হোটেল বুকিং জটিলতায় যেতে পারেননি হাজারো সৌদিগামী
রাশিম মোল্লা। শরীয়তপুরের প্রবাসী শাহ্জালাল। সৌদি আরব যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে গত বুধবার সকাল ৯টার দিকে বের হন। ফেরিঘাটে এসে দেখেন ফেরি বন্ধ। ফেরিতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর পুলিশ তাদের লাঠিচার্জ করে তাড়িয়ে দেয়। পরে ঘাটের আশপাশেই নির্ঘুম রাত কাটিয়ে কাওরান বাজারের হোটেল সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত সৌদি এয়ারলাইন্সে আসেন। এখানে এসে জানতে পারেন নিজেদেরকে হোটেল বুকিং দিতে হবে। তার মতো আরো অনেকেই দিনভর অবস্থান করেও হোটেল বুকিং দিতে পারেনি।
সৌদি প্রবাসী শাহ্জালাল বলেন, সৌদি আরব যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বুধবার সকাল ৯টায় বের হই। ফেরিঘাটে এসে দেখি ফেরি বন্ধ।
ফেরিতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর পুলিশ আমাদেরকে লাঠিচার্জ করে তাড়িয়ে দেয়। পরে ঘাটের আশ পাশেই সারা রাত বসে থেকে নির্ঘুম রাত কাটাই। আজ ভোরে ফেরি পার হয়ে দুপুরে এখানে আসি। কিন্তু এয়ারলাইন্সের কেউ কিছু বলছে না। আমার মতো এক প্রবাসীর কাছ থেকে শুনলাম, তারা হোটেল বুকিং করতে পারবে না। আমাদের নিজেদের ব্যবস্থা করতে হবে। এই কথাটা যদি আগে বলতো, আমাদেরকে এমন সমস্যায় পড়তে হতো না। আমাদেরকে গত ২৪শে মে বলা হয়েছিল যেদিন ফ্লাইট সেদিন টাকা নিয়ে আসতে। আমরা টাকা নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারা হোটেল বুকিং দিচ্ছে না। তিনি বলেন, আমি যদি কাল না যেতে পারি তাহলে মহা বিপদ হয়ে যাবে। আগামী ১লা জুন পর্যন্ত আমার ভিসার মেয়াদ রয়েছে। এরপরে মালিক যদি মেহেরবানী করে আমার ভিসার মেয়াদ না বাড়ান, তাহলে আমি আর সৌদি আরব যেতে পারবো না। আমাকে পুরো পরিবার নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। আমার আয় দিয়ে মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানসহ পুরো পরিবার চলে।
চাঁদপুরের সৌদি প্রবাসী শামীম, পাবনা চাটমোহরের মুকুল হোসেন এবং নড়াইলের কামরুজ্জামান হোটেল বুকিং দিতে না পেরে নানা অসহায়ত্বের কথা জানান। কামরুজ্জামান বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ৪০ মিনিটে আমার ফ্লাইট। এখনো হোটেল বুকিং করতে পারিনি। ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলাম। অনেক টাকা ধার দেনা করতে হয়েছে। সৌদি যেতে না পারলে এসব দেনা পরিশোধ করবো কীভাবে? নোয়াখালীর তাজুল ইসলাম বলেন, গত রাতে সৌদি অ্যারাবিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে আমার সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল। আমি যেহেতু হোটেল নিশ্চিত করতে পারিনি তাই ফ্লাইট ধরতে পারি নাই। তিনি বলেন, ফ্লাইটের আগের দিন সৌদি এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা প্রথমে বলেছিলেন হোটেল বুকিং করার জন্যে ৬০ হাজার টাকা আনতে বলেছিলেন। কারওয়ান বাজারে এয়ারলাইন্সের অফিসে আসার পর তারা একটি তারিখ নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছেন। চাটমোহরের প্রবাসী মুকুল হোসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, আমাদের এই সমস্যার সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তা নাহলে আমাদের হোটেল বুকিং সমস্যার সমাধান হবে না। আমরা গত কয়েকদিন ধরে প্রবাসীরা এই সমস্যার মধ্যে রয়েছি। সৌদি এয়ালাইন্স কর্তৃপক্ষ আমাদেকে পাত্তাই দিচ্ছে না। পররাষ্টমন্ত্রী এ বিষয়ে সৌদি দূতাবাসের সঙ্গে আলাপ করলে খুব সহসাই সমাধান হয়ে যাবে।
সৌদিপ্রবাসী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফারুক মিয়া এবং ঢাকার মোহাম্মদ জীবনের ফ্লাইট ছিল যথাক্রমে ২৫শে মে ও ২৬শে মে। হোটেল বুকিং নিশ্চিত করতে না পারায় দুই জনেই তাদের ফ্লাইট ধরতে পারেননি। বৃহস্পতিবার রাতে ছাড়ার কথা দু’টি ফ্লাইট। নোটিশে বলা হয়, সৌদি আরবে কফিল বা ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে হোটেল বুকিং দিতে হবে। যখন সৌদি আরবে যোগাযোগ করলাম তখন আমার ট্রাভেল এজেন্ট বললেন যে, বাংলাদেশ থেকে হোটেল বুকিং করতে হবে। হোটেল বুকিং দেয়ার বিষয়ে সঠিক তথ্য কারওয়ান বাজারে সৌদি এয়ারলাইন্সের অফিস বা শাহ্জালাল বিমানবন্দরের কারো কাছেই পাচ্ছেন না বলে তাদের অভিযোগ।
সূত্র জানায়, সৌদি আরবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের জন্য হোটেল বুকিং না থাকায় গত দুই দিনে ফ্লাইট ধরতে পারেননি সহস্রাধিক সৌদিগামী অভিবাসী শ্রমিক। বৃহস্পতিবার সৌদি আরবের উদ্দেশে রাত ১২টা ৪০ মিনিটে এবং ২টা ১৫ মিনিটে দু’টি ফ্লাইট যাওয়ার কথা রয়েছে। এদের অনেকেই এখনো হোটেল বুকিং করতে পারেনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হোটেল সোনারগাঁওয়ে সৌদি এয়ারলাইন্সের সামনে হোটেল বুকিং করতে ভিড় করেন কয়েক শতাধিক যাত্রী। কিন্তু কেউই হোটেল বুকিং করতে পারেননি। হতাশা নিয়ে ফিরে যান বহু প্রবাসী। অনেকে আবার হোটেল বুকিং করার আশা নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করতে দেখা গেছে। সৌদি এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকেও তাদেরকে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হচ্ছে না বলে অভিযোগ প্রবাসীদের। গত ২০শে মে থেকে সৌদিগামী যাত্রীদের হোটেলে কোয়ারেন্টিনের নির্দেশনা কার্যকরের পর থেকে শুরু হয় প্রবাসীদের ভোগান্তি। ২৪শে মে পর্যন্ত প্রথম চারদিন কারওয়ানবাজার ও শাহ্জালাল বিমানবন্দরে সৌদি এয়ারলাইন্স থেকে বুকিং দেয়া হলেও মঙ্গলবার থেকে চরমে ওঠে ভোগান্তি। এয়ারলাইন্স থেকে যাত্রীদের আগাম কোনো তথ্য না জানানোয় সীমা ছাড়িয়েছে দুর্ভোগ। টিকিট রি-শিডিউল ও পুনরায় করোনা টেস্ট করার অর্থও নেই অনেকের কাছে। টিকিট রিইস্যুতেও পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। ভুক্তভোগীরা বলেন, দু’দিন অফিস বন্ধ ছিল। আজও কোনো সমাধান দিতে পারেননি তারা। ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে, আমাদের এ হয়রানি কেন? হোটেল বুকিং দিতে না পেরে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। মঙ্গলবার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ প্রবাসীরা বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে কারওয়ান বাজারে সড়ক অবরোধ করেন তারা। পরে পুলিশ এসে তাদের সরিয়ে দেন।
বায়রার সাবেক অর্থ সচিব এবং বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের সভাপতি ফখরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, হোটেল বুকিংয়ের জটিলতার কারণে অনেক অভিবাসী শ্রমিক নির্ধারিত সময়ে সৌদি আরবে যেতে পারছেন না। ফলে অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্য পরিষদের সভাপতি টিপু সুলতান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রবাসী শ্রমিকদের হোটেল বুকিংয়ে সহায়তা করার জন্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর এগিয়ে আসা উচিত।
কোয়ারেন্টিনের খরচ দেবে সরকার: বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া প্রবাসী কর্মীদের কোয়ারেন্টিন খরচ কমাতে ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গমনেচ্ছু বাংলাদেশি কর্মীদের টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে বয়সসীমা কমানোর চিন্তাভাবনাও করছে সরকার। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। মন্ত্রী বলেন, আমাদের যারা সৌদি আরবে যাচ্ছে তাদের সাতদিনের কোয়ারেন্টিন করতে হয়। ওখানে বিভিন্ন লেভেলের হোটেল রয়েছে। আমাদের প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিনের জন্য যেসব হোটেল নির্ধারণ করেছে সৌদি সরকার, সেগুলো অনেকে ব্যয়বহুল। প্রবাসীদের এসব হোটেলে যেতে আগ্রহ কম। তিনি বলেন, তাদের (প্রবাসী) কষ্ট দেখে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, আপনারা হোটেলের ব্যবস্থা করেন। তাই আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, প্রবাসীরা সৌদিতে গেলে আমরা সাবসিডি (ভর্তুকি) দেবো। বিষয়টি নিয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর সঙ্গে আমি আলাপ করেছি। -মানবজমিন