স্পটলাইটে বাংলাদেশ
মিজানুর রহমান, ঢাকা, ১৫ মার্চ । কাছের এবং দূরের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর মন জয়ে প্রায় ৫০ বছরের প্রচেষ্টার ‘সুফল’ পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। সময়ের পরিক্রমায় আজ উল্টো বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে বড় শক্তিগুলো রীতিমতো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বিষয়টি এখন অনেকটাই ওপেন-সিক্রেট। পেশাদার কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশের কদর আচমকা বাড়েনি। দেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াই ঢাকার প্রতি তাদের আকর্ষণের অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষ করে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারত, কাছের বন্ধু চীন এবং দূরের উন্নয়ন অংশীদার আমেরিকার ফরেন পলিসিতে বাংলাদেশের ফোকাস বেড়েছে। বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক রাজনীতি ঘোলাটে হওয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্বের বিষয়টি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কেন? এখানে বিশেষ কী এমন আছে যে, ঢাকাকে জয়ে বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতায় নামতে হবে? জবাবে পেশাদার কূটনীতিকরা বলছেন, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন নানা কারণে নিয়ামক শক্তি।
বাংলাদেশের এই শক্তিমত্তার বিষয়ে কী প্লেয়াররা বিশেষ করে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র, চীন ভারতসহ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো ওয়াকিবহাল। এখানে তাদের নানারকম স্বার্থ রয়েছে। সেই স্বার্থ সুরক্ষার জন্য দেশগুলোর মধ্যে ‘অসুস্থ’ প্রতিযোগিতাও অমূলক নয় বলে মন্তব্য করেন কেউ কেউ। তবে শান্তি ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজ্জামান মনে করেন বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবেষ্টিত রাষ্ট্র। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত বা ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, কোয়াডের সমুদ্রমুখী সক্রিয়তা, দক্ষিণ চীন সমুদ্রে উত্তরোত্তর উত্তেজনা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, এমনকি সংঘাতের বাস্তব আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতেও বাংলাদেশের মর্যাদা খুবই স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন মতে, বাংলাদেশ যেভাবে কচ্ছপ-গতিতে তার উন্নয়ন এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে চলেছে তাতে দেশটি এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক পাওয়ারহাউজ হতে পারে। আঞ্চলিক বাণিজ্য, ট্রানজিট ও লজিস্টিক নেটওয়ার্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের গেটওয়ে বা প্রবেশদ্বার হতে পারে বলেও মনে করে বিশ্বব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে এভাবেই বাংলাদেশের অবস্থানকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। বাংলাদেশকে কাছে পেতে এশিয়ার বড় দুই শক্তি চীন ও ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিষয়ে বিবিসি’র একাধিক রিপোর্ট রয়েছে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, এই দ্বন্দ্ব সামপ্রতিক বছরগুলোতে এত তীব্র রূপ নিয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি গবেষকদের আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইস্ট এশিয়া ফোরাম’-এর এক নিবন্ধে বাংলাদেশ নিয়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। আর নিউ ইয়র্কভিত্তিক ‘ওয়ার্ল্ড পলিসি রিভিউ’তে ঠিক এ বিষয়েই উড্রো উইলসন সেন্টারের একজন গবেষকের অভিমত ছাপা হয়েছে। দু’টি লেখাতেই বাংলাদেশের সঙ্গে চীন এবং ভারতের সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিরাপত্তা সহযোগিতা, বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন এবং দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য এই দুই বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের বিষয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ রয়েছে। বলা হয়েছে, ভারত এবং চীন- দু’টি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে এর মধ্যে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা বেশি। ইস্ট এশিয়া ফোরামে প্রকাশিত লেখায় ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তারে দু’টি দেশই মূলত বাণিজ্যকে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দু’টি দেশই সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তাদের বিপুল বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে দেশ দু’টির প্রতিযোগিতার বিস্তর বর্ণনা দিয়ে ওই বিশ্লেষকদ্বয় লিখেন- অবকাঠামো খাতে চীন-ভারতের প্রতিযোগিতা থেকে বাংলাদেশ খুব একটা লাভবান হয়নি। কারণ, বাংলাদেশের ম্যানুফ্যাকচারিং এবং জ্বালানি খাতে চীন বা ভারত-কেউই বড় কোনো বিনিয়োগে যায়নি। যদিও ঢাকা এ ধরনের বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়ে যাচ্ছে। বিবিসি’র রিপোর্ট মতে, চীন বহু বছর ধরে বাংলাদেশের সামরিক খাতে বড় সরবরাহকারী। ভারত এক্ষেত্রে পিছিয়ে। কিন্তু দিল্লি চীনকে ধরতে চাইছে। ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনকের মতে, বাংলাদেশ প্রশ্নে দিল্লির কৌশল একেবারেই স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা তাড়িত। তাদের কৌশল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখা, সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব ঠেকিয়ে দেয়া। অন্যদিকে বাংলাদেশে চীন খেলছে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য সামনে রেখে। তারা একদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে, অন্যদিকে বিএনপি’র সঙ্গেও বোঝাপড়া ঠিক রেখেছে। ওই বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ কোনো নিষ্ক্রিয় ‘ভিক্টিম’ নয়, বরং নিজের কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এটি আরও উস্কে দিচ্ছে। তারা বলছেন, ঢাকায় এ নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে যে, দু’টি দেশই বাংলাদেশকে যা দিচ্ছে, তার উল্টো অনেক বেশি নিয়ে যাচ্ছে। বিবিসি’র রিপোর্ট মতে, রোহিঙ্গা সংকটও বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিয়েছে চীন এবং ভারত আসলে কেবল ‘সুদিনের বন্ধু’। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে যে কোনো পদক্ষেপ আটকে দিচ্ছে চীন। ভারত এই ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপে ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকলেও কার্যত দেশটিকেই সাপোর্ট করছে। ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক মনে করেন- চীন এবং ভারত উভয়েই সর্বোতভাবে চেষ্টা করবে বাংলাদেশের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় কে কার আগে থাকতে পারে। কিন্তু তাদের উভয়েই ব্যর্থ হবে, কারণ বাংলাদেশ এখন শিখে গেছে কীভাবে তার প্রাপ্তি আদায় করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারসে’র মাইকেল কুগেলম্যান অবশ্য বিষয়টিকে দেখেন ভিন্নভাবে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশকে নিয়ে চীন এবং ভারতের প্রতিযোগিতা। দু’টি দেশই একসঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে, একে- অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের ঘনিষ্ঠতা বহু বছরের। অথচ যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বাধা হয়নি।
বাংলাদেশ যে কারণে স্পটলাইটে
ঢাকার কূটনীতিকদের মতে, সম্ভাবনায় বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় চীনের এগিয়ে আসার খবরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ বাড়ে। ঢাকায় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের নজিরবিহীন সম্মাননা পাওয়া এবং ২৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের ঘোষণায় পুরনো মিত্র ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে গভীর উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে। বিষয়টি নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সামনে আসে। কেবল বাংলাদেশ নয়, এশিয়া টু আফ্রিকা চীনের প্রভাব বৃদ্ধি এবং দেশগুলোর অর্থনীতিতে অর্থের ডালি নিয়ে হাজির হওয়ার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের ভাবিয়ে তুলে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশে দেশে চীনের প্রভাববলয় বৃদ্ধির মূল শক্তি হচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক রাজনীতি। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠতার পেছনেও অর্থনৈতিক সহায়তা। ইতিমধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তানকে নিয়ে স্বতন্ত্র জোটও গঠন করেছে চীন। যদিও মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কা চীনের ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করছে। চীনা ঋণের ফাঁদ এবং ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠতায় অন্য বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে বাংলাদেশের নেতৃত্ব সচেতন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের কথা তারই আভাস। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি অনেক আগেই বলেন, চীনের কাছ থেকে অতিরিক্ত ঋণের দাবি বাংলাদেশ কখনোই তুলবে না। সাধ্যের বাইরে ঋণের বোঝা ঘাড়ে চাপলে বিপদ হবে, বাংলাদেশ এ কথা ভালোভাবেই জানে। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, বাংলাদেশ যে চীন থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে চায়, তার আরেক বড় প্রমাণ বাংলাদেশের জলসীমায় চীনের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে না পারা। মিয়ানমার থেকে আফ্রিকার জিবুতি পর্যন্ত ‘মুক্তার মালা’র মতো একের পর এক সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে চলেছে চীন। তার নিজের বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রয়োজনে বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও নোঙর করার জায়গা খুঁজছে। ভারতেরও একই লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্রও চায় ভারতের মতো ঘনিষ্ঠ কোনো মিত্র বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজটি পাক। কিন্তুসবদিক বিবেচনায় ঢাকা তা ঝুলিয়ে রেখেছে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অংশগ্রহণ প্রায় নিশ্চিত ছিল। বলাবলি আছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তিতে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে দেয় বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পটি পটুয়াখালীর পায়রাতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেও নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিল চীন। ভারতও মুখিয়ে ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বিদের কাউকেই এককভাবে তা দেয়নি বরং কনসোর্টিয়াম করে আরও একাধিক রাষ্ট্রকে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে সম্পৃক্ত করেছে। এ প্রসঙ্গে নয়া দিল্লিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা খোলাসা করেই বলেন- বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। শুধু চীন বা ভারত নয়, পৃথিবীর সব বন্ধুভাবাপন্ন দেশ থেকেই সাহায্য-সহযোগিতা নেবে বাংলাদেশ। তার ভাষ্যটি ছিল এমন- ‘আমরা দেশের উন্নয়ন চাই। আমাদের জনগণের কথা চিন্তা করতে হবে। কেননা, তারাই এসব উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করবে।’
যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের স্বার্থ এবং বাংলাদেশের ‘ব্যালেন্স’ বাস্তবতা
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, উপমহাদেশসহ বিশ্বে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। চীনের এই প্রভাবের কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে তার আধিপত্য হুমকির মুখে পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশটি তার আধিপত্য ধরে রাখার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। তবে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বলয় বৃদ্ধির প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র যতোটা উদ্বিগ্ন তার চেয়ে বেশি উৎকণ্ঠিত ভারত। কারণ বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা নতুন কিছু নয়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন বন্ধু চীনের ইন্ধন। নেপথ্যে রয়েছে পরাজিত পাকিস্তান। সব মিলে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী শক্তিগুলোকে ঠেকানো নিয়ে বরাবরই দুশ্চিন্তায় ভারত। তাছাড়া এ বিষয়ে দিল্লির নিজস্ব সামর্থ্যের ঘাটতিও রয়েছে। তারা বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। যদিও ৫ই জানুয়ারির বহুল আলোচিত নির্বাচন প্রশ্নে দিল্লি মোটেও ওয়াশিংটনকে পাত্তা দেয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বরাজনীতির নেতৃত্ব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্বে ভারত সুবিধাজনক অবস্থানে। যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে ভারত কিংবা ভারতকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপমহাদেশে ‘চীন ঠেকাও’- নীতিতে উভয়ের অভিন্ন স্বার্থ বিদ্যমান। তাছাড়া চীনের প্রভাব বিস্তার বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত উভয়ের উদ্বেগ রয়েছে। বাংলাদেশসহ ৭০টি দেশের মধ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় চীন ওই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। শুরু থেকেই বাংলাদেশ বেইজিংয়ের ওই উদ্যোগের সঙ্গে প্রকাশ্যে আছে। এ অঞ্চলে একমাত্র ভারত ওই প্রকল্পটির কড়া সমালোচক। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অন্য মিত্ররা তো আছেই। চীনের ওই প্রকল্পের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র তথা বৈশ্বিক নিরাপত্তার কৌশল হিসাবে ওয়াশিংটন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) প্রণয়ন করে। এতে বাংলাদেশকে যোগদানে অব্যাহতভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছে ওয়াশিংটন। গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে আইপিএস নিয়ে আলোচনা করেন। ঢাকায় আসা বিদায়ী ট্রাম্প প্রশাসনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান এবং সদ্য ওয়াশিংটন সফরকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুুল মোমেনের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসন তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থোনি ব্লিনকেনের এ নিয়ে আলোচনা হয়। শুধু তাই নয়, আইপিএস-এ যোগদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ভারত এবং জাপান বাংলাদেশকে ক্রমাগতভাবে উৎসাহিত করছে। কিন্তু ঢাকা এখনও তাতে সম্পৃক্ত হতে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি, আবার প্রত্যাখ্যানও করেনি। যুক্তরাষ্ট্র এতোদিন উপমহাদেশে আইপিএস’র কেন্দ্রে রেখেছিল ভারতকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তারা এর ‘কেন্দ্রবিন্দুতে বাংলাদেশের অবস্থান’ বলে প্রচার করছে। বাংলাদেশের বিদেশ নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত প্রতিনিধিরা বলছেন, আইপিএস নিয়ে ঢাকার ভীতির নানা কারণ। বিশেষ করে এর সঙ্গে সামরিক উপাদান যুক্ত। যেটি চীনের বিআরআই-তে নেই। প্রতিনিধিরা বলছেন, বাংলাদেশ কৌশলে, কূটনৈতিক শব্দ ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারতের সঙ্গে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নীতি অবলম্বন করে চলছে। ত্রয়ী শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্বের মধ্যে না গিয়ে ঢাকা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’- এমন এক কূটনৈতিক বাতাবরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশকে কাছে পেতে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর প্রতিযোগিতার প্রশ্নে বুধবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মানবজমিনকে বলেন, গত ১২ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এটি দেখে আসছে। কোথায় কীভাবে ব্যালেন্স করতে হয় তা সরকার জানে। চীন-জাপানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আমরা তা-ই করে আসছি। উল্লেখ্য, ক’মাস আগে দ্য ডিপ্লোমেটের মতামত ভিত্তিক এক নিবন্ধে বাংলাদেশে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর প্রতিযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, মিডিয়াতে এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনাই বেশি, বাস্তবতা অতোটা নয়। সূত্রঃ মানবজমিন
এস এস/সিএ