁ’ হয় তবে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনারা কি নিজেদেরকে ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসেবে শেখ হাসিনার চেয়েও নিজেদের দক্ষ মনে করেন?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে নারী পুরুষের অনুপাত ৪৯.৯ঃ ৫১.১ অর্থাৎ দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই নারী। এই নারীদের অবহেলিত রেখে, পুরুষের পাশাপাশি সকল কর্মকান্ডে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে কোনভাবেই জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়, এই সত্যিটি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই গত একযুগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ আজ রোল মডেল। অর্থনৈতিক সক্ষমতা আর দুর্যোগ মোকাবেলায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ধর্মীয় উগ্রবাদ, দুর্নীতি, সুশাসন, নানা ভূ-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ কে মোকাবেলা করে একটি উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে দীপ্ত পদে এগিয়ে যাচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার। কিন্তু তাঁর সরকারেরই সঙ্গী কিছু কিছু মহান সংসদ সদস্যের কর্মকান্ড দেখে মনে হয় এরা হয়তোবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে হ্রদয়ে ধারণ করেন না, আবার শেখ হাসিনার মিশন ভিশন কে বুঝতেও এরা কিংকর্তব্যবিমুঢ়!! টিকেট পেলেই এমপি হওয়া যায় এমন ধারণায় বিমূঢ় হয়ে এরা প্রকারান্তরে শেখ হাসিনার উন্নয়ন ভিশনেরই প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছেন।
নারী পুরুষের সমতা ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে নানামুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে কোনভাবেই উন্নত বাংলাদেশ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আর এই লক্ষ্যে সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন বলেই শেখ হাসিনার ঝুলিতে আজ গ্লোবাল উইমেন্স লীডারশীপ, প্লানেট ফিফটি ফিফটি চ্যাম্পিয়ন, এজেন্ট অব চেঞ্জ এর মতো নানা আন্তর্জাতিক সম্মাননার সমাহার। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, দোহাজারী- কক্সবাজার রেললাইন, মাতারবাড়ী এলএনজি টার্মিনাল ও কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা ও সোনাদিয়া বন্দরের মতো উন্নয়নের মেগা প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে যার বাস্তবায়ন শেষ হলে দেশে জিডিপি ডাবল ডিজিটে পৌঁছাবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর নির্মান শেষ হলে ২০৩০ সালের মধ্যে নতুনভাবে কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এমন পরিকল্পনাকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে নারীসমাজকে যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সমভাবে প্রস্তুত করার অন্য কোন বিকল্প পথ খোলা নেই। তাই শেখ হাসিনার রানিংমেট যারা আজও নারী কে নারী হিসেবেই দেখছেন, পুরুষ আর নারী প্রশাসককে ভিন্নভাবে চিত্রায়িত করে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব তুলছেন, বিনয়ের সাথে বলবো নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবুন, শেখ হাসিনার ভিশন মিশন কে উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন আর অন্তরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করুণ অন্যথায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদেরই প্রিয় বাংলাদেশ, ‘টিকেট পেলেই এমপি হবো’ ধারণাটি একদিন বদলেও যেতে পারে!!
গার্ড অব অনার নিয়ে ধূম্রজাল কেন? | মোঃ মাহমুদ হাসান – লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক, কানাডা
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান