রথযাত্রা || সিদ্ধার্থ সিংহ
রথ বলতেই শ্রীরামপুরের মাহেশের রথ, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের রথ, ধামরাই জগন্নাথ রথ, পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের রথ কিংবা ইসকনের রথ। ইসকনের উদ্যোগে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে যতই মহাসমারোহে জাঁকজমক করে রথ বেরোক না কেন, রথ বলতে লোকে কিন্তু পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রথকেই বোঝে।
প্রতি বছর নতুন কাঠ দিয়ে একদম নতুন করে তৈরি করা হয় এই রথ এবং প্রতি বছর অবিকল একই রকম দেখতে হয়।
রথযাত্রার আগে সাত দিন বন্ধ থাকে মন্দিরের দরজা। প্রচলিত আছে, এই সময় তুমুল জ্বরে আক্রান্ত হন জগন্নাথ। জ্বর কমলে হাওয়া বদলের জন্য আষাঢ় মাসের অষধু শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলরাম রথে চড়ে যান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুণ্ডিচার বাড়ি। এটাকে বলা হয় জগন্নাথের ‘মাসির বাড়ি’। সেখানে সাত দিন থেকে আবার ফিরে আসেন তাঁরা। রথে চড়ে এই যাওয়াকে সোজারথ আর ফেরাটাকে উল্টোরথ বলে।
এই যাত্রাকে রথযাত্রা ছাড়াও পতিতপাবন যাত্রা, নবযাত্রা, গুণ্ডিচাযাত্রা, মহাদেবী যাত্রা বা নন্দীঘোষ যাত্রাও বলে। কথিত আছে, এই রথযাত্রা বা পুনর্যাত্রা, মানে উল্টোরথের দড়ি টানলে এবং রথে থাকা ভগবান জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রাকে চাক্ষুস করলে নাকি সঙ্গে সঙ্গে সাত জন্মের মহাপাপও ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। তার আর পুনর্জন্ম হয় না।
লোকে এটাকে এতটাই মান্য করেন যে, যতক্ষণ না সোনার ঝাঁটা দিয়ে রথ চলার রাস্তাটা কেউ ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন, এই রথযাত্রা শুরুই হয় না।
রথযাত্রার সময় প্রথমে থাকে বলরামের রথ— তালধ্বজ। রথটিতে থাকে চোদ্দোটি চাকা। উচ্চতায় বিয়াল্লিশ ফুট। রথের রং নীল।
তার পরে থাকে সুভদ্রার রথ— দর্পদলন। উচ্চতায় প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এটায় থাকে মোট বারোটি চাকা। এই রথটির ধ্বজা বা পতাকায় ‘পদ্মচিহ্ন’ আঁকা থাকে দেখে এই রথটিকে’পদ্মধ্বজ’ও বলা হয়। এই রথটির রং লাল।
আর একদম শেষে থাকে জগন্নাথের রথ— নন্দীঘোষ। এই রথের পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা থাকে। তাই এই রথের আর এক নাম— কপিধ্বজ। তিনটির মধ্যে এই রথটিই সবচেয়ে বড়। উচ্চতায় পঁতাল্লিশ ফুট। এতে থাকে ষোলোটি চাকা। প্রতিটি চাকার ব্যাস সাত ফুট। রথটির রং হলুদ।
পুরীর এই মন্দিরই একমাত্র মন্দির, যেখানকার বিগ্রহ গর্ভগৃহের বাইরে আনা হয়। জন্মগত ভাবে হিন্দু না হলে এই মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করা নিষেধ। তাই অন্য ধর্মের মানুষেরা পিছন দিকের দক্ষিণের দরজা দিয়ে বলরাম, জগন্নাথ, সুভদ্রাকে দর্শন করেন। শুধুমাত্র এই রথযাত্রার দিনই ভেঙে দেওয়া হয় এই জাতপাতের বেড়া।
শোনা যায়, স্বপ্নাদেশে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সাগরে দারুব্রহ্ম পাওয়ার পর গুণ্ডিচা মন্দিরে এনে মহাবেদী নির্মাণ করে যজ্ঞ করেন। যজ্ঞ শেষ হওয়ার পরে দেবর্ষি নারদ মুনির পরামর্শে সেই দারুব্রহ্ম বৃক্ষটি কাটিয়ে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ তৈরি করার জন্য রাজা মেতে ওঠেন। এ জন্য দেশের সেরা সেরা কাঠের মিস্ত্রীদের ডেকে আনা হয়। কিন্তু দেখা যায়, মূর্তি গড়ার জন্য বৃক্ষের গায়ে যখনই হাতুড়ি, ছেনি বা কুঠার, যাই-ই ঠোকা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
রাজা পড়লেন মহা সমস্যায়। সে সময় ভগবান বিশ্বকর্মা, কারও কারও মতে অবশ্য ভগবান বিষ্ণু, এক ছুতোরের ছদ্মবেশে এসে সেই মূর্তি তৈরি করার ভার নেন।
তিনি এসে বলেন, আমার নাম অনন্ত মহারাণা। আমি মূর্তি গড়ে দেব। আমাকে শুধু একটি বড় ঘর আর ২১ দিন সময় দিন, ব্যস। তবে একটি শর্ত আছে। আমি একুশ দিন দরজা বন্ধ করে কাজ করব। সে সময় কেউ যেন সেই ঘরের দরজা না খোলে। রাজা তাতেই সম্মত হলেন।
ছদ্মবেশী বিশ্বকর্মা ঘরে ঢোকামাত্র বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। রাজার নির্দেশে বসানো হল কড়া প্রহরা। যাতে কাক-পক্ষীও ভেতরে ঢুকতে না পারে।
ভেতরে কাজ চলতে লাগল। একদিন যায়। দু’দিন যায়। সপ্তাহও পেরিয়ে গেল। রানি গুণ্ডিচা আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন, আহা, কারিগরটি কেমন মূর্তি গড়ছে, একবার দেখব না! এই ভেবে মহারানি চোদ্দো দিনের মাথায়, কারও কারও মতে ন’দিনের মাথায় যেই না দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন, অমনি কারিগর ক্রুদ্ধ হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
অসম্পূর্ণ জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রার মূর্তি দেখে রানি তো ভিরমি খান আর কী! হাত নেই, পা নেই, কী বীভৎস্য চোখ… এটা কী বানিয়েছেন উনি!
খবর পেয়ে ছুটে এলেন রাজা। রানির কীত্তি দেখে ভীষণ রগে গেলেন তিনি। মুখে যা এল, তা-ই বলে রানিকে তিরস্কার করলেন।
রাজাকে সেই রাত্রেই ভগবান বিষ্ণু আবার স্বপ্নে দেখা দিলেন। বললেন, আমার ইচ্ছায় দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা এই মূর্তি নির্মাণ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তোমার স্ত্রী শর্ত ভঙ্গ করায় তিনি রেগে গিয়ে এ রকম অসমাপ্ত মূর্তি রেখেই চলে এসেছেন। উনি আর কাজ করতে যাবেন না। তবে তোমার আফসোস করার কোনও কারণ নেই। তুমি তো আমার পরম ভক্ত, ঠিক আছে, আমি এই অসম্পূর্ণ মূর্তিতেই তোমার পূজা নেব।
সেই থেকে আজও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রা পূজিত হয়ে আসছেন সেই অসমাপ্ত রূপেই।
পুরীর বেশির ভাগ লোকই বিশ্বাস করেন, জগন্নাথ দেবের উপরে কেউ নেই! কারণ, ওখানকার লোকেরা লক্ষ্য করে দেখেছেন, মন্দিরের মাথায় কোনও পাখিকে দেখা যায় না। দেখা যায় না ওই মন্দিরের ওপর দিয়ে কোনও কিছুকে উড়ে যেতে। তাই তাঁরা দাবি করেন, জগন্নাথ দেবের উপর কেউ নেই। আর সেটা বজায় রাখার জন্যই ইসকন থেকে পুরীতে যে জগন্নাথ মন্দির তৈরি করার তোড়জোড় চলছে, ঠিক করা হয়েছিল সেই মন্দির হবে পৃথিবীর সব চেয়ে উঁচু মন্দির। কিন্তু প্রশাসন থেকে তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, পুরীর মন্দিরের চেয়ে উঁচু মন্দির ওখানে নির্মাণ করা যাবে না।
সারা বছর সাদা বেশ পরালেও রথযাত্রার আগে স্নানযাত্রার সময় জগন্নাথকে পরানো হয় হাতি বেশ। কেন এই বেশ পরানো হয়, তার পেছনে একটি গল্প আছে।
কথিত আছে, বহু শতক আগে পুরীর রাজদরবারে এসেছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত গণেশ ভট্ট। রাজা তাঁকে জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা দেখবার জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু সেটা দেখতে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না তাঁর। কারণ, তাঁর আরাধ্য দেবতা ছিল গণপতি, মানে গণেশ। তবু রাজা বলেছেন দেখে তিনি প্রায় বাধ্য হয়েই গিয়েছিলেন। কিন্তু স্নানযাত্রায় গিয়ে গণেশ ভট্ট দেখলেন, তিনি যে জগন্নাথের স্নান দেখতে এসেছেন, সেখানে জগন্নাথ কোথায়! এ তো গণেশ ঠাকুর! তখন শুধু জগন্নাথই নয়, পৃথিবীর সমস্ত দেবদেবীই যেন তাঁর কাছে গণেশ ঠাকুরের আদল নিয়ে ধরা দিয়েছে।
না, সময় লাগল না। মুহূর্তের মধ্যে মুখে মুখে সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল এই খবর। আর তার পর থেকেই স্নানযাত্রায় জগন্নাথের পোশাক হয়ে উঠল— হাতিবেশ।
জগন্নাথ দেবের সৃষ্টি সম্বন্ধে ওড়িয়া মহাভারতে এক অদ্ভুত আখ্যান আছে। লীলা সংবরণের আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন বৈকুণ্ঠে যাওয়ার চিন্তা করতে লাগলেন, তখন যদু বংশ গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেছে। বলরাম যোগবলে দেহ রেখেছেন। তাই তিনি বনে গিয়ে একটি গাছের ওপরে উঠে মহাভারতের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। সে সময় তাঁর ঝুুলন্ত পা’দুটিকে লাল পাখি ভেবে জরা নামক এক ব্যাধ তির ছুড়লেন। বলা হয়, এই ব্যাধ আগের জন্মে বালী-পুত্র অঙ্গদ ছিলেন। ভগবান রাম বালীকে বধ করে অঙ্গদকে বর দিয়েছিলেন, পর জন্মে শ্রীকৃষ্ণ রূপে তিনি অঙ্গদের শরে দেহ রাখবেন।
পরে শ্রীকৃষ্ণ দেহ রাখলে তাঁর দেহকে দ্বারকায় সমুদ্র তটে চন্দন কাঠে, খাঁটি গরুর ঘিয়ে দাহ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ছ’দিন ধরে বিপুল চন্দন কাঠ দাউদাউ করে জ্বললেও দেখা গেল, ভগবানের শরীর একটুকুও পোড়েনি। তখন দৈববাণী হল— ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই নশ্বর দেহ আগুনে দাহ করা যাবে না। এই পবিত্র দেহ সমুদ্রে বিসর্জন দাও।
ফলে সেই দেহ তুলে অতি যত্নে সমুদ্রে বিসর্জন দেওয়া হল। পরে সেই দেহ কাঠে রূপান্তরিত হয়ে ভাসতে ভাসতে রোহিনীকুণ্ডে এসে ভেড়ে। সেই কাঠ দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রার বিগ্রহ তৈরি হয়।
কিন্তু কথা হচ্ছে, রথে কি শুধু জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রাকেই দেখা যায়? ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে। বলছে, এক সময় বৌদ্ধদের সামাজিক উৎসবে রথে করে বুদ্ধমূর্তি নিয়ে পথ পরিক্রমা করা হত। ফা-হিয়েনের ভ্রমণ বৃত্তান্তে বৈশাখী পূর্ণিমায় রথযাত্রার কথা পাওয়া যায়। পৌষালী পূর্ণিমার চার দিন আগে নটরাজ শিবের মূর্তি রথে বসিয়ে কর্ণাটে এখনও রথ টানার প্রথা আছে। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং বাংলাদেশের সর্বত্র রথের দেবতা বলতে এই তিন জনই। মহাপ্রভু জগন্নাথ আর তাঁর বৈমাত্রেয় ভাইবোন— বলরাম এবং সুভদ্রা।
এখনও অনেক জায়গাতেই জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রার বিগ্রহের অভাবে রাধা-মাধব, তথা রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকেও রথে বসিয়ে রশি টানা হয়।
পুরীর জগন্নাথ দেবের জন্য প্রতি বছরই বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয় রথ। বলা হয়, সেই রথ তৈরির জন্য কাঠ শনাক্ত করা হয় একেবারে নিয়ম মেনে। নিম গাছের কাঠে বিশেষ কয়েকটি গুণ দেখে তবেই চিহ্নিত করা হয় সেই কাঠ। অলৌকিক ভাবে প্রতিবারই রথযাত্রার আগে সেই সমস্ত গুণ সম্পন্ন কাঠ ঠিকই জোগাড় হয়ে যায়।
আগামী কালই সেই রথযাত্রা। এ বার অতিমারীর কারণে গত বছরের মতো ভক্তবৃন্দ ছাড়াই জাঁকজমকহীন ভাবে পুরীর রথযাত্রা হবে। সেই সব সেবাইতরাই রথের দড়ি টানতে পারবেন, এক সপ্তাহ আগেই যাঁদের করোনার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে এবং ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ নেওয়ারই সার্টিফিকেট আছে।
এ বছর কড়াকড়ি হলেও, প্রতি বছর এই রথযাত্রা উপলক্ষ্যে কার্যত সাজো সাজো রব পড়ে যায় গোটা ওড়িশা জুড়ে। বহু বছরের এই ঐতিহ্যময় উৎসব ঘিরে দেশ বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়। যে পথ দিয়ে এই বিশালাকায় রথ যায়, সেই পথের দু’ধারের বাড়িগুলোর ব্যালকনি, ছাদ, এমনকী ঘরের জানালাও আগাম বুক হয়ে যায় ওইটুকু সময়ের জন্য।
যাতে কোনও অঘটন না ঘটে, রথের দড়ি টানতে গিয়ে কেউ যাতে চাকার তলায় না পড়েন, ঠেলাঠেলিতে পড়ে গিয়ে কেউ যাতে পদপিষ্ঠ না হন, কোনও বাচ্চা অভিভাবকের হাত ছেড়ে যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য সব সময় কড়া নজর রাখে প্রশাসন। মজুত থাকে হাজার হাজার পুলিশ এবং ক’হাত দূরে দূরে সিসিটিভি ক্যামেরা।
পুরীতে ভক্তের ঢল নামলেও শুধুমাত্র ভালবেসে কচিকাঁচা বাচ্চারা কাগজের টুকরো দিয়ে, ফুল দিয়ে সাজিয়ে সর্বত্র যে ছোট ছোট রথ বের করে, তার আনন্দও কিন্তু কোনও অংশে কম নয়।
কম যে নয়, এটা বড়রাও খুব ভাল করে জানেন। বুঝতে পারেন, ‘রথ’ তাদের হৃদের কতটা জায়গা জুড়ে আছে। তাই শীত পড়তে না পড়তেই অলিতে গলিতে যে ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’র আয়োজন করে বিভিন্ন ক্লাব, সেখানেও বহু জায়গায় দেখা যায় আঁকার বিষয়— তোমার দেখা একটা মেলা। এবং বলাই বাহুল্য, বেশির ভাগ বাচ্চাই কিন্তু ‘মেলা’ বলতে রথের মেলাটাকেই বেছে নেয়।
আগে হিন্দি সিনেমায় একটি দৃশ্য আকছার়ই দেখা যেত। দৃশ্যটা এ রকম— দু’জন এমন বীভৎস্য ভাবে একে অন্যকে বেধড়ক মারছে, যেন একজন শেষ না হওয়া অবধি এ লড়াই কিছুতেই থামবে না। চলেছে এলোপাথাড়ি কিল, ঘুসি, লাথি।
সবাই ভিড় করে দেখছে। কিন্তু ওদের রণমূর্তি দেখে কেউই ওদের ধারেকাছে ঘেষতে সাহস পাচ্ছে না। যখন দু’জনেই কাহিল, দু’জনেই মুখ থুবড়ে পড়বে, ঠিক মতো দাঁড়াতেই পারছে না, ঠিক তখনই একজন অন্য জনের জামা ধরে মারল এক টান। আর যেই টান মারল, অমনি জমা ছিঁড়ে গেল। উদোম হয়ে গেল তার বাহু। যে টান মেরেছিল সে থ’ হয়ে গেল— আরে, ভাই তুই?
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, যে ওর জামা ছিঁড়ে দিয়েছিল, সে নিজেও এক হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ফেলল নিজের জামা। তারও বাহু তখন উন্মুক্ত। দু’জনের বাহুতেই আঁকা একই ট্যাটু।
পরে জানা যেত, তারা আসলে দু’জনেই একই মায়ের পেটের ভাই। কখনও কখনও জমজ ভাই।
কোনও এক মেলায় ট্যাটু আঁকার পরে, সে ভিড়ের জন্যই হোক কিংবা কালবৈশাখীর উন্মত্ত ঝড়ের দাপটের জন্যই হোক কিংবা ট্রেনে ওঠার সময়ই হোক, তারা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আর যেটা ওখানে ঘটেছিল, সেটা ছিল একটা মেলা। আর সেই মেলাটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেত— রথের মেলা।
রথের মেলা মানেই পাঁপড় ভাজা। এটা রথের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে গেছে যে, লোকেরা এ দিন বাড়িতেও পাঁপড় ভাজেন। সঙ্গে থাকে জিলিপি। মেলায় তো এগুলো পাওয়া যায়ই, থাকে খেলনাবাটি, বন্দুক ছুড়ে বেলুন ফাটানো, লটারি, মেয়েদের সাজের জিনিস, ফুচকা, পেটাই পরটা, কাপ-ডিস, হাতা, খুন্তি, সাঁড়াশি, হাঁড়ি-পাতিল, রঙিন মাছ, ইলেকট্রিক মেয়ে, ম্যাজিক শো আর যেটা অবশ্যই থাকে, সেটা হল নাগোরদোলা। ইদানিং শুরু হয়েছে বিভিন্ন রাইড— এগুলো ছাড়া রথের মেলা ভাবাই যায় না!
তাই রথের মেলা নিয়ে শুধু সিনেমা নয়, বহু কবি-লেখক যুগ যুগ ধরে প্রচুর কবিতা, ছড়া এবং গল্প লিখেছেন।
তবে এখন অনেকেই রথযাত্রাকে অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তাঁরা বলছেন, রথ হল সমগ্র সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রতীক। এক কথায়, রথযাত্রা মানুষের মধ্যে গোষ্ঠীভাব জাগায়, সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মানুষকে সমষ্টিগত ভাবে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করে। এটাই হল রথযাত্রার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।
রথযাত্রা || সিদ্ধার্থ সিংহ, লেখক- কবি ও প্রাবন্ধিক । কলকাতা
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান